১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। লন্ডনের বিখ্যাত হাইড পার্কে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। পাকিস্তানি বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে বিলাতের নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে দুই বাঙালি তরুণ চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজেদের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে আগুনে পুড়িয়ে দেন। নিজেদের ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’ ঘোষণা করেন। দেশমাতৃকার টানে ছুটে আসেন রণাঙ্গনে। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের নাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ বা ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। একাত্তরের চিকিৎসা ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় স্তম্ভ।
লন্ডন থেকে ভারতের মাটিতে পা রাখেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি অনুধাবন করেন, কেবল অস্ত্র দিয়ে এই যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও লাখ লাখ শরণার্থীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন এক সুসংগঠিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ত্রিপুরার মেলাঘরের বিশ্রামগঞ্জে হাবুল ব্যানার্জির লিচু বাগানে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কেন্দ্র ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। শুরুতে এটি ছিল বাঁশ আর শণের তৈরি এক অবিশ্বাস্য স্থাপনা। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালটি ছিল যুদ্ধকালীন চিকিৎসা সেবার প্রাণকেন্দ্র।
৪৮০ সজ্জার এই হাসপাতালটি গড়ে উঠেছিল বাঁশ, কাঠ আর স্থানীয় উপাদানে। আধুনিক চিকিৎসাসরঞ্জামের অভাব থাকলেও সেখানে ছিল অদম্য দেশপ্রেম আর সেবার মানসিকতা। মেজর খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং মেজর ডা. আখতার আহমেদের প্রাথমিক উদ্যোগে এর যাত্রা শুরু হলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাংগঠনিক দক্ষতায় এটি এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। এই হাসপাতালের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর জনবল কাঠামো। প্রশিক্ষিত নার্সের ভয়াবহ সংকট মেটাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শরণার্থী শিবির থেকে সাধারণ শিক্ষিতা ও অর্ধ-শিক্ষিতা নারীদের সংগ্রহ করে মাত্র কয়েক সপ্তাহের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘প্যারা-মেডিক’ হিসেবে গড়ে তোলেন।
এই নারী স্বেচ্ছাসেবীরাই হয়ে উঠেছিলেন হাসপাতালের প্রাণশক্তি। তাঁরাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষত পরিষ্কার করেছেন, ওষুধ খাইয়েছেন ও মমতার পরশ বুলিয়ে দিয়েছেন। এই হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম।
শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলামের যৌথ গবেষণালব্ধ বই ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ হাসপাতাল কেবল একটি চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল না, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক অমূল্য দলিল। এখানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা পরে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রচনা করে। ডা. জাফরুল্লাহ ছাড়াও ডা. নাজিম উদ্দিন, ডা. লুৎফর রহমানসহ অনেক মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে সেবা দিয়েছেন।
হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার ছিল মাটির নিচে বা বাঁশের ঘরে, যেখানে জেনারেটরের আলোয় কিংবা হারিকেন জ্বালিয়ে জটিল সব অস্ত্রোপচার করা হতো। এই হাসপাতালে কেবল মুক্তিযোদ্ধারাই নন, সেবা পেতেন স্থানীয় গ্রামবাসী ও শরণার্থীরাও। আগস্ট মাসে হাসপাতালটি মেলাঘরের দারোগা বাগিচা থেকে বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত হয় এবং যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এটি তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো, বিশেষ করে অক্সফাম এবং ব্রিটিশ নাগরিক রজার মুডির ‘অপারেশন ওমেগা’ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই হাসপাতালের জন্য ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল।
