শত শত বছর ধরে নৌকাই ছিলো বেদেদের বসবাস ও যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করায় তাঁদেরকে 'পানির জিপসি' বলা হয়। তবে তাঁরা বাংলাদেশে প্রান্তিক যাযাবর ‘বেদে’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদেদের স্থানীয়ভাবে বাদিয়া,বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়।
ইব্রাহীম খলিল

জয়গুন বিবির বয়স এখন ৬৮ বছর। কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশে দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি চেয়ারে বসে সময় অতিবাহিত করেন। ক্লান্ত লাগলে মাঝে মাঝে নিজের অস্থায়ী কুঁড়েঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। কখনো-বা মেয়ের নাতি-নাতনিদের পরিচর্যা করেন। বয়সের ভার ও শারীরিক নানা অসুস্থ্যতার কারণে তিনি এখন আর অন্য নারীদের মতো অর্থ উপার্জন করতে পারেন না। ফলে দিনের আলোতে অন্য নারীরা যখন আশেপাশের গ্রামগুলোতে হেঁটে হেঁটে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা এবং মানুষের ‘বালাই-মছিবত’ দূর করতে ব্যস্ত, তখন জয়গুন বিবি তাঁর পুরো বেদে দলের তাবুতে ‘একা’ বসে থাকেন।
জয়গুনের জন্ম একটি নৌকায়। তাঁর বাবা-মা এমনকি দাদা-দাদির জন্মও হয়েছিলো খরস্রোত কোনো নদীতে বয়ে চলা নৌকায়। শত শত বছর ধরে নৌকাই ছিলো তাঁদের বসবাস ও যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করায় তাঁদেরকে 'পানির জিপসি' বলা হয়। তবে তাঁরা বাংলাদেশে প্রান্তিক যাযাবর ‘বেদে’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদেদের স্থানীয়ভাবে বাদিয়া,বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়।
বেদে সম্প্রদায় মূলত নারী শাসিত। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও আচারে তাঁরা খানিকটা সনাতনী। মনসাপূজা করে, মঙ্গলচন্ডী,ষষ্ঠীর ব্রত করে। এমনকি দেবী কালী ও দুর্গাকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করে! বিচিত্র এ যাযাবর সম্প্রদায় নিজেদের সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোনো সমাজের কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় না।
অতীতে প্রতিটি বেদে পরিবারের ছিলো নিজস্ব নৌকা। কয়েকটি নৌকা নিয়ে তৈরি হতো একটি দল। আর কয়েকটি দল নিয়ে একেকটি বহর। প্রতিটি বেদে বহরে একজন সর্দার থাকতেন। বহরের নিয়মনীতি, প্রত্যেক দলের বাণিজ্যপথ ও এলাকা এসবই নির্ধারণ করেন সর্দার।
বর্তমানে সময়ের পরিক্রমায় ১০ থেকে ১৫টি পরিবার নিয়ে একটি দল তৈরি হয়। সেই দল পরিচালনার জন্য একজন সর্দারও আছেন। কিন্তু এসব দলের কোনো নৌকা নেই। একসময় নৌকায় জন্ম নেয়া জয়গুন বিবির চলাফেলা, রান্না-খাওয়া ও জীবিকা সবকিছু নৌকাকেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে তাঁদের দলে এমন অনেক সদস্যও রয়েছেন যারা কখনো নৌকা দেখেনি! কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীই শুকিয়ে গেছে। ফলে নৌকা নিয়ে আর সারাদেশে ঘুরে বেড়াতে পারে না। বেঁচে থাকার তাগিদে নদী ছেড়ে স্থলপথে চলাফেরা করতে হয় তাঁদের। পরিবর্তন এসেছে জীবিকাতেও।
একসময় বেদে পুরুষরা কোনো কাজ করতেন না। নারীরা যখন রোজগারে বাইরে যেতেন, তখন সংসার ও বাচ্চা সামলাতো পরিবারের পুরুষ সদস্য। নারীরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছুটে বেড়ায়। তাঁদের আদি পেশা হলো কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা। এছাড়া ঝাড়ফুঁক,শিঙ্গা লাগানো (শরীরের ব্যথা দূর করতে গরুর শিং দিয়ে রক্ত টেনে আনা হয়, বিষয়টি অনেকটা কাপিং থেরাপি পদ্ধতি মতো), দাঁতের চিকিৎসা, বানর খেলা, জাদু দেখানোর কাজও করতো তাঁরা। এছাড়া সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখানোও ছিলো তাঁদের অন্যতম প্রধান পেশা।

