leadT1ad

নেপালে জেন-জি বিক্ষোভ: ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক লড়াই

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৮
নেপালের জেন-জি বিক্ষোভ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বেকারত্ব ও দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে তরুণদের একটি জোরালো প্রতিবাদ। ছবি: সংগৃহীত

নেপাল বর্তমানে এক ভয়াবহ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে শুরু হওয়া জেন-জি নেতৃত্বাধীন গণবিক্ষোভে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। বিক্ষোভের মুখে মাত্র এক দিনের মাথায় ৯ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এর আগে আন্দোলনের চাপে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও পানি সরবরাহ মন্ত্রীও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নতুন সরকার আসার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনী দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হচ্ছেন—এরই মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন মূলত ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অলির শাসনামলে প্রস্তাবিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ বিল এবং হঠাৎ করে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তরুণদের মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে। অনেকেই এটিকে চীনের সেন্সরশিপ মডেলের অনুকরণ হিসেবে দেখেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নেপালের দীর্ঘদিনের রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতি (জিডিপির ৩৩ শতাংশ), উচ্চ বেকারত্ব (প্রায় ১০ শতাংশ) এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতির মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো।

প্রথম দর্শনে এই আন্দোলন নিছক দেশীয় যুবসমাজের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মনে হলেও এর পেছনে জটিল ভূরাজনৈতিক মাত্রাও সক্রিয় রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কে পি অলির প্রো-চীন নীতি ভারতের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল এবং তার পতনে ভারতের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। আবার, ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা নেপালের রাজপরিবারও এই আন্দোলনের সময় পরোক্ষভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে।

কে পি শর্মা অলির প্রো-চীন নীতি: অস্থিরতার স্ফুলিঙ্গ

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান কে পি শর্মা অলি তিন দফায় (২০১৫–১৬, ২০১৮–২১, ২০২৪–২৫) দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের প্রতি ঝোঁক স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা ভারতের কাছে একধরনের কূটনৈতিক ধাক্কা হিসেবে প্রতিভাত হয়।

নেপালে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নতুন প্রধানমন্ত্রী প্রথমে দিল্লি সফর করেন। কিন্তু অলি এই ধারা ভেঙে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং যান। একই বছর ডিসেম্বরে তাঁর সরকার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) যোগদানের জন্য একটি চুক্তি করেন এবং প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪১ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা নিশ্চিত করে। এর কিছুদিন পর অলি চীনের ‘ভিক্টরি ডে’ কুচকাওয়াজে অংশ নেন যা ভারতের জন্য একটি প্রতীকী বার্তা বহন করে।

অন্যদিকে, ১৮১৬ সালের সুগৌলি চুক্তির আলোকে অলি বারবার লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা—এই বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে নেপালের মালিকানা দাবি করে আসছিলেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে অলি প্রকাশ্যে বলেন, ‘লিপুলেখ নেপালের অংশ’—যদিও শি বিষয়টিকে ভারত-নেপাল দ্বিপাক্ষিক আলোচনার বিষয় বলে এড়িয়ে যান।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্যা ডিপ্লোমেটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, অলির এমন অবস্থান ভারত-নেপাল সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলেছে। দিল্লির ধারণা, নেপালের এই আগ্রাসী ভূ-রাজনৈতিক দাবিগুলো চীনের পরোক্ষ উৎসাহেই উত্থাপিত হচ্ছে, যার প্রধান লক্ষ্য হিমালয় অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমানো।

ভারতের ভূমিকা: প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ?

ভারত ঐতিহাসিকভাবে নেপালের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ও কৌশলগত সহযোগী। অলির চীনমুখী নীতি দিল্লির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এই আন্দোলনে ভারতের সরাসরি সম্পৃক্ততার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই, তবুও বিভিন্ন সূত্র, ইঙ্গিত ও অনলাইন প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্তত পরোক্ষ ভূমিকার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম এই বিক্ষোভকে চীনবিরোধী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। অলির পদত্যাগকে বেইজিংয়ের প্রভাব হ্রাস এবং ভারতের কৌশলগত জয় হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-সহ বেশকিছু গণমাধ্যম এই বিক্ষোভের কভারেজে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নেপালের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আবারও সক্রিয় করেছে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কমপ্যাক্টের (এমসিসি)-এর কার্যক্রম। এ এমসিসির আওতায় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই কার্যক্রম আবার সরাসরি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে ভারত স্বাগত জানিয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে এক্স ও রেড্ডিটে অনেক ভারতীয় ইউজার মন্তব্য করেছেন, ‘অলি যেহেতু প্রো-চীনা, আমাদের শুধু আনকেল স্যামের (যুক্তরাষ্ট্রের) সাহায্যের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়।’

‘ভারতের হাত’ বিতর্ক: নতুন কিছু নয়

নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’ সংক্রান্ত বিতর্ক পুরোনো। ২০০৬ সালের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সীমান্ত বিরোধ পর্যন্ত বহু ইস্যুতে ভারতের প্রভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অলির দিল্লি সফর এড়িয়ে যাওয়া এবং সীমান্ত নিয়ে তাঁর কড়া অবস্থানের ফলে ভারত-নেপাল সম্পর্ক একসময় তলানিতে পৌঁছে যায়।

ফলে, কে পি অলির পতনকে অনেক পর্যবেক্ষক কৌশলগতভাবে ভারতের জন্য লাভজনক মনে করছেন। ভারত সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে এখন একটি সমঝোতামূলক বা সম্ভাব্য ভারতপন্থী জোট সরকারের উত্থান আশা করছে।

তবে এ যাবৎ পাওয়া সব তথ্য ও বিশ্লেষণ সত্ত্বেও ভারতের সরাসরি অর্থায়ন বা সংগঠিত কোনো ভূমিকার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। বরং স্পষ্টভাবে বলা যায়, এই আন্দোলন তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শুরু হয়েছিল এবং এটি রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি স্বদেশি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

নেপালের প্রখ্যাত সাংবাদিক রমেশ ভুষাল স্ট্রিম পোর্টালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। কারণ এখন পর্যন্ত বাইরের কোনো করপোরেট বা রাষ্ট্রীয় ভূমিকা চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু এটাও সত্য যে, ভারত ও চীনের মাঝে অবস্থিত হওয়ার কারণে নেপালে একধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সব সময়ই থাকে।’

রাজপরিবার ও ভারতের সংযোগ: অদৃশ্য প্রভাব?

২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হলেও, সাবেক রাজপরিবার এখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে একটি আলোচিত ও প্রভাবশালী শক্তি। সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ চলমান বিক্ষোভে নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন এবং সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও আন্দোলনকে সরাসরি সমর্থন করেননি।

এর আগে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে কয়েক হাজার মানুষের অংশগ্রহণে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করার দাবিতে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে নেপালের রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে শাহ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, এবং তিনি প্রকাশ্যে নেপালের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে মন্তব্য করেছেন।

যদিও জেন-জি আন্দোলন মূলত প্রজাতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও দুর্নীতিবিরোধী চরিত্রের, তথাপি ভারতের সঙ্গে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক সংযোগ অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগিয়েছে—এই বিক্ষোভের পেছনে কি কোনো অদৃশ্য শক্তি সক্রিয়?

ক্ষোভকে তীব্র করেছে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব

নেপালের জেন-জি বিক্ষোভ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বেকারত্ব ও দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে তরুণদের একটি জোরালো প্রতিবাদ। তবে কে পি শর্মা অলির চীনঘেঁষা নীতির কারণে তাঁর পদত্যাগ একে দেশের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ থেকে বের করে এনে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছে। ফলে এই বিক্ষোভকে আর কেবল একটি দেশীয় আন্দোলন হিসেবে দেখা যাচ্ছে না।

ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র—তিনটি পরাশক্তির আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার মাঝে নেপাল বর্তমানে একটি কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। তবে এই অস্থির প্রেক্ষাপটেও স্পষ্টভাবে বলা যায়: নেপালের জেন-জি আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক দুর্দশা ও তরুণ সমাজের ভরসাহীনতা। আন্তর্জাতিক কৌশলগত দ্বন্দ্ব সেই ক্ষোভকে কেবল আরও তীব্র করে তুলেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত