leadT1ad

চিড়িয়াখানায় ছবি তোলার এক যুগ

আজ ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক প্রাণী অধিকার দিবস। বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সময় ছবি তুলেছেন ঢাকা স্ট্রিমের ফটো এডিটর, ফটো সাংবাদিক আশরাফুল আলম।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় বেশিরভাগ এভাবেই ঘুমিয়ে কাটায় সিংহ। ছবি: আশরাফুল আলম

আন্তর্জাতিক প্রাণী অধিকার দিবস আজ। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় এই দিবস, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, বরং কোটি কোটি প্রাণীরও অধিকার আছে। মানুষ যেমন অনুভব করতে পারে, প্রাণীরাও তেমনি ব্যথা, ভয়, আনন্দ, ক্ষুধা অনুভব করতে পারে। তাই তাদের অধিকার আর অযথা কষ্ট থেকে মুক্ত থাকার অধিকার স্বীকার করা মানবিকতারই অংশ।

এই দিনটি উদযাপনের ধারণা এসেছে একটি মূল বিশ্বাস থেকে, সমস্ত জীবই মূল্যবান, আর তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বা নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পোষ্য হোক বা বন্যপ্রাণী, খামারের প্রাণী হোক বা রাস্তার কুকুর-বিড়াল, সমানভাবে আমাদের সহমর্মিতা ও সুরক্ষার দাবি রাখে। পৃথিবীর পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানও এই প্রাণীদের ওপর নির্ভর করে চলে। তারা না থাকলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ত।

বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা আমি দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সময় ছবি তুলেছি। এ সময় আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে।

খাঁচায় নিরাপত্তার জাল ভেদ করে অজগর সাপ বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তের ছবি তুলেছি। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ সিংহের শুয়ে থাকার ছবি তুলেছি। এর মধ্যে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে মারা যায়। এক জোড়া চিতা বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার শাবকের মৃত্যু হয়েছে। চিড়িয়াখানার লেকে দীর্ঘদিন ধরে ভেসে বেড়ানো তিনটি পেলিকন পাখির মধ্যে একটি মারা গেছে। এমন সব ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে।

প্রকৃতির বিশাল অবারিত পরিবেশে যে পশুপাখিরা হাজার হাজার একর এলাকায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে, তাদেরকে মাত্র কয়েকশো ফুটের আবদ্ধ খাঁচার মধ্যে আটকে রাখা নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক। এই বন্দিত্ব তাদের স্বাভাবিক আচরণ, স্বাধীন চলাচল এবং মানসিক প্রশান্তি—সবকিছুকেই কঠোরভাবে প্রভাবিত করে। তেমনি মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় দেখা যায় প্রাণীরা পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না।

এই চাপ তাদের আচরণেও প্রতিফলিত হয়। একটানা এদিক-ওদিক হাঁটা, মাথা দোলানো, একই কাজ বারবার করা—যা ‘পেসিং’ বা অস্বাভাবিক স্টেরিওটাইপ আচরণ হিসেবে পরিচিত। এমন আচরণ সাধারণত তখনই দেখা দেয়, যখন কোনো প্রাণী মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিম্নমানের খাবার অসময়ে পশুপাখিদের খেতে দেওয়া হয়। অযত্নে আর অবহেলায় এই চিড়িয়াখানায় অসংখ্য ছোট বড় পশুপাখির মৃত্যু হয়েছে।

এর পাশাপাশি, জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের সঠিক চিকিৎসা, উপযুক্ত পরিবেশ বা প্রাকৃতিক আবাসনের মতো সুবিধা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। ফলে প্রাণীরা শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।

প্রতি বছর এ দিনে বিশ্বের নানা স্থানে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এসবের লক্ষ্য একটাই, প্রাণীদের প্রতি সমাজকে আরও সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল করে তোলা। প্রাণীর প্রতি অমানবিক আচরণ না করা, তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধ করা—এসব বিষয়েই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানবসভ্যতার উন্নতি তখনই পূর্ণতা পায়, যখন আমরা প্রাণীদের জন্যও একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো। এর চর্চা শুরু হয় ছোট ছোট আচরণ থেকে—রাস্তার কোনো প্রাণীকে খাবার দেওয়া, বিপদে থাকা পাখিটাকে সাহায্য করা, বা পোষা প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়া।

আন্তর্জাতিক প্রাণী অধিকার দিবস ঠিক সেই মানবিক শুভবোধটুকু জাগিয়ে তোলে, যাতে আমরা সবাই মিলেই প্রাণীদের অধিকারের কথা আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি। তাদের জন্য পৃথিবীটাকে একটু বেশি বাসযোগ্য করে তুলতে পারি। আমরা প্রায় ভুলে যাই এই পৃথিবীটা শুধু মানুষের একা বসবাসের জন্য নয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত