leadT1ad

১৯৭১: চীন যে কারণে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল

স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭১ সালে বিশ্ব ছিল স্নায়ু যুদ্ধের টানাপোড়েনে ঝুঁকিপূর্ণ এক অবস্থায়। বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো তখন পৃথিবীজুড়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দাবা খেলায় লিপ্ত ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ এক গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছিল। বহুদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের দমন-পীড়নের শিকার বাঙালি জনগণ স্বাধীনতার দাবি তোলে। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

এতে ভারত কৌশলগত সুযোগ দেখতে পায়। তাই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে এবং পরে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারত যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। এই সময় পটভূমিতে ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি—চীন। উদীয়মান এই শক্তি তখন নিছক কোনো দর্শক ছিল না। পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেশটিকে তারা কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে সহায়তা দেয়। তবে চীন শেষ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। কারণ তারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেশি উত্তেজিত করতে চায়নি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চীনের এই অবস্থান মূলত স্নায়ু যুদ্ধের ভূ-রাজনীতি, পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে ছিল, কারণ পাকিস্তানের মাধ্যমে তাদের চীনের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হচ্ছিল।

১৯৬০-এর দশক থেকেই চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব বজায় রাখছিল। চীনের দৃষ্টিতে পাকিস্তান ছিল ভারতের শক্তি কমানোর কৌশলগত হাতিয়ার এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ পথ। ভারত-চীন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ জন ডব্লিউ গার্ভারের মতে, চীন পাকিস্তানকে দেখত ‘অপরিহার্য কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে। আর ভারতকে দেখত ‘সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ এক বৈরী শক্তি’ হিসেবে।

মার্কিন ইতিহাসবিদ গ্যারি জোনাথান ব্যাস তাঁর ‘দ্য ব্লাড ট্রেলিগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘চীন দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল।’ ব্যাস আরও উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি জেনারেলরা বিশ্বাস করতেন, ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ করলে চীন সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে। কারণ বেইজিং আগে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিল।

চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখেছিল। তাই তারা পাল্টা কৌশল হিসেবে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। এমনকি যুদ্ধের পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও দীর্ঘ সময় নেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদের প্রস্তাবে ভেটো দেয়। আর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালে।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, শেখ মুজিবের শাসনামলে চীন সচেতনভাবেই স্বীকৃতি দেয়নি কারণ তারা মুজিব সরকারকে ‘ভারত ও রাশিয়ার প্রভাবাধীন’ মনে করত। ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরেই বেইজিং তাদের নীতি পরিবর্তন করে।

জোট, শত্রুতা ও স্নায়ু যুদ্ধের টানাপোড়েন

চীনের অবস্থান স্নায়ু যুদ্ধের বাস্তবতা দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উদীয়মান সম্পর্ক এতে বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৬০-এর দশকে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। মাও সেতুং সোভিয়েত নীতিকে ‘বিপথগামীতা’ এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভ্রান্ত ধারণা’ বলে সমালোচনা করেন।

এদিকে ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠে। তাই চীনের কাছে পাকিস্তানকে সমর্থন করা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। একে তারা ভারত-সোভিয়েত জোট মোকাবিলার প্রধান উপায় হিসেবে দেখত। ১৯৭১ সালের আগস্টে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি চীনের উদ্বেগ আরও বাড়ায়। এই চুক্তি ভারতকে সোভিয়েত সামরিক সমর্থনের নিশ্চয়তা দেয়। এতে চীন আর পুনরায় ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে সাহস পায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তখন তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, তাই দুই-ফ্রন্টে সংঘাতে জড়ানোর ঝুঁকি চীন নিতে পারেনি।

অন্যদিকে, ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে চীনও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা গড়ে তোলে। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা মূলত ভারতের বিরুদ্ধে অভিন্ন বিরোধিতা থেকে জন্ম নেয়। ফলে পরবর্তী সময়ে যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে, চীন তা সমর্থন করেনি। বেইজিং মনে করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে দুর্বল করা এবং দক্ষিণাঞ্চলে চীনের কৌশলগত অবস্থানকে ঘিরে ফেলা। মাও সেতুং সেসময় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘চীনবিরোধী’ বলে উল্লেখ করেন এবং বিদ্রোহকে বিদেশি শক্তির প্ররোচিত আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেন।

স্নায়ু যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। পাকিস্তান তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের গোপন যোগাযোগের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছিল। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের ১৯৭১ সালের গোপন বেইজিং সফর পাকিস্তানের মাধ্যমেই সম্ভব হয়, যা পরবর্তীতে চীন-মার্কিন সম্পর্ক পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করা চীনের পক্ষে কল্পনাতীত ছিল।

পাকিস্তানের প্রতি সহায়তা ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি

চীন সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ না নিলেও পাকিস্তানকে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়। ষাটের দশকের দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ভিত্তিতে পাকিস্তান টাইপ-৫৯ ট্যাঙ্ক, এফ-৬ ফাইটার বিমানসহ নানা সরঞ্জাম পায়।

কূটনৈতিক মঞ্চেও চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার পর চীন এই মঞ্চকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করে। জাতিসংঘে ভারতকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে অভিযুক্ত করে এবং যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।

তারা গণহত্যার খবর গোপন করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতোই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উপেক্ষা করে যায়। চীনা কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে গুরুতর পরিণতি হবে।’ তাদের ভাষ্যে এই সংঘাত ছিল ভারত-সোভিয়েত মহলের ‘সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র।’

তবে চীন কঠোর ভাষায় হুমকি দিলেও সরাসরি যুদ্ধে নামেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীনকে ভারত সীমান্তে সামরিক চাপ সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করলেও চীন তা করেনি। চীন কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি হিসাব কষে চলে। স্নায়ু যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চীন তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপরীত্য দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা ও কর্মী ছিলেন ‘পিকিংপন্থী’ বা মাওবাদী ধ্যানধারার প্রতি সহানুভূতিশীল। তবুও চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। কারণ তারা তাদের কৌশলগত সোভিয়েতবিরোধী নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়।

যুদ্ধ-পরবর্তী দুর্বল পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পুনর্গঠনেও চীন সক্রিয় ভূমিকা নেয়। ১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর চীন পাকিস্তানকে আরও নিরাপত্তা-আশ্বাস দেয়। চীনের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল।

ভূরাজনীতির কাছে মানবিকতার পরাজয়

ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিকদের মতে, চীনের আচরণ ছিল বাস্তববাদী কৌশলের নিখুঁত উদাহরণ। চীন নিজের জাতীয় স্বার্থকেই প্রধান্য দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া তারা সেই স্বার্থ অর্জন করতে পারবে না, এ বিষয়টিও তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। তাই চীন পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয়ের পথ বেছে নেয়। ফলে না চীন, না যুক্তরাষ্ট্র, কোনো দেশই ইতিহাসের নৈতিক অবস্থানের পাশে দাঁড়ায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার কলেজের এক বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয় যে মাও সেতুং ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে দেখতেন এবং ভারতের পরিচালিত আন্দোলন বলে মনে করতেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘চীনবিরোধী’ হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কৌশল ছিল ভারতকে ঘিরে রাখার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে জোট গড়ে তোলা।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চীনের ভূমিকা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একদিকে তারা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার মতো সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে গণহত্যার নৃশংসতা উপেক্ষা করেছে। এর পাশাপাশি কূটনৈতিক মঞ্চে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে কৌশল প্রয়োগ করেছে। আজও যখন চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান, তখন ১৯৭১ সালের এই অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেয়, ভূ-রাজনীতিতে স্বার্থের বন্ধন দীর্ঘস্থায়ী হলেও মানবিকতার জায়গা প্রায়ই পিছিয়ে পড়ে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত