leadT1ad

সৈকতে বাড়ছে পর্যটকের মৃত্যু, বন্ধ হচ্ছে লাইফগার্ড সেবাও

স্ট্রিম সংবাদদাতা
কক্সবাজার
স্ট্রিম গ্রাফিক

দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রতিবছর অবকাশযাপনে আসেন অন্তত ৬০ থেকে ৭০ লাখ পর্যটক। ঘুরতে আসা পর্যটকদের অধিকাংশেরই প্রধান আকর্ষণ থাকে নোনাজলে ডুব দিতে সমুদ্রে নামা। কিন্তু শহরের লাবণি থেকে কলাতলী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকত ছাড়া কোথাও গোসলে নামা পর্যটকদের উদ্ধারে লাইফগার্ড কিংবা ডুবুরি দল নেই। এতে সৈকতে নেমে গুপ্ত খাল বা উল্টো স্রোতে পড়ে সাগরে তলিয়ে পর্যটকেরা প্রায়শই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

চলতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৈকতে নেমে ৮ পর্যটকসহ অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অরিত্র হাসান নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আড়াই মাসেও খোঁজ মেলেনি। গত ৭ জুলাই সকালে অরিত্রসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী সৈকতে গোসলে নামেন। উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যান তিন শিক্ষার্থী। দুজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও অরিত্র হাসানের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা আর জানা যায়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আহত অবস্থায় অন্তত হাজারো পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে।

পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়ের পরিক্রমায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের একাধিক স্থানে ভাঙন, গুপ্তখাল, বালুচর এবং বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সাগরে নামার আগে এই বিপদ টেরও পাচ্ছেন না পর্যটকরা। ফলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন কিংবা আটকা পড়ছেন, যা ক্রমেই বাড়ছে। গত এক দশকের মধ্যে সৈকতে ভেসে গিয়ে এ বছরই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে। সৈকতের অনাকাঙ্ক্ষিত এমন মৃত্যু থামাতে যেখানে লাইফগার্ডের পরিধি বাড়ানোর দাবি উঠছে, তখন শহরে চালু থাকা একমাত্র লাইফগার্ড সেবাটি একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা সি-সেফ তহবিল সংকটের কারণে আগামী ১ অক্টোবর থেকে এই সেবা বন্ধ করে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে। এতে করে দেশের প্রধান এই পর্যটনকেন্দ্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পর্যটকদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের রূপ আগের চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি ঘনঘন বৈরী আবহাওয়ায় প্রায় সময় উত্তাল থাকছে সাগর। চলতি বছরের মে থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ১৬টি সতর্কতা সংকেত জারি হয়েছে। এ সময়ে সাগরে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে এবং সৈকতে গুপ্তখাল বা রিপ কারেন্ট সৃষ্টি হয়। গুপ্তখাল কিংবা উল্টো স্রোতে পড়ে বেশিরভাগ পর্যটকের মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা।

সৈকতে নামা পর্যটকদের দিকে নজর রাখেন লাইফগার্ডকর্মীরা। সংগৃহীত ছবি
সৈকতে নামা পর্যটকদের দিকে নজর রাখেন লাইফগার্ডকর্মীরা। সংগৃহীত ছবি

গত ৮ জুন ঈদুল আজহার লম্বা ছুটিতে রাজশাহী শহর থেকে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছিলেন চাকরিজীবী শাহীনুর রহমান (৫৫)। দুপুরে ছেলে সিফাত রহমানকে (২০) নিয়ে সমুদ্রসৈকতের কলাতলীর সায়মন বিচে গোসলে নামেন। গোসলের একপর্যায়ে সিফাত সমুদ্রের দিকে ভেসে যেতে থাকেন। ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে যান শাহীনুর। অনেক চেষ্টার পরও বাবা-ছেলে সৈকততীরে আর ফিরতে পারেননি।

সৈকতের উল্টো স্রোতে পড়ে বাবা-ছেলের ভেসে যাওয়ার এই দৃশ্য দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন লাইফ গার্ডকর্মীরা। উদ্ধার করে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন জেলা প্রশাসনের বিচকর্মীদের সহকারী সুপারভাইজার বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘গুপ্ত খাল বা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে সৈকতে লাল নিশানা টাঙানো থাকে। জোয়ার-ভাটার সময় সূচি থাকে। কিন্তু পর্যটকরা তা না দেখে বা না মেনে গোসলে নেমে বিপদের সম্মুখীন হন।’

গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সৈকতের দুর্ঘটনার প্রায় সবগুলো গুপ্তখালের কারণে হয়েছে বলে মনে করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। তিনি বলেন, ‘গুপ্তখাল সমুদ্রের এক বিশেষ ধরনের স্রোত। যেটি সমুদ্রসৈকতে তৈরি হয়। যখন খুব উচ্চ এবং ঘন ঘন ঢেউ সৈকতে এসে আঘাত করে; তখন সৈকতে বেশ কিছু পানি জমা হয়। এই জমে থাকা পানি ফিরে যাওয়ার সময় একটি সংকীর্ণ চ্যানেলের মাধ্যমে খুব দ্রুত সাগরে ফিরে যায়; এটিই মূলত গুপ্তখাল।