কিন্তু দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বানর ও সাপ বেদেদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অতীতের সেই স্মৃতি স্মরণ করে জয়গুন বিবি বলেন, ‘আমরা সর্বশেষ ২০০৪ সালে নৌকা ছেড়েছি। দেশের অধিকাংশ নদীতে এখন নৌকা চলার মতো পানি নেই। বদ্ধ ও শুকনা জায়গায় নৌকা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা খুব লোকসানে পড়ে গিয়েছিলাম। অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় নৌকা নিয়ে আটকেও গিয়েছি। সাগরের আশেপাশের নদীতে দুযোগ, লবণাক্ত পানি বৃদ্ধি ও জনবসতি কম হওয়ায় বাধ্য হয়ে নৌকাকেন্দ্রিক জীবন ছাড়তে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা-মা ও দাদা-দাদিরা ভষজ ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি নদীতে মাছও ধরত। সেই মাছ বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এখন তো নদীই নেই, নদীতে মাছ পাবো কীভাবে? আবার আগের মতো মানুষজন আমাদের কাছ থেকে চিকিৎসাও নেয় না। দেশে স্থানীয় শহরগুলোতেও অত্যাধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। কিছু হলেই হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরলেও যথেষ্ট আয় হয় না। এতে পরিবারে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা করাতে কষ্ট হয়ে যায়।’
কথা বলার সময় জয়গুন বিবির পাশেই বসে পাখি শিকারের জন্য মাটি দিয়ে মার্বেল বানাচ্ছিলেন ২৮ ও ৩২ বছর বয়সি দুই বেদে যুবক সবুজ মিয়া ও শাহরুখ খান। তাঁদের স্ত্রীরা গ্রামে ওষুধ বিক্রি করতে যাওয়ায় তাঁরা সন্তানদের দেখাশোনা করছেন। পাশাপাশি সময় পেলে পাশের গ্রামগুলোতে কড়ি ও তাবিজ বিক্রির করেন সবুজ ও শাহরুখ খান।
সবুজ মিয়া বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ে আগে পুরুষরা অর্থ উপার্জনের কাজ করতো না। কিন্তু এখন নারীরা আর আগের মতো আর অর্থ উপার্জন করতে না পারায় আমরাও তাদেরকে সাহায্য করি। শহরের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত হওয়ায় কেউ তাবিজ, কড়ি ও ভেষজ ওষুধ গ্রহণ করেন না। কিন্তু কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের প্রতি এখনো গ্রামের মানুষের অনেক আস্থা রয়েছে। ফলে গ্রামে গ্রামে ঘুরলে কিছুটা আয় করা যায়। কিন্তু সেই আয়েও সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যায়। একসময় আমার বাবা-মা আয় কমে গেলে নদী থেকে মাছ ধরে সেগুলো বিক্রি করতো। কিন্তু আমারা সেই নদীকেন্দ্রিক জীবন থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। এখন সুপেয় পানি সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’
যাযাবর হওয়ায় বাংলাদেশে সবধরনের সরকারি সুবিধাও গ্রহণ করতে পারে না বেদেরা। ২০০৮ সালে বেদেদের ভোটাধিকার দেওয়া হলেও তাঁদের শিক্ষা ও চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বেদেদের শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। কারণ যাযাবর হওয়ায় তাঁরা স্থায়ীভাবে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে পারেন না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বেদে জনগোষ্ঠী প্রায় ৭৫০০০ জন। বেদেরা দাবি করেন তাঁরা অতীতে ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। ফলে বেদেদের কিছু মানুষ এখনো সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। সেখান থেকে প্রতিবছর দুই বার সারাদেশে ছয় মাসের জন্য জীবিকার জন্য বের হন। আর যাদের বসবাসের স্থায়ী জায়গা নেই তাঁরা অস্থায়ী ঘর নিয়েই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেড়ান।

ঢাকার গাবতলীতে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করা এক বেদে দলের সর্দার রাজন মিয়া। তিনি বলেন, ‘এক সময় শুধুই নারীরা সাপ খেলা দেখিয়ে বা কবিরাজি করে অর্থ উপার্জন করতো। কিন্তু বর্তমানে নারী-পুরুষ উভয়েই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে গ্রাম-গঞ্জে ঘুরেও আগের মতো উপার্জন করতে পারে না। এছাড়াও আগের মত এখন আর সাপ পাওয়া যায় না। ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো মরে গেছে। নদী ও পানি না থাকায় দিন দিন নৌকার ব্যবহারও কমে গেছে। ফলে রাস্তা ভাল থাকায় স্থল পথে যাতায়াত ও বসবাস করতে হচ্ছে। এছাড়া হঠাৎ বন্যা, অনাবৃষ্টি আমাদের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাসস্থান সংকট, খাদ্য ও পানির অভাব এবং বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে অকাল মৃত্যুর হারও বেড়েছে।’
নদীকেন্দ্রিক জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে অনেক বেদে নারী ঢাকাতে ভিক্ষাবৃত্তিও করছে। ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতে অবস্থান করা অধিকাংশ নারী বেদেরা এখন আর ওষুধ বিক্রি করেন না। কখনো কখনো দুয়েকজনের হাতে থাকা ছোট্ট একটি সাপ দিয়ে পথচারিকে ভয় দেখিয়েও জোর করে টাকা আদায় করতে দেখা যায় তাঁদেরকে। এ প্রসঙ্গে রাজন মিয়া বলেন, ‘আমাদের কোনো নারীই জোর করে কারো কাছ থেকে টাকা নেয় না। অনেকে হয়তো সাপ দেখিয়ে আনন্দ দিয়ে টাকা নেয়। তাছাড়া এসব পরিবার কীভাবে বেঁচে থাকবে? পানি না থাকায় নদী ও নৌকা ছেড়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়ে আমাদের অনেকে শহরে আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতে আমাদের বয়োজেষ্ঠরা মানিয়ে নিতে না পারলেও আমাদের সামনে কোনো উপায় নেই।
সম্প্রতি গবেষণানির্ভর থিংক ট্যাংক ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’ এক গবেষণায় জানিয়েছে, গত ৪৪ বছরে (১৯৮৮ থেকে ২০২৪) ঢাকাতেই ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হারিয়ে গেছে ঢাকার ৬০ শতাংশ জলাধার। অবশিষ্ট জলাধার রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায়। ২১ দশমিক ৬ শতাংশ ঢাকার সবুজ আচ্ছাদন কমতে কমতে নেমেছে মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ঢাকার কোনো এলাকা ৩০ ডিগ্রি সেলিসিয়াস তাপমাত্রার নিচে নেই। ফলে নদী ও প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা বেদের জনগোষ্ঠীর জীবন কতোটা দিশেহারা সেটা সহজেই অনুমেয়।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক

জয়গুন বিবির বয়স এখন ৬৮ বছর। কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশে দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি চেয়ারে বসে সময় অতিবাহিত করেন। ক্লান্ত লাগলে মাঝে মাঝে নিজের অস্থায়ী কুঁড়েঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। কখনো-বা মেয়ের নাতি-নাতনিদের পরিচর্যা করেন। বয়সের ভার ও শারীরিক নানা অসুস্থ্যতার কারণে তিনি এখন আর অন্য নারীদের মতো অর্থ উপার্জন করতে পারেন না। ফলে দিনের আলোতে অন্য নারীরা যখন আশেপাশের গ্রামগুলোতে হেঁটে হেঁটে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা এবং মানুষের ‘বালাই-মছিবত’ দূর করতে ব্যস্ত, তখন জয়গুন বিবি তাঁর পুরো বেদে দলের তাবুতে ‘একা’ বসে থাকেন।
জয়গুনের জন্ম একটি নৌকায়। তাঁর বাবা-মা এমনকি দাদা-দাদির জন্মও হয়েছিলো খরস্রোত কোনো নদীতে বয়ে চলা নৌকায়। শত শত বছর ধরে নৌকাই ছিলো তাঁদের বসবাস ও যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করায় তাঁদেরকে 'পানির জিপসি' বলা হয়। তবে তাঁরা বাংলাদেশে প্রান্তিক যাযাবর ‘বেদে’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদেদের স্থানীয়ভাবে বাদিয়া,বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়।
