মাহবুবুল আলম তারেক

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল সুপরিকল্পিত কৌশলগত স্বার্থরক্ষার এক নির্মম উদাহরণ। সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে স্নায়ুযুদ্ধের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট যখন সহিংসতায় রূপ নেয় এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার কঠোর ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
শুরুর দিকে নিক্সন প্রশাসন নিজেদের সীমিতভাবে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের ভাষ্য ছিল, ‘আমরা আমাদের আলোচ্য কর্মসূচিতে আরেকটি জটিলতা যোগ করতে চাই না।’ কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত সামরিক দমন-পীড়নে রূপ নিলে এবং আন্তর্জাতিক নিন্দা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র ‘দ্য টিল্ট’ (একপেশে নীতি) নামে পরিচিত নীতি গ্রহণ করে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি সহানুভূতি ছিল না; বরং স্নায়ুযুদ্ধের বৃহত্তর লক্ষ্য—সোভিয়েত প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের সঙ্গে গোপন কূটনৈতিক সংযোগ স্থাপনই ছিল প্রধান বিবেচনা। পাকিস্তান ছিল এই মার্কিন-চীন সংযোগের মূল মধ্যস্থতাকারী।
এই নীতি প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি কঠোর অগ্রাধিকার কাঠামো ছিল। আঞ্চলিক স্থিতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে একেবারে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল চীন-সোভিয়েত বিরোধকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে। এতে এক নির্মম পরিহাসও ছিল—নিজেকে ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা দাবি করা যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে সমর্থন দিচ্ছিল, যারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল। বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে চিঠি দিয়ে রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানায় এবং কৌশলগত কারণে ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা বাড়ে।
‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইয়ের লেখক গ্যারি জে ব্যাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একধরনের ‘নৈতিক অন্ধত্ব’ দেখিয়েছিল। তারা সচেতনভাবে ও সক্রিয়ভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ইসলামাবাদের দমনমূলক নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করেছিল। কিসিঞ্জার ও নিক্সন পরিস্থিতিকে কেবল কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। তাদের নীতির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ।
‘দ্য টিল্ট’ নীতির কেন্দ্রে ছিল পাকিস্তানের বিশেষ ভূমিকা। নিক্সনের ঐতিহাসিক চীন সংযোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে দরকার ছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চাক্ষুষ ইয়াহিয়া খান গোপন আলোচনার পথ খুলে দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার বেইজিং সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, এই সংযোগ অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি। কারণ, এটি বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে।
হেনরি কিসিঞ্জার এই নীতির যুক্তি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও পরাজয় আসবে। কিন্তু তবুও আমরা যা করার ছিল, তা করেছি। এবং চীন তা বুঝবে।’ যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে শুধু একটি মিত্রদেশ হিসেবেই নয়, বরং চীনের কাছে নিজেদের আস্থাভাজন হিসেবে প্রমাণ করার মাধ্যম হিসেবে দেখেছিল।
ব্যক্তিগত বিষয়ও মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করেছিল। রিচার্ড নিক্সনের জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি অস্বস্তি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে আরও পক্ষপাতমূলক করে তোলে। কিসিঞ্জারের শক্তির রাজনীতির প্রতি ঝোঁক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে আরও কঠোর করে। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার হিচেন্স কিসিঞ্জারের এই ভূমিকাকে ‘প্রতারণাপূর্ণ কূটনীতি’ বলে সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করার কথাও বিবেচনা করেছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিক্রিয়া জানালে চীনকে রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। ফলে আঞ্চলিক সংকট বৈশ্বিক সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সামরিক দমন-পীড়নের প্রকাশ্য নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করা হয়েছিল, নিক্সন প্রশাসন তৃতীয় দেশের মাধ্যমে মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানোর অনুমতি দেয়। কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে জর্ডান ও ইরানের মতো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র-নির্মিত যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের হাতে পৌঁছে যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের অভিযানে (অপারেশন সার্চলাইট) সংঘটিত হয় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ এবং বাঙালি হিন্দু ও বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে নিপীড়ন। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা গণহত্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে হতবাক হয়ে পড়েন।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল তাঁরা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ শিরোনামে বার্তা পাঠান। এর ভাষা ছিল অত্যন্ত কঠোর—‘আমাদের সরকার গণতন্ত্রের দমনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে...আমাদের সরকার নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রদর্শন করেছে।’ তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’ বা ‘বেছে বেছে চালানো গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেন। কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এই চিঠিতে পূর্ণ সমর্থন দেন, এটা জেনেও যে এতে তাঁর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন কমানোর আহ্বান জানান। কিন্তু উভয়কেই কার্যত সরিয়ে দেওয়া হয়। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য হ্যারল্ড স্যান্ডার্স কিসিঞ্জারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করলে গণহত্যা এড়ানো সম্ভব।’
সরকারের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সুশীল সমাজ মানবিক সংকট নিয়ে সরব ছিল। আমেরিকান চিকিৎসক জন ই রোড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, বোমাবর্ষণের জন্য যুদ্ধবিমান উঠছে। লজ্জা ও ক্ষোভে মাথা নত হয়ে আসে, কারণ এসব অস্ত্র মূলত আমাদের দেশের দেওয়া।’
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশকে যে সমর্থন দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের নিজের সক্ষমতার চেয়েও বেশি ছিল। সিনেটর টেড কেনেডির মতো ব্যক্তিরা পাকিস্তানের প্রতি সহায়তা স্থগিত করার দাবি তোলেন।
কিন্তু ওয়াশিংটন এই ভিন্নমত উপেক্ষা করে। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত লক্ষ্যের সামনে নৈতিকতা, মানবাধিকার এবং বাস্তব তথ্যকে তুচ্ছ করা হয়। ইতিহাসবিদ গ্যারি ব্যাস মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ‘নৈতিক দায়’ রয়েছে ক্ষমা প্রার্থনার। কারণ, এই নীতি ছিল ‘নিষ্ঠুর এবং হিতে বিপরীত।’ এই নীরবতা নিরপেক্ষ ছিল না—এটি কার্যত গণহত্যা চালানো এক সামরিক শাসনকে রক্ষা করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও সহায়তার নীতিগত ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পাকিস্তানকে সমর্থন জারি রাখে। ২৫ মার্চের পর নতুন প্রাণঘাতী অস্ত্র ও লাইসেন্স স্থগিত করা হয়, তবে ১৯৬৫ সালের মতো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। এতে কংগ্রেস ও ভারতের বিরক্তি প্রশমিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানও সম্পূর্ণভাবে বিমুখ হয়নি।
ভারত যখন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দেয় এবং ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে টাস্কফোর্স-৭৪ মোতায়েনের মাধ্যমে। ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ ও টাস্কফোর্স-৭৪ গঠনের নির্দেশ দেয় এবং সেটি বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ১৪-১৫ ডিসেম্বর নাগাদ এটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি পৌঁছায়। এই পদক্ষেপকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘উদ্ধার অভিযান’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে এটি ছিল ভারতকে সতর্ক করা এবং চীনের প্রতি সংহতি দেখানোর কূটনৈতিক বার্তা।
এই পদক্ষেপ সোভিয়েত নৌবহরের পাল্টা সক্রিয়তা সৃষ্টি করে। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর অনুসরণ করতে থাকে, যা সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে পারেনি, তবুও এটি পাকিস্তান ও চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর আগ্রাসনের অভিযোগ তোলে এবং প্রায় এক কোটি ভুক্তভোগীর ভার বহনকারী শরণার্থী সংকটকে ভারতীয় নীতির ফল বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য ৯১ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা এবং পাকিস্তান সরকারকে ১৫৮ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দিলেও তা ছিল বৈপরীত্যে ভরা। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে শরণার্থীদের জন্য সহায়তা দিচ্ছিল, অন্যদিকে গণহত্যার জন্য দায়ী সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখছিল। মূল নীতি ছিল ‘নীরব কূটনীতি’, যেখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ এড়িয়ে চলা হয়।
১৯৭১ সালের আগস্টে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এমন প্রস্তাব সমর্থন করে, যাতে ভারত ও আওয়ামী লীগের অবস্থান প্রতিফলিত হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলে এবং ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো এসব প্রস্তাব আটকে দেয়, ফলে ভারত ও মুক্তিবাহিনী ঢাকায় অগ্রসর হওয়ার সময় পায়।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে। সেশনটি ছিল নাটকীয়। ১৫ ডিসেম্বর পোলিশ প্রস্তাব (যুদ্ধবিরতি ও ক্ষমতা হস্তান্তর) প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন কক্ষে নথি ছিঁড়ে নাটকীয়ভাবে বেরিয়ে যান। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং ২১ ডিসেম্বর প্রস্তাব-৩০৭ গৃহীত হয়। হোয়াইট হাউসের পক্ষপাতী নীতি পররাষ্ট্র দপ্তরের শান্তি প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পক্ষপাতদুষ্ট শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দেন এবং নিক্সন তা অনুমোদন করেন। কিন্তু ‘দ্য টিল্ট’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাকিস্তান মনে করে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সমর্থন দেয়নি, আর ভারত ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানপন্থী অবস্থানে।
এর ফলে ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত হিসাব জটিল হয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি ছিল এক ‘দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত ব্যর্থতা’—যেখানে স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত লাভের জন্য নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এই নীতি দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করে এবং ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও গভীর করে।
১৯৭১ সালের সংকট বাস্তব রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এবং তার মানবিক মূল্য কী হতে পারে, তা দেখায়। চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ার আশায় যুক্তরাষ্ট্র কার্যত এক গণহত্যাকে সহায়তা করে। এতে নৈতিক নেতৃত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক মজবুত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য পাল্টে যায়। এই ঘটনাবলি প্রমাণ করে, মানবাধিকার ও নৈতিক বিবেচনাকে উপেক্ষা করে পরিচালিত কূটনীতি শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ও নৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল সুপরিকল্পিত কৌশলগত স্বার্থরক্ষার এক নির্মম উদাহরণ। সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে স্নায়ুযুদ্ধের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট যখন সহিংসতায় রূপ নেয় এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার কঠোর ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
শুরুর দিকে নিক্সন প্রশাসন নিজেদের সীমিতভাবে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের ভাষ্য ছিল, ‘আমরা আমাদের আলোচ্য কর্মসূচিতে আরেকটি জটিলতা যোগ করতে চাই না।’ কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত সামরিক দমন-পীড়নে রূপ নিলে এবং আন্তর্জাতিক নিন্দা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র ‘দ্য টিল্ট’ (একপেশে নীতি) নামে পরিচিত নীতি গ্রহণ করে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি সহানুভূতি ছিল না; বরং স্নায়ুযুদ্ধের বৃহত্তর লক্ষ্য—সোভিয়েত প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের সঙ্গে গোপন কূটনৈতিক সংযোগ স্থাপনই ছিল প্রধান বিবেচনা। পাকিস্তান ছিল এই মার্কিন-চীন সংযোগের মূল মধ্যস্থতাকারী।
এই নীতি প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি কঠোর অগ্রাধিকার কাঠামো ছিল। আঞ্চলিক স্থিতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে একেবারে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল চীন-সোভিয়েত বিরোধকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে। এতে এক নির্মম পরিহাসও ছিল—নিজেকে ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা দাবি করা যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে সমর্থন দিচ্ছিল, যারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল। বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে চিঠি দিয়ে রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানায় এবং কৌশলগত কারণে ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা বাড়ে।
‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইয়ের লেখক গ্যারি জে ব্যাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একধরনের ‘নৈতিক অন্ধত্ব’ দেখিয়েছিল। তারা সচেতনভাবে ও সক্রিয়ভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ইসলামাবাদের দমনমূলক নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করেছিল। কিসিঞ্জার ও নিক্সন পরিস্থিতিকে কেবল কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। তাদের নীতির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ।
‘দ্য টিল্ট’ নীতির কেন্দ্রে ছিল পাকিস্তানের বিশেষ ভূমিকা। নিক্সনের ঐতিহাসিক চীন সংযোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে দরকার ছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চাক্ষুষ ইয়াহিয়া খান গোপন আলোচনার পথ খুলে দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার বেইজিং সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, এই সংযোগ অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি। কারণ, এটি বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে।