তবে মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসাযুদ্ধ কেবল সীমান্তের ওপারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরেও চিকিৎসকেরা লিখেছিলেন আরেক বীরত্বগাথা।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাণীগ্রাম গণহত্যার সময় পল্লিচিকিৎসক হরিমন দাস যেভাবে গুলিবিদ্ধ সুকুমার চৌধুরীর শরীর থেকে বুলেট বের করে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, তা এক রূপকথার মতো শোনায়। ডা. রেণু কণা বড়ুয়া চট্টগ্রামের রাউজানে তাঁর বাবার বাড়িতে গোপন হাসপাতাল খুলে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন। এমনকি ডা. এম এ মান্নান এবং ডা. মোতাহার আলী শিকদারের মতো সরকারি চিকিৎসকেরা নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে সরকারি ওষুধাগার থেকে ওষুধ চুরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের গবেষণা সূত্রে জানা যায়, অনেক চিকিৎসক তাঁদের প্রাইভেটকার বা অ্যাম্বুলেন্সে করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহন করতেন। শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ও শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী ছিলেন এই অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের অন্যতম নায়ক। ডা. আলীম চৌধুরীর গাড়ির বনেটে করে সীমান্তের ওপারে ওষুধ পাঠানো হতো এবং সেখান থেকে অস্ত্র এনে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করা হতো। ডা. আজহারুল হক তাঁর চেম্বারে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন এবং রাতের আঁধারে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহতদের সেবা করতেন।
একাত্তরের এই চিকিৎসাযুদ্ধের ইতিহাস যেমন গর্বের, তেমনি বেদনারও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর ও রাজাকারেরা খুব ভালোভাবেই জানত যে চিকিৎসকেরা এই জাতির মেধাবী সন্তান এবং যুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই যুদ্ধের শেষলগ্নে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে চিকিৎসকেরা ছিলেন তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর এবং তার আশেপাশের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বেছে বেছে দেশের সেরা চিকিৎসকদের হত্যা করে। ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. হুমায়ুন কবীরসহ প্রায় শতাধিক চিকিৎসককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ডা. ফজলে রাব্বিকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি জানতেন তাঁর পরিণতি কী হবে, তবুও তিনি মাথা নত করেননি। সিলেটে ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে তাঁর হাসপাতালেই হত্যা করা হয়। পাকশীতে রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. রফিক আহমেদকে তাঁর তিন পুত্রসহ হত্যা করা হয় কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার অপরাধে।
এই চিকিৎসকরা কেবল পেশাগত দায়িত্ব পালন করেননি, তাঁরা ছিলেন জাতির বিবেক। তাঁদের হত্যা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেওয়া। রাও ফরমান আলীর ডায়রিতে পাওয়া তালিকায় এই চিকিৎসকদের নাম ছিল সবার ওপরে, যা প্রমাণ করে পাকিস্তানিরা কতটা পরিকল্পিতভাবে এই নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাসে বিদেশি চিকিৎসকদের অবদানও অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আবেদনে সাড়া দিয়ে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অক্সফাম হাজার হাজার টন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিলেত প্রবাসী বন্ধু ও সহকর্মীরা ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে’ গঠন করে নিয়মিত চাঁদা তুলে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে পাঠাতেন। ডা. এম এ মবিন যিনি ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে পাসপোর্ট পুড়িয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধের ময়দানে এক অকুতোভয় সৈনিকের মতো কাজ করেছেন। ভারতের চিকিৎসকেরাও, বিশেষ করে ডা. রথিন দত্ত, যিনি ত্রিপুরায় বাংলাদেশ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মেজর খালেদ মোশাররফ ও ডা. জাফরুল্লাহকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের অবদান ভোলা সম্ভব নয়।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্যারামেডিক তৈরির মডেল কেবল যুদ্ধকালীন প্রয়োজনই মেটায়নি, বরং স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
তথ্যসূত্র
১. শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম; ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’, প্রথমা প্রকাশন
২. ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ এক অমূল্য দলিল, প্রথম আলো অনলাইন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২
৩. আহমাদ ইশতিয়াক; চিকিৎসাসেবা দিয়ে যারা নিরবে অবদান রেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে; দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
৪. জাকিয়া আহমেদ; মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকায় ছিলেন চিকিৎসকরা; বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬
৫. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক, বণিকবার্তা অনলাইন, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