বেদে সম্প্রদায় মূলত নারী শাসিত। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও আচারে তাঁরা খানিকটা সনাতনী। মনসাপূজা করে, মঙ্গলচন্ডী,ষষ্ঠীর ব্রত করে। এমনকি দেবী কালী ও দুর্গাকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করে! বিচিত্র এ যাযাবর সম্প্রদায় নিজেদের সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোনো সমাজের কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় না।
অতীতে প্রতিটি বেদে পরিবারের ছিলো নিজস্ব নৌকা। কয়েকটি নৌকা নিয়ে তৈরি হতো একটি দল। আর কয়েকটি দল নিয়ে একেকটি বহর। প্রতিটি বেদে বহরে একজন সর্দার থাকতেন। বহরের নিয়মনীতি, প্রত্যেক দলের বাণিজ্যপথ ও এলাকা এসবই নির্ধারণ করেন সর্দার।
বর্তমানে সময়ের পরিক্রমায় ১০ থেকে ১৫টি পরিবার নিয়ে একটি দল তৈরি হয়। সেই দল পরিচালনার জন্য একজন সর্দারও আছেন। কিন্তু এসব দলের কোনো নৌকা নেই। একসময় নৌকায় জন্ম নেয়া জয়গুন বিবির চলাফেলা, রান্না-খাওয়া ও জীবিকা সবকিছু নৌকাকেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে তাঁদের দলে এমন অনেক সদস্যও রয়েছেন যারা কখনো নৌকা দেখেনি! কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীই শুকিয়ে গেছে। ফলে নৌকা নিয়ে আর সারাদেশে ঘুরে বেড়াতে পারে না। বেঁচে থাকার তাগিদে নদী ছেড়ে স্থলপথে চলাফেরা করতে হয় তাঁদের। পরিবর্তন এসেছে জীবিকাতেও।
একসময় বেদে পুরুষরা কোনো কাজ করতেন না। নারীরা যখন রোজগারে বাইরে যেতেন, তখন সংসার ও বাচ্চা সামলাতো পরিবারের পুরুষ সদস্য। নারীরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছুটে বেড়ায়। তাঁদের আদি পেশা হলো কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা। এছাড়া ঝাড়ফুঁক,শিঙ্গা লাগানো (শরীরের ব্যথা দূর করতে গরুর শিং দিয়ে রক্ত টেনে আনা হয়, বিষয়টি অনেকটা কাপিং থেরাপি পদ্ধতি মতো), দাঁতের চিকিৎসা, বানর খেলা, জাদু দেখানোর কাজও করতো তাঁরা। এছাড়া সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখানোও ছিলো তাঁদের অন্যতম প্রধান পেশা।

কিন্তু দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বানর ও সাপ বেদেদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অতীতের সেই স্মৃতি স্মরণ করে জয়গুন বিবি বলেন, ‘আমরা সর্বশেষ ২০০৪ সালে নৌকা ছেড়েছি। দেশের অধিকাংশ নদীতে এখন নৌকা চলার মতো পানি নেই। বদ্ধ ও শুকনা জায়গায় নৌকা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা খুব লোকসানে পড়ে গিয়েছিলাম। অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় নৌকা নিয়ে আটকেও গিয়েছি। সাগরের আশেপাশের নদীতে দুযোগ, লবণাক্ত পানি বৃদ্ধি ও জনবসতি কম হওয়ায় বাধ্য হয়ে নৌকাকেন্দ্রিক জীবন ছাড়তে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা-মা ও দাদা-দাদিরা ভষজ ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি নদীতে মাছও ধরত। সেই মাছ বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এখন তো নদীই নেই, নদীতে মাছ পাবো কীভাবে? আবার আগের মতো মানুষজন আমাদের কাছ থেকে চিকিৎসাও নেয় না। দেশে স্থানীয় শহরগুলোতেও অত্যাধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। কিছু হলেই হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরলেও যথেষ্ট আয় হয় না। এতে পরিবারে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা করাতে কষ্ট হয়ে যায়।’
কথা বলার সময় জয়গুন বিবির পাশেই বসে পাখি শিকারের জন্য মাটি দিয়ে মার্বেল বানাচ্ছিলেন ২৮ ও ৩২ বছর বয়সি দুই বেদে যুবক সবুজ মিয়া ও শাহরুখ খান। তাঁদের স্ত্রীরা গ্রামে ওষুধ বিক্রি করতে যাওয়ায় তাঁরা সন্তানদের দেখাশোনা করছেন। পাশাপাশি সময় পেলে পাশের গ্রামগুলোতে কড়ি ও তাবিজ বিক্রির করেন সবুজ ও শাহরুখ খান।
