আজকাল ‘ইন্ট্রোভার্ট’ শব্দটা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনেকে জানান দেয়, ‘আমি ইন্ট্রোভার্ট’। এমনকি একটু চুপচাপ মানুষ দেখলেও বন্ধু-বান্ধবরা বলে ওঠে, ‘এ তো একদম ইন্ট্রোভার্ট।’ তখন প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে, এত মানুষ কি সত্যিই ইন্ট্রোভার্ট? আমরা কি নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবতে ভালোবাসি? নাকি এটা সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ট্রেন্ড?
আমরা অনেকেই কেন নিজের ওপর এমন ধরনের লেবেল দিতে ভালোবাসি? কারণ খুব সহজ। গবেষণা বলছে, মানুষ নিজের আচরণকে একটা সহজ ব্যাখায় রাখতে চায়। যেমন কেউ একা থাকতে পছন্দ করলে বা বড় গ্রুপে অস্বস্তি হলে সে ভাবে, ‘এটা আমার সমস্যা না, আমার টাইপই এটা।’ এই এক কথায় ব্যাখাটা অনেককেই স্বস্তি দেয়।
‘ইন্ট্রোভার্ট’ ট্রেন্ড, ব্যাখা আর ভুল ধারণা
এখন সত্যিটা হলো, মনোবিজ্ঞানে ‘ইন্ট্রোভারশন’ বলে একটি স্বীকৃত ধারণা আছে। এটা কোনো অলীক থিওরি নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে শব্দটির মানে অনেকটাই বদলে গেছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখায় ইন্ট্রোভার্ট মানে শুধু চুপচাপ থাকা মানুষ নয়। বরং যারা একা সময় কাটিয়ে প্রাণবন্ত হয়, খুব বেশি সামাজিকতা যাদের ক্লান্ত করে, দীর্ঘসময় ভিড়ে থাকলে মানসিক চাপ বাড়ে—তাঁরাই ‘ইন্ট্রোভার্ট’। এটা ব্যক্তিত্বের একটি দিক।
কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? আমাদের সমাজে চুপচাপ থাকা মানুষকে আগে বলা হতো ‘লাজুক’, ‘চুপচাপ’, ‘নিজের মতো থাকে’। কিন্তু নামটা এখন বদলে গেছে। অন্তর্মুখী আচরণ দেখলেই ইন্ট্রোভার্ট ঘোষণা দেয়া হয়।
অনেকে আবার ভাবে ইন্ট্রোভার্ট মানেই বুদ্ধিমান, গভীর চিন্তাভাবনা করে, অন্যদের থেকে আলাদা। এই ব্যাখাটা কতটা সত্যি? পুরোপুরি না। কারণ বুদ্ধিমত্তা বা গভীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে ইন্ট্রোভার্ট হওয়া বা এক্সট্রোভার্ট হওয়া দুটোরই সরাসরি সংযোগ নেই। কিন্তু যেহেতু অনেক জনপ্রিয় চরিত্র, শিল্পী বা লেখকদের ‘ইন্ট্রোভার্ট’ বলা হয়, তাই লেবেলটাও জনপ্রিয় হয়ে গেছে।
এখানেই আসে ‘ট্রেন্ড’-এর ব্যাপারটা। গত এক দশকে ব্যক্তিত্ব নিয়ে পরিচয় খোঁজার ঢেউ উঠেছে। ‘পারসোনালিটি কুইজ’, ‘হোয়াট টাইপ আর ইউ’ ধরনের কনটেন্টগুলো ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। এগুলো মানুষকে নিজেদের মতো গল্প বেছে নিতে সাহায্য করে। যেমন এমন ধারণা আমাদের আছে ইন্ট্রোভার্টরা বেশি সেন্সিটিভ—তখন অনেকেই ভাবে, ‘আরে, এ তো আমার মতোই!’ আসলে মানুষের আচরণ খুব জটিল, কিন্তু এই ধরনের লেবেল সবকিছুকে খুব সহজ করে দেয়। আর আমরা সহজ ব্যাখা ভালোবাসি।
ইন্ট্রোভার্ট মানেই ‘সোশ্যাল অ্যানজাইটি’ নয়। সংগৃহীত ছবিঅনেকে কি ভুল করে নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবে?