সমুদ্রের তলদেশ যদি অসমতল কিংবা খাঁজ কাটার তীর রেখা থাকে, তাহলে গুপ্তখাল সহজে তৈরি হয় জানিয়ে সমুদ্র বিজ্ঞানী বেলাল হায়দর বলেন, গুপ্ত খাল বা উল্টো স্রোত চিহ্নিত করতে প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী সৈকতে নিয়োজিত থাকা জরুরি। কারণ সৈকতের কোথায় গুপ্ত খাল সৃষ্টি হচ্ছে তা লাইফগার্ড কর্মীরা বুঝতে পারেন।

চলতি বছর সৈকতে গোসলে নেমে গুপ্তখালে আটকা পড়ে সাগরে ভেসে গিয়ে এরই মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বছরই সবচেয়ে মৃত্যু বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্রমাগত মৃত্যুর হার যখন বাড়ছে তখন শহরে চালু থাকা একমাত্র লাইফগার্ড সেবাটিও ১ অক্টোবর থেকে তহবিল সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে দেশের প্রধান এই পর্যটনকেন্দ্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

১২ বছর সেবা দিয়েছে ‘সি সেফ লাইফগার্ড’

২০১২ সালে বেসরকারি সংস্থা সি সেফ লাইফগার্ড কক্সবাজার শহরের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে গোসলে নেমে পর্যটকদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’-এর (আরএনএলআই) অর্থায়নে এ সেবা দেওয়া হয়। গত ১২ বছরে তারা ৮১৫ জন পর্যটকের প্রাণ রক্ষার পাশাপাশি সাগরে ভেসে যাওয়া ৬৫টি জনের মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে।

সি-সেফ লাইফগার্ড আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, ২৭ জন লাইফগার্ডসহ মোট ৩৫ জন কর্মী নিয়ে এ সেবা পরিচালনায় প্রতি মাসে তাদের খরচ হয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দাতা সংস্থা প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থের জোগান না হওয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বরেই এ সেবা বন্ধ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সৈকতে বিপদে পড়া পর্যটকদের উদ্ধারে জরুরি এই সেবা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সৈকত এলাকার হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউজগুলোর মাধ্যমে এ সেবা চালু রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে হোটেল মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।‘

২৭ লাইফগার্ডকর্মীর কী হবে

১২ বছর ধরে লাইফগার্ডকর্মী হিসেবে কাজ করছেন আবদু শুক্কুর (৩৫)। শহরের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে পালা করে দায়িত্ব পালন করেন। কখনও ওয়াচ টাওয়ার, কখনও বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে গোসলে নামা পর্যটকদের গতিবিধির নজর রাখেন। কোনো পর্যটক বিপদে সম্মুখীন হলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন।

গত মঙ্গলবার দুপুরে লাবণী পয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ারে তিন সহকর্মী জড়ো হয়ে গল্প করছেন। আবদু শুক্কুর বলেন, ‘লাইফগার্ডের কাজ ছাড়া আর কোনো কাজে আমার অভিজ্ঞতা নেই। এই চাকরি চলে গেলে কী করব বুঝে আসছে না।’

তাঁর মতো অবস্থা অধিকাংশ লাইফ গার্ডকর্মীর। সি-সেফ লাইফ গার্ডের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, ‘পর্যটকদের জীবন বাঁচাতে সাগরে দাপিয়ে বেড়িয়েছি। কোনো বিপন্ন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পেরে আনন্দ খুঁজে পেতাম। কিন্তু এই চাকরি হারিয়ে আমরা কীভাবে জীবন বাঁচাব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি।’

জরুরি এই সেবায় সরকারি উদ্যোগ দরকার

জেলা প্রশাসন থেকে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের মালিকদের ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মী রাখার বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হোটেল মালিকেরা খুব একটা সাড়া দিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান। তিনি বলেন, মাসে ১৪-১৫ লাখ টাকার জোগান দেওয়া খুব কঠিন। বিষয়টি কীভাবে সুরাহা করা যায় তা ভাবা হচ্ছে।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জীবন রক্ষার অত্যাবশকীয় এই সেবা এনজিওর ওপর নির্ভর করা কোনোমেতে যুক্তিযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বাজেট ও প্রশাসনিক সহায়তা দরকার। না হয় পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়বে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা ব্যক্তিরা বলছেন, জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে থাকা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি সৈকত তিরের চেয়ার-ছাতা, দোকান, বিচ বাইক, লকারসহ বিভিন্ন পর্যটনসেবা খাতের ব্যবসা থেকে বাৎসরিক বড় অংকের রাজস্ব পায়। এ অর্থ থেকেও লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে পারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত