গাজায় ছেলেহারা মায়ের আকুতি
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ওরা কেন চলে গেল? কেন? ওরা কী অপরাধ করেছিল? ওদেরও তো স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীর সব শিশুর মতোই। ওদের যদি ছোট একটা খেলনা দিতেন, ওরা কত খুশি হতো! ওরা তো শুধু শিশু ছিল, আর কিছু না।
স্ট্রিম ডেস্ক
গাজার বাসিন্দা ইমান আল-নূরি। ৩২ বছর বয়সী এই নারী পাঁচ সন্তানের মা। তাঁর ছোট ছেলে সিরাজ। বয়স মাত্র দুই বছর। বৃহস্পতিবার (১০জুলাই) ভোরে সিরাজ ক্ষুধায় কেঁদে উঠেছিল কিছু খাবার আশায়।
তখন সিরাজের ১৪ বছর বয়সী মামাতো ভাই সামা তাকে আর তার দুই বড় ভাই ওমর (৯) আর আমির (৫)-কে নিয়ে দেইর আল-বালাহ শহরের আলতাইয়ারা ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছিল। সেখানে খাবার আর ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
ইমান বলছিলেন, ক্লিনিক তখনও বন্ধ ছিল। তাই ওরা ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ আমরা বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ছুটে গিয়ে স্বামীকে বললাম, হাতিম! তোমার ছেলেরা! ওরা তো পয়েন্টে (ক্লিনিকে) গিয়েছিল।
তাঁরা বিস্ফোরণের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন সেই জায়গায়। গিয়ে দেখেন, তার ছেলেরা একটা গাধার গাড়িতে শুয়ে আছে। গাড়িটা তখন মরদেহ আর আহতদের হাসপাতালে নিতে ব্যবহার করা হচ্ছিল -- সেখানে কোনো অ্যাম্বুলেন্সই ছিল না।
সেই গাড়িতেই ইমান দেখলেন আমির আর সামার লাশ। ওমর আর সিরাজকে পেলেন গুরুতর আহত অবস্থায়।
মাত্র পাঁচ বছরের আমিরর প্রাণ নিমেষেই কেড়ে নেয় ইসরায়েলি বোমা
ইমান বলছিলেন, ওমরের তখনো একটু শ্বাস ছিল। সবাই চেষ্টা করেছিল তাকে বাঁচাতে। ওমরের রক্ত দরকার ছিল, সেই রক্ত জোগাড় করতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। রক্ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে কিছুই হলো না।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ওরা কেন চলে গেল? কেন? ওরা কী অপরাধ করেছিল? ওদেরও তো স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীর সব শিশুর মতোই। ওদের যদি ছোট একটা খেলনা দিতেন, ওরা কত খুশি হতো! ওরা তো শুধু শিশু ছিল, আর কিছু না।
ইমান বলছিলেন, সিরাজের মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল আর ওর একটা চোখ চলে গেছে, সেই দৃশ্য এখনো আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না।
ইমান আরও বলেন, ওর মাথার খুলি ভেঙে গেছে... ডাক্তার বললেন শুধু রক্তক্ষরণ নয়, ওর ব্রেনে বড়সড় হেমারেজ হয়েছে। কতক্ষণ আর ও এভাবে থাকবে, শুধু অক্সিজেনের ভরসায়? দুজন তো আগেই চলে গেছে... যদি ও একটু সময় আমাকে দিত বাঁচিয়ে রাখার জন্য!
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছেন তারা সিরাজকে আর চিকিৎসা দিতে পারছেন না।
কাঁদতে কাঁদতে ইমান বলছিলেন, গতকাল সকাল সাতটা থেকে এখন পর্যন্ত ওর অবস্থা একই। ও এখনো নিশ্বাস নিচ্ছে, বুক ওঠা-নামা করছে, ওর নিশ্বাস আছে! ওকে বাঁচান!
