leadT1ad

১৯৭০ থেকে ২০২৫: ফিরে দেখা ৭টি চাকসু নির্বাচন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। এসব নির্বাচনে কারা জয়ী হয়েছিল? কেমন ছিল সেসব নির্বাচন?

অনন্ত রায়হান
অনন্ত রায়হান
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৩৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই গঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার—১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮১, ১৯৯০ এবং এবার ২০২৫ সালে। অথচ ১৯৭৩ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।

এবারের চাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ চাকসুর ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতে জয় পেয়েছে। দীর্ঘ ৪৪ বছর পর আবারও চাকসুর নেতৃত্বে ফিরল তারা। এর আগে ১৯৮১ সালের চাকসু নির্বাচনে প্রথমবারের মতো জয় পেয়েছিল ছাত্রশিবির।

আগের চাকসু নির্বাচনগুলোতে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের। তবে আশির দশক থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে। যদিও ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তারা পরাজিত হয় ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’র কাছে। এরপরের দীর্ঘ তিন দশক আর হয়নি চাকসু নির্বাচন।

২০২৫ সালের চাকসু নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ চাকসুর ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতে জয় পেয়েছে।
২০২৫ সালের চাকসু নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ চাকসুর ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতে জয় পেয়েছে।

১৯৭০ সালের চাকসু নির্বাচন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭০ সালে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় চাকসু নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহিম সহসভাপতি (ভিপি) এবং আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন চাকসুর জিএস আবদুর রব।

১৯৭২ সালের চাকসু নির্বাচন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। সে সময় সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা, আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয়ী হন তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না। শামসুজ্জামান হীরা বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতিতে যুক্ত।

মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। চাকসুর জিএস হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৭৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। এর পরের বছর, ১৯৮০ সালের ডাকসু নির্বাচনে তিনি বাসদ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপি নির্বাচিত হন।

১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালের ডাকসুতে ভিপি পদে জয়ী হন মাহমুদুর রহমান মান্না। ছবিতে ১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় মান্না। সংগৃহীত ছবি
১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালের ডাকসুতে ভিপি পদে জয়ী হন মাহমুদুর রহমান মান্না। ছবিতে ১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় মান্না। সংগৃহীত ছবি

১৯৭৪ সালের চাকসু নির্বাচন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। সে নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক সহসভাপতি (ভিপি) এবং গোলাম জিলানী চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। বর্তমানে এস এম ফজলুল হক হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

১৯৭৯ সালের চাকসু নির্বাচন

১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) চতুর্থ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী, আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী।

পরে মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০৪ সালে তিনি জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে যোগ দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশ দলে।

১৯৮১ সালের চাকসু নির্বাচন

১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে প্রথমবারের মতো জয় পায় ইসলামী ছাত্রশিবির। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংগঠনটির প্রভাব ছিল বেশ দৃশ্যমান। চাকসুর পঞ্চম এই নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) দুই পদেই নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থী জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার।

১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচনে জয়ী ভিপি নাজিম উদ্দিন (ডানে) ও জিএস আজিম উদ্দিন ২০২৩ সালে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সংগৃহীত ছবি
১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচনে জয়ী ভিপি নাজিম উদ্দিন (ডানে) ও জিএস আজিম উদ্দিন ২০২৩ সালে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সংগৃহীত ছবি

১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচন

১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) ষষ্ঠ নির্বাচন। এই নির্বাচনে জয় পায় ১২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’। ঐক্যের মধ্যে ছিল ছাত্রলীগ (হাবিবুর রহমান-অসীম কুমার), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (আবদুস সাত্তার-মোশারফ হোসেন), ছাত্রলীগ (নাজমুল হক-শফি আহমেদ), ছাত্রলীগ (বজলুল রশীদ-আজম), জাতীয় ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, ঐক্য সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন।

ভিপি পদে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগের মো. নাজিম উদ্দিন, আর জিএস পদে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ।

নির্বাচনে নাজিম উদ্দিন পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৮৩১ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী ছাত্রশিবিরের হামিদ হোসেন পেয়েছিলেন ২ হাজার ৭৭৪ ভোট। জিএস পদে আজিম উদ্দিন আহমদ পান ৪ হাজার ৯৬৩ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবিরের মানছুর আহমদ পান ২ হাজার ৬২৫ ভোট।

এজিএস পদে নির্বাচিত হন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা মাহবুবের রহমান (বর্তমানে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক)। তিনি পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৯৯১ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হামিদুর রহমান পান ২ হাজার ৬২০ ভোট। পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, ৯৯টি পদের মধ্যে ৮৮টিতেই জয় পায় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।

১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচন। দৈনিক আজাদীর ছবি
১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচন। দৈনিক আজাদীর ছবি

ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পর মো. নাজিম উদ্দিন বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০২৩ সালে নাজিম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’ গঠিত হয়। দলটির চেয়ারম্যান ছিলেন নাজিম উদ্দিন। ২০২৪ সালে তিনি মারা যান।

২০২৫ সালের চাকসু নির্বাচন

আজ বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ভোর সাড়ে চারটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সপ্তম নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর মো. ইব্রাহিম হোসেন ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের এমফিলের শিক্ষার্থী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট।

সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদেও জয় পেয়েছেন শিবিরের প্যানেলের প্রার্থী সাঈদ বিন হাবিব। তিনি ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক এবং ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত পেয়েছেন ২ হাজার ৭৩৪ ভোট।

চাকসুর মোট ২৬টি পদে এবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২৪টিতে জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’, একটি পদে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান। তিনি সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৭ হাজার ১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির সমর্থিত প্যানেলের সাজ্জাদ হোছন পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট।

Ad 300x250

সম্পর্কিত