না, মোটেই না। বরং অনেক মানুষ সত্যিই অন্তর্মুখী, কিন্তু তাঁরা আগে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারতো না। যেমন বাংলাদেশি পরিবারে চুপচাপ থাকা মানে ছিল ‘লাজুক’ বা ‘দুর্বল’। এখন মানুষ বুঝতে পারছে, এটা ব্যক্তিত্বের অংশ। তাই অনেকে আরও খোলামেলা ভাবে বলতে পারছে, তাঁরা বড় ভিড়ে অস্বস্তি বোধ করে, একা থাকতে ভালোবাসে, নিজের ভাবনা নিজের ভেতরেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এটা মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে একেবারেই স্বাভাবিক।
কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন কেউ ভেবেই নেয়, ‘আমি ইন্ট্রোভার্ট, তাই আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলবো না।’ আবার কেউ কেউ কাজের চাপ, স্ট্রেস, হতাশা বা সামাজিক ব্যর্থতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে, আর ধরে নেয়, ‘আই অ্যাম জাস্ট অ্যান ইন্ট্রোভার্ট।’ অথচ আসল কারণটা হয়তো মানসিক চাপ বা ক্লান্তি, যা ইন্ট্রোভারশনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না-ও হতে পারে। তাই নিজেকে বোঝার জন্য লেবেল গ্রহণ করা ঠিক আছে, কিন্তু নিজের আচরণের সব ব্যাখা যেন এই এক শব্দের ওপর নির্ভর না করে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটা মজার বিষয় হলো, অনেকেই ভাবে ইন্ট্রোভার্ট মানেই ‘সোশ্যাল অ্যানজাইটি’। আসলে দুটো আলাদা। কেউ চুপচাপ থাকতে পারে স্বভাবগত কারণে। আর কেউ মানুষজনের সামনে গেলে ভয় পায়, এটা অ্যানজাইটি।
কেন এত মানুষ নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবতে ভালোবাসে?
হতে পারে এটা এখন এক ধরনের ‘সেফ আইডেন্টিটি’। আধুনিক সমাজের সবচেয়ে বড় চাপ হলো, সবাইকে সবসময় মিশুক, হাসিখুশি, পারফরম্যান্স-রেডি থাকতে হবে। এই চাপের বাইরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে মানুষ বলতে চায়, ‘আমি অন্যরকম, আমি নিজের মতো।’ অনুপম রায়ের গানের মতো, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’
অবশেষে সত্যিটা দাঁড়ায়, ইন্ট্রোভার্ট হওয়া একদিকে যেমন মনোবিজ্ঞানের বিষয়, অন্যদিকে এটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ট্রেন্ড আর ভুল ধারণা। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই নিজের আচরণ নিয়ে সচেতন হয়, বোঝে কেন সে একা থাকতে ভালোবাসে, কেন ভিড়ে ক্লান্ত লাগে, তাহলে এই লেবেল তাঁকে সাহায্য করতে পারে। আর যদি কেউ শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট দেখে নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবে, তাহলে ভুল বোঝারও সম্ভাবনা থাকে।
শেষ পর্যন্ত মানুষ জটিল। একটা শব্দ দিয়ে পুরো মানুষকে বোঝা যায় না। কিন্তু সেই শব্দ যদি কাউকে নিজের মতো থাকতে সাহস দেয়, তাহলে হয়তো শব্দটারও একটা ভূমিকা আছে। তবে নিজের আচরণ বুঝতে হলে ট্রেন্ডের ওপর না গিয়ে নিজের ভেতরের কথাগুলো শোনা, নিজের অনুভূতি চেনাটাই আসল।