হেনরি কিসিঞ্জার এই নীতির যুক্তি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও পরাজয় আসবে। কিন্তু তবুও আমরা যা করার ছিল, তা করেছি। এবং চীন তা বুঝবে।’ যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে শুধু একটি মিত্রদেশ হিসেবেই নয়, বরং চীনের কাছে নিজেদের আস্থাভাজন হিসেবে প্রমাণ করার মাধ্যম হিসেবে দেখেছিল।
ব্যক্তিগত বিষয়ও মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করেছিল। রিচার্ড নিক্সনের জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি অস্বস্তি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে আরও পক্ষপাতমূলক করে তোলে। কিসিঞ্জারের শক্তির রাজনীতির প্রতি ঝোঁক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে আরও কঠোর করে। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার হিচেন্স কিসিঞ্জারের এই ভূমিকাকে ‘প্রতারণাপূর্ণ কূটনীতি’ বলে সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করার কথাও বিবেচনা করেছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিক্রিয়া জানালে চীনকে রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। ফলে আঞ্চলিক সংকট বৈশ্বিক সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সামরিক দমন-পীড়নের প্রকাশ্য নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করা হয়েছিল, নিক্সন প্রশাসন তৃতীয় দেশের মাধ্যমে মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানোর অনুমতি দেয়। কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে জর্ডান ও ইরানের মতো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র-নির্মিত যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের হাতে পৌঁছে যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের অভিযানে (অপারেশন সার্চলাইট) সংঘটিত হয় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ এবং বাঙালি হিন্দু ও বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে নিপীড়ন। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা গণহত্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে হতবাক হয়ে পড়েন।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল তাঁরা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ শিরোনামে বার্তা পাঠান। এর ভাষা ছিল অত্যন্ত কঠোর—‘আমাদের সরকার গণতন্ত্রের দমনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে...আমাদের সরকার নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রদর্শন করেছে।’ তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’ বা ‘বেছে বেছে চালানো গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেন। কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এই চিঠিতে পূর্ণ সমর্থন দেন, এটা জেনেও যে এতে তাঁর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন কমানোর আহ্বান জানান। কিন্তু উভয়কেই কার্যত সরিয়ে দেওয়া হয়। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য হ্যারল্ড স্যান্ডার্স কিসিঞ্জারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করলে গণহত্যা এড়ানো সম্ভব।’
সরকারের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সুশীল সমাজ মানবিক সংকট নিয়ে সরব ছিল। আমেরিকান চিকিৎসক জন ই রোড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, বোমাবর্ষণের জন্য যুদ্ধবিমান উঠছে। লজ্জা ও ক্ষোভে মাথা নত হয়ে আসে, কারণ এসব অস্ত্র মূলত আমাদের দেশের দেওয়া।’
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশকে যে সমর্থন দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের নিজের সক্ষমতার চেয়েও বেশি ছিল। সিনেটর টেড কেনেডির মতো ব্যক্তিরা পাকিস্তানের প্রতি সহায়তা স্থগিত করার দাবি তোলেন।
কিন্তু ওয়াশিংটন এই ভিন্নমত উপেক্ষা করে। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত লক্ষ্যের সামনে নৈতিকতা, মানবাধিকার এবং বাস্তব তথ্যকে তুচ্ছ করা হয়। ইতিহাসবিদ গ্যারি ব্যাস মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ‘নৈতিক দায়’ রয়েছে ক্ষমা প্রার্থনার। কারণ, এই নীতি ছিল ‘নিষ্ঠুর এবং হিতে বিপরীত।’ এই নীরবতা নিরপেক্ষ ছিল না—এটি কার্যত গণহত্যা চালানো এক সামরিক শাসনকে রক্ষা করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও সহায়তার নীতিগত ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পাকিস্তানকে সমর্থন জারি রাখে। ২৫ মার্চের পর নতুন প্রাণঘাতী অস্ত্র ও লাইসেন্স স্থগিত করা হয়, তবে ১৯৬৫ সালের মতো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। এতে কংগ্রেস ও ভারতের বিরক্তি প্রশমিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানও সম্পূর্ণভাবে বিমুখ হয়নি।
ভারত যখন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দেয় এবং ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে টাস্কফোর্স-৭৪ মোতায়েনের মাধ্যমে। ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ ও টাস্কফোর্স-৭৪ গঠনের নির্দেশ দেয় এবং সেটি বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ১৪-১৫ ডিসেম্বর নাগাদ এটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি পৌঁছায়। এই পদক্ষেপকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘উদ্ধার অভিযান’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে এটি ছিল ভারতকে সতর্ক করা এবং চীনের প্রতি সংহতি দেখানোর কূটনৈতিক বার্তা।
এই পদক্ষেপ সোভিয়েত নৌবহরের পাল্টা সক্রিয়তা সৃষ্টি করে। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর অনুসরণ করতে থাকে, যা সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে পারেনি, তবুও এটি পাকিস্তান ও চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর আগ্রাসনের অভিযোগ তোলে এবং প্রায় এক কোটি ভুক্তভোগীর ভার বহনকারী শরণার্থী সংকটকে ভারতীয় নীতির ফল বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য ৯১ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা এবং পাকিস্তান সরকারকে ১৫৮ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দিলেও তা ছিল বৈপরীত্যে ভরা। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে শরণার্থীদের জন্য সহায়তা দিচ্ছিল, অন্যদিকে গণহত্যার জন্য দায়ী সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখছিল। মূল নীতি ছিল ‘নীরব কূটনীতি’, যেখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ এড়িয়ে চলা হয়।
১৯৭১ সালের আগস্টে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এমন প্রস্তাব সমর্থন করে, যাতে ভারত ও আওয়ামী লীগের অবস্থান প্রতিফলিত হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলে এবং ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো এসব প্রস্তাব আটকে দেয়, ফলে ভারত ও মুক্তিবাহিনী ঢাকায় অগ্রসর হওয়ার সময় পায়।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে। সেশনটি ছিল নাটকীয়। ১৫ ডিসেম্বর পোলিশ প্রস্তাব (যুদ্ধবিরতি ও ক্ষমতা হস্তান্তর) প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন কক্ষে নথি ছিঁড়ে নাটকীয়ভাবে বেরিয়ে যান। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং ২১ ডিসেম্বর প্রস্তাব-৩০৭ গৃহীত হয়। হোয়াইট হাউসের পক্ষপাতী নীতি পররাষ্ট্র দপ্তরের শান্তি প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পক্ষপাতদুষ্ট শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দেন এবং নিক্সন তা অনুমোদন করেন। কিন্তু ‘দ্য টিল্ট’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাকিস্তান মনে করে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সমর্থন দেয়নি, আর ভারত ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানপন্থী অবস্থানে।
এর ফলে ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত হিসাব জটিল হয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি ছিল এক ‘দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত ব্যর্থতা’—যেখানে স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত লাভের জন্য নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এই নীতি দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করে এবং ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও গভীর করে।
১৯৭১ সালের সংকট বাস্তব রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এবং তার মানবিক মূল্য কী হতে পারে, তা দেখায়। চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ার আশায় যুক্তরাষ্ট্র কার্যত এক গণহত্যাকে সহায়তা করে। এতে নৈতিক নেতৃত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক মজবুত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য পাল্টে যায়। এই ঘটনাবলি প্রমাণ করে, মানবাধিকার ও নৈতিক বিবেচনাকে উপেক্ষা করে পরিচালিত কূটনীতি শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ও নৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

সময় : ১৯৭২ সালের এক অবসন্ন দুপুর। স্থান : ঢাকার একটি বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোর শেষে বাবা আর মেয়ের পুনর্মিলন ঘটেছে। মেয়ে কান্নার প্রবল আবেগ সামলে দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। গত এক বছরে সবকিছুই অনেক বদলেছে, বাবাও। তিনি যেন আরও বুড়ো হয়ে গেছেন।
১ ঘণ্টা আগে
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয়েছিল, সেটি গালফস্ট্রিম জি-১০০ সিরিজের একটি প্রাইভেট জেট। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কী কী সুবিধা থাকে?
২ ঘণ্টা আগে
গারো সম্প্রদায়ের সেই তিন অকুতোভয় নারী—ভেরেনিকা সিসংমা, সন্ধ্যারানী সাংমা এবং তুশি হাগিদক। তাদের হাতে কোনো স্টেনগান ছিল না, কিন্তু তারা একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্যে যে যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন, সেটিও কোনো অংশে কম ছিল না।
৯ ঘণ্টা আগে
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা আমরা সবাই জানি; কিন্তু লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ‘গুডবাই সামার’ কনসার্টের কথা অনেকেরই অজানা।
১১ ঘণ্টা আগে