৯ বছর বয়সী ওমর (ডানে), আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে
আলতাইয়ারা ক্লিনিক পরিচালনাকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাহায্য সংস্থা প্রজেক্ট হোপ। তাদের এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণটি ঘটেছিল সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে।
ডা. মিথকাল আবুতাহা বলেন, সকাল ৯টায় ক্লিনিক খোলার আগে অনেক নারী ও শিশু বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, যেন পুষ্টিকর খাবার আর চিকিৎসা সেবা আগে পায়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় রাস্তার পাশে কিছু নারী-শিশুর খুব কাছে দুইজন পুরুষ হাঁটছিলেন। হঠাৎই সেই দুইজনের পাশে বিস্ফোরণ ঘটে, চারপাশে ধুলো আর ধোঁয়া ছেয়ে যায়।
পরে হামলার ঘটনার গ্রাফিক ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেক শিশু আর প্রাপ্তবয়স্কের মৃতদেহ। আছে কিছু গুরুতর আহত মানুষও।
ইমান বলেছেন, ডাক্তাররা তাকে জানিয়েছেন যে তারা দুই বছর বয়সী সিরাজের চিকিৎসা করতে পারছেন না।
এক নারী তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘দয়া করে আমার মেয়ের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন!’ কিন্তু তখন কারোই আর কিছুই করার ছিল না।
ডা. আবুতাহা জানিয়েছেন, ওই হামলায় ১৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১০ জন শিশু আর ৩ জন নারী।
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা একজন ‘হামাস জঙ্গিকে’লক্ষ করেছিল এবং ‘সাধারণ মানুষের ক্ষতি’র জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, পুরো ঘটনাটি এখনো ‘পর্যালোচনা’করা হচ্ছে।
প্রজেক্ট হোপ বলেছে, এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা আবারও প্রমাণ করছে, গাজায় কেউই নিরাপদ নয়, কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়।
ডা. আবুতাহা বলেন, যে জায়গায় মানুষ তাদের ন্যূনতম মানবিক সেবা আর অধিকার পেতে গিয়েছিল, সেখানে এভাবে মৃত্যুর ঘটনা সত্যিই সহ্য করার মতো নয়।
তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতির সমালোচনা করে বলেন, ওদের এই দুঃখ প্রকাশে কোনো লাভ নেই। যারা মারা গেছে, সেই রোগী আর শিশুদের তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
ডা. আবুতাহা আরও বলেন, এই ক্লিনিকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি ‘ডিকনফ্লিকটেড’মানবিক সেবাকেন্দ্র। এখানে কোনো ধরনের সামরিক হামলা হওয়ার কথা নয়।
ইমান বলছিলেন, আমার ছেলেরা দুই-তিন দিন পরপরই ক্লিনিকে যেত খাবার আর সাপ্লিমেন্ট নিতে। কারণ মা-বাবা হয়ে আমরা ওদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগাতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, ওদের বাবা হাতিম নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে শুধু একমুঠো আটা আনতে নেটজারিমের দিকে যায় (দেইর আল-বালাহের উত্তরে ইসরায়েলি করিডোর)। যখন ও যায়, তখন আমার বুক ফেটে যায়। শুধু খাবার বা আটা আনতেই ওকে যেতে হয় (মৃত্যুর মুখোমুখি)।
ইমান বলেছেন, যুদ্ধবিরতি “আমার জন্য আর কোনো অর্থই রাখে না, আমার সন্তানরা তো আর নেই।
কান্না জড়ানো গলায় তিনি বলেন, কিছুই তো নেই। খাবার নেই, চাল-ডাল কিছুই নেই। কোন পরিস্থিতিতে একটা শিশু না খেয়ে চিৎকার করে!
ইসরায়েল চলতি বছরের মার্চের শুরুতে গাজায় সম্পূর্ণ ত্রাণ অবরোধ জারি করেছিল। এর দুই সপ্তাহ পর হামাসের বিরুদ্ধে আবার বড় হামলা শুরু করে তাঁরা। ফলে তখনকার দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। ইসরায়েল বলেছিল, তারা গাজায় বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করতে হামাসের উপর চাপ বাড়াতে চায়।
পরে মে মাসের শেষের দিকে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে সতর্কতা আসার পর কিছুটা ত্রাণ ঢোকার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে এখনো সেখানে খাবার, ওষুধ আর জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, পুরো গাজাজুড়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু আক্রান্ত হচ্ছে।
ডা. আবুতাহা বলেন, আমরা এবার গাজায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও প্রচুর অপুষ্টির রোগী পাচ্ছি, যা আগে কখনো দেখিনি।
ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা চালু করেছে। তারা দাবি করছে, এতে করে হামাস ত্রাণ চুরি করতে পারবে না। কিন্তু এই কর্মসূচি চালু করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন মানুষ ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলছে, গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৭৯৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬১৫ জন নিহত হয়েছে জিএইচএফ-এর সাইটগুলোর আশেপাশে, যেগুলো মার্কিন প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত আর সামরিক এলাকার ভেতরে। বাকি ১৮৩ জন নিহত হয়েছে জাতিসংঘ আর অন্যান্য ত্রাণ পয়েন্টের আশেপাশে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, তারা স্বীকার করছে যে নিরীহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, তবে চেষ্টা করছে যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ‘সংঘর্ষের ঝুঁকি’যতটা সম্ভব কমানো যায়।
এদিকে জিএইচএফ বলছে, জাতিসংঘ গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ভুল আর বিভ্রান্তিকর তথ্য’ ব্যবহার করছে।
ডা. আবুতাহা আহ্বান জানিয়েছেন, ইসরায়েল যেন যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, ওষুধ আর জ্বালানি ঢুকতে দেয়, যাতে গাজার সবাই ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণ করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে।
তাঁর আশঙ্কা, মানুষকে হয়তো মিথ্যা আশা দেখানো হচ্ছে যে ইসরায়েল আর হামাস শিগগিরই নতুন যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাবে।
জাতিসংঘ বলছে, পুরো গাজাজুড়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি আর ২৮ জন জিম্মি মুক্তির চুক্তি কয়েক দিনের মধ্যেই হতে পারে।
কিন্তু ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা শুক্রবার রাতে বলেছেন, কাতারে চলা পরোক্ষ আলোচনা প্রায় ভেঙে পড়েছে। একদিকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে ইসরায়েলের টালবাহানা আর শর্তগুলো নিয়ে হামাসের আপত্তি। অন্যদিকে গাজার সব মানুষকে রাফার এক ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনা। এই দুই ইস্যু মিলিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ।
এদিকে ছেলেহারা মা ইমান কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, প্রতিদিন যুদ্ধবিরতির কথা শোনায়, কিন্তু কোথায় সেটা? ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে— না খাইয়ে, গুলি করে, বোমা ফেলে, বিমান হামলা চালিয়ে। আমরা কতভাবে মরেছি!
তিনি বলেন, ‘ওদের বেঁচে থাকার চেয়ে আল্লাহর কাছে চলে যাওয়াই ভালো। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিন’
(বিবিসিতে প্রকাশিত ডেভিড গ্রিটেনের প্রতিবেদন। অনুবাদ : সৈকত আমীন।)
গাজার বাসিন্দা ইমান আল-নূরি। ৩২ বছর বয়সী এই নারী পাঁচ সন্তানের মা। তাঁর ছোট ছেলে সিরাজ। বয়স মাত্র দুই বছর। বৃহস্পতিবার (১০জুলাই) ভোরে সিরাজ ক্ষুধায় কেঁদে উঠেছিল কিছু খাবার আশায়।
তখন সিরাজের ১৪ বছর বয়সী মামাতো ভাই সামা তাকে আর তার দুই বড় ভাই ওমর (৯) আর আমির (৫)-কে নিয়ে দেইর আল-বালাহ শহরের আলতাইয়ারা ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছিল। সেখানে খাবার আর ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
ইমান বলছিলেন, ক্লিনিক তখনও বন্ধ ছিল। তাই ওরা ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ আমরা বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ছুটে গিয়ে স্বামীকে বললাম, হাতিম! তোমার ছেলেরা! ওরা তো পয়েন্টে (ক্লিনিকে) গিয়েছিল।
তাঁরা বিস্ফোরণের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন সেই জায়গায়। গিয়ে দেখেন, তার ছেলেরা একটা গাধার গাড়িতে শুয়ে আছে। গাড়িটা তখন মরদেহ আর আহতদের হাসপাতালে নিতে ব্যবহার করা হচ্ছিল -- সেখানে কোনো অ্যাম্বুলেন্সই ছিল না।
সেই গাড়িতেই ইমান দেখলেন আমির আর সামার লাশ। ওমর আর সিরাজকে পেলেন গুরুতর আহত অবস্থায়।
মাত্র পাঁচ বছরের আমিরর প্রাণ নিমেষেই কেড়ে নেয় ইসরায়েলি বোমা
ইমান বলছিলেন, ওমরের তখনো একটু শ্বাস ছিল। সবাই চেষ্টা করেছিল তাকে বাঁচাতে। ওমরের রক্ত দরকার ছিল, সেই রক্ত জোগাড় করতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। রক্ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে কিছুই হলো না।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ওরা কেন চলে গেল? কেন? ওরা কী অপরাধ করেছিল? ওদেরও তো স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীর সব শিশুর মতোই। ওদের যদি ছোট একটা খেলনা দিতেন, ওরা কত খুশি হতো! ওরা তো শুধু শিশু ছিল, আর কিছু না।
ইমান বলছিলেন, সিরাজের মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল আর ওর একটা চোখ চলে গেছে, সেই দৃশ্য এখনো আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না।
ইমান আরও বলেন, ওর মাথার খুলি ভেঙে গেছে... ডাক্তার বললেন শুধু রক্তক্ষরণ নয়, ওর ব্রেনে বড়সড় হেমারেজ হয়েছে। কতক্ষণ আর ও এভাবে থাকবে, শুধু অক্সিজেনের ভরসায়? দুজন তো আগেই চলে গেছে... যদি ও একটু সময় আমাকে দিত বাঁচিয়ে রাখার জন্য!
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছেন তারা সিরাজকে আর চিকিৎসা দিতে পারছেন না।
কাঁদতে কাঁদতে ইমান বলছিলেন, গতকাল সকাল সাতটা থেকে এখন পর্যন্ত ওর অবস্থা একই। ও এখনো নিশ্বাস নিচ্ছে, বুক ওঠা-নামা করছে, ওর নিশ্বাস আছে! ওকে বাঁচান!
৯ বছর বয়সী ওমর (ডানে), আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে
আলতাইয়ারা ক্লিনিক পরিচালনাকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাহায্য সংস্থা প্রজেক্ট হোপ। তাদের এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণটি ঘটেছিল সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে।
ডা. মিথকাল আবুতাহা বলেন, সকাল ৯টায় ক্লিনিক খোলার আগে অনেক নারী ও শিশু বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, যেন পুষ্টিকর খাবার আর চিকিৎসা সেবা আগে পায়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় রাস্তার পাশে কিছু নারী-শিশুর খুব কাছে দুইজন পুরুষ হাঁটছিলেন। হঠাৎই সেই দুইজনের পাশে বিস্ফোরণ ঘটে, চারপাশে ধুলো আর ধোঁয়া ছেয়ে যায়।
পরে হামলার ঘটনার গ্রাফিক ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেক শিশু আর প্রাপ্তবয়স্কের মৃতদেহ। আছে কিছু গুরুতর আহত মানুষও।
ইমান বলেছেন, ডাক্তাররা তাকে জানিয়েছেন যে তারা দুই বছর বয়সী সিরাজের চিকিৎসা করতে পারছেন না।
এক নারী তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘দয়া করে আমার মেয়ের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন!’ কিন্তু তখন কারোই আর কিছুই করার ছিল না।
ডা. আবুতাহা জানিয়েছেন, ওই হামলায় ১৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১০ জন শিশু আর ৩ জন নারী।
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা একজন ‘হামাস জঙ্গিকে’লক্ষ করেছিল এবং ‘সাধারণ মানুষের ক্ষতি’র জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, পুরো ঘটনাটি এখনো ‘পর্যালোচনা’করা হচ্ছে।
প্রজেক্ট হোপ বলেছে, এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা আবারও প্রমাণ করছে, গাজায় কেউই নিরাপদ নয়, কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়।
ডা. আবুতাহা বলেন, যে জায়গায় মানুষ তাদের ন্যূনতম মানবিক সেবা আর অধিকার পেতে গিয়েছিল, সেখানে এভাবে মৃত্যুর ঘটনা সত্যিই সহ্য করার মতো নয়।
তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতির সমালোচনা করে বলেন, ওদের এই দুঃখ প্রকাশে কোনো লাভ নেই। যারা মারা গেছে, সেই রোগী আর শিশুদের তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
ডা. আবুতাহা আরও বলেন, এই ক্লিনিকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি ‘ডিকনফ্লিকটেড’মানবিক সেবাকেন্দ্র। এখানে কোনো ধরনের সামরিক হামলা হওয়ার কথা নয়।
ইমান বলছিলেন, আমার ছেলেরা দুই-তিন দিন পরপরই ক্লিনিকে যেত খাবার আর সাপ্লিমেন্ট নিতে। কারণ মা-বাবা হয়ে আমরা ওদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগাতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, ওদের বাবা হাতিম নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে শুধু একমুঠো আটা আনতে নেটজারিমের দিকে যায় (দেইর আল-বালাহের উত্তরে ইসরায়েলি করিডোর)। যখন ও যায়, তখন আমার বুক ফেটে যায়। শুধু খাবার বা আটা আনতেই ওকে যেতে হয় (মৃত্যুর মুখোমুখি)।
ইমান বলেছেন, যুদ্ধবিরতি “আমার জন্য আর কোনো অর্থই রাখে না, আমার সন্তানরা তো আর নেই।
কান্না জড়ানো গলায় তিনি বলেন, কিছুই তো নেই। খাবার নেই, চাল-ডাল কিছুই নেই। কোন পরিস্থিতিতে একটা শিশু না খেয়ে চিৎকার করে!
ইসরায়েল চলতি বছরের মার্চের শুরুতে গাজায় সম্পূর্ণ ত্রাণ অবরোধ জারি করেছিল। এর দুই সপ্তাহ পর হামাসের বিরুদ্ধে আবার বড় হামলা শুরু করে তাঁরা। ফলে তখনকার দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। ইসরায়েল বলেছিল, তারা গাজায় বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করতে হামাসের উপর চাপ বাড়াতে চায়।
পরে মে মাসের শেষের দিকে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে সতর্কতা আসার পর কিছুটা ত্রাণ ঢোকার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে এখনো সেখানে খাবার, ওষুধ আর জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, পুরো গাজাজুড়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু আক্রান্ত হচ্ছে।
ডা. আবুতাহা বলেন, আমরা এবার গাজায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও প্রচুর অপুষ্টির রোগী পাচ্ছি, যা আগে কখনো দেখিনি।
ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা চালু করেছে। তারা দাবি করছে, এতে করে হামাস ত্রাণ চুরি করতে পারবে না। কিন্তু এই কর্মসূচি চালু করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন মানুষ ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলছে, গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৭৯৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬১৫ জন নিহত হয়েছে জিএইচএফ-এর সাইটগুলোর আশেপাশে, যেগুলো মার্কিন প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত আর সামরিক এলাকার ভেতরে। বাকি ১৮৩ জন নিহত হয়েছে জাতিসংঘ আর অন্যান্য ত্রাণ পয়েন্টের আশেপাশে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, তারা স্বীকার করছে যে নিরীহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, তবে চেষ্টা করছে যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ‘সংঘর্ষের ঝুঁকি’যতটা সম্ভব কমানো যায়।
এদিকে জিএইচএফ বলছে, জাতিসংঘ গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ভুল আর বিভ্রান্তিকর তথ্য’ ব্যবহার করছে।
ডা. আবুতাহা আহ্বান জানিয়েছেন, ইসরায়েল যেন যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, ওষুধ আর জ্বালানি ঢুকতে দেয়, যাতে গাজার সবাই ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণ করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে।
তাঁর আশঙ্কা, মানুষকে হয়তো মিথ্যা আশা দেখানো হচ্ছে যে ইসরায়েল আর হামাস শিগগিরই নতুন যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাবে।
জাতিসংঘ বলছে, পুরো গাজাজুড়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি আর ২৮ জন জিম্মি মুক্তির চুক্তি কয়েক দিনের মধ্যেই হতে পারে।
কিন্তু ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা শুক্রবার রাতে বলেছেন, কাতারে চলা পরোক্ষ আলোচনা প্রায় ভেঙে পড়েছে। একদিকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে ইসরায়েলের টালবাহানা আর শর্তগুলো নিয়ে হামাসের আপত্তি। অন্যদিকে গাজার সব মানুষকে রাফার এক ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনা। এই দুই ইস্যু মিলিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ।
এদিকে ছেলেহারা মা ইমান কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, প্রতিদিন যুদ্ধবিরতির কথা শোনায়, কিন্তু কোথায় সেটা? ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে— না খাইয়ে, গুলি করে, বোমা ফেলে, বিমান হামলা চালিয়ে। আমরা কতভাবে মরেছি!
তিনি বলেন, ‘ওদের বেঁচে থাকার চেয়ে আল্লাহর কাছে চলে যাওয়াই ভালো। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিন’
(বিবিসিতে প্রকাশিত ডেভিড গ্রিটেনের প্রতিবেদন। অনুবাদ : সৈকত আমীন।)
আজ শনিবার (২৬ জুলাই) কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মালি সোচেতা সাংবাদিকদের জানান, নিহত ১২ জনের মধ্যে ৭ জন বেসামরিক নাগরিক ও ৫ জন সেনাসদস্য রয়েছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার থাই সেনাদের ছোড়া রকেটে বৌদ্ধ প্যাগোডায় আশ্রয় নেওয়া এক কম্বোডিয়ান নাগরিক নিহত হন।
১৭ ঘণ্টা আগেগতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) এক বিবৃতিতে আমুর অঞ্চলের গভর্নর ভাসিলি অরলভ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি এই ঘটনাকে ‘ভয়াবহ ট্র্যাজেডি’ আখ্যা দিয়ে পুরো অঞ্চলে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন।
১ দিন আগেপ্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ভবনটি দীর্ঘদিন ধরেই জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। এ বিষয়ে আগেই একাধিক অভিযোগ জানানো হয়েছিল।
২ দিন আগেফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির প্রেসিডন্টে ইমানুয়েল মাখোঁ গতকাল বৃহস্পতিবার এ ঘোষণা দেন। তাঁর ঘোষণার পরপরই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলসহ তাদের মিত্র দেশগুলো।
২ দিন আগে