সবুজ মিয়া বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ে আগে পুরুষরা অর্থ উপার্জনের কাজ করতো না। কিন্তু এখন নারীরা আর আগের মতো আর অর্থ উপার্জন করতে না পারায় আমরাও তাদেরকে সাহায্য করি। শহরের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত হওয়ায় কেউ তাবিজ, কড়ি ও ভেষজ ওষুধ গ্রহণ করেন না। কিন্তু কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের প্রতি এখনো গ্রামের মানুষের অনেক আস্থা রয়েছে। ফলে গ্রামে গ্রামে ঘুরলে কিছুটা আয় করা যায়। কিন্তু সেই আয়েও সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যায়। একসময় আমার বাবা-মা আয় কমে গেলে নদী থেকে মাছ ধরে সেগুলো বিক্রি করতো। কিন্তু আমারা সেই নদীকেন্দ্রিক জীবন থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। এখন সুপেয় পানি সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’
যাযাবর হওয়ায় বাংলাদেশে সবধরনের সরকারি সুবিধাও গ্রহণ করতে পারে না বেদেরা। ২০০৮ সালে বেদেদের ভোটাধিকার দেওয়া হলেও তাঁদের শিক্ষা ও চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বেদেদের শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। কারণ যাযাবর হওয়ায় তাঁরা স্থায়ীভাবে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে পারেন না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বেদে জনগোষ্ঠী প্রায় ৭৫০০০ জন। বেদেরা দাবি করেন তাঁরা অতীতে ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। ফলে বেদেদের কিছু মানুষ এখনো সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। সেখান থেকে প্রতিবছর দুই বার সারাদেশে ছয় মাসের জন্য জীবিকার জন্য বের হন। আর যাদের বসবাসের স্থায়ী জায়গা নেই তাঁরা অস্থায়ী ঘর নিয়েই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেড়ান।

ঢাকার গাবতলীতে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করা এক বেদে দলের সর্দার রাজন মিয়া। তিনি বলেন, ‘এক সময় শুধুই নারীরা সাপ খেলা দেখিয়ে বা কবিরাজি করে অর্থ উপার্জন করতো। কিন্তু বর্তমানে নারী-পুরুষ উভয়েই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে গ্রাম-গঞ্জে ঘুরেও আগের মতো উপার্জন করতে পারে না। এছাড়াও আগের মত এখন আর সাপ পাওয়া যায় না। ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো মরে গেছে। নদী ও পানি না থাকায় দিন দিন নৌকার ব্যবহারও কমে গেছে। ফলে রাস্তা ভাল থাকায় স্থল পথে যাতায়াত ও বসবাস করতে হচ্ছে। এছাড়া হঠাৎ বন্যা, অনাবৃষ্টি আমাদের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাসস্থান সংকট, খাদ্য ও পানির অভাব এবং বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে অকাল মৃত্যুর হারও বেড়েছে।’
নদীকেন্দ্রিক জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে অনেক বেদে নারী ঢাকাতে ভিক্ষাবৃত্তিও করছে। ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতে অবস্থান করা অধিকাংশ নারী বেদেরা এখন আর ওষুধ বিক্রি করেন না। কখনো কখনো দুয়েকজনের হাতে থাকা ছোট্ট একটি সাপ দিয়ে পথচারিকে ভয় দেখিয়েও জোর করে টাকা আদায় করতে দেখা যায় তাঁদেরকে। এ প্রসঙ্গে রাজন মিয়া বলেন, ‘আমাদের কোনো নারীই জোর করে কারো কাছ থেকে টাকা নেয় না। অনেকে হয়তো সাপ দেখিয়ে আনন্দ দিয়ে টাকা নেয়। তাছাড়া এসব পরিবার কীভাবে বেঁচে থাকবে? পানি না থাকায় নদী ও নৌকা ছেড়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়ে আমাদের অনেকে শহরে আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতে আমাদের বয়োজেষ্ঠরা মানিয়ে নিতে না পারলেও আমাদের সামনে কোনো উপায় নেই।
সম্প্রতি গবেষণানির্ভর থিংক ট্যাংক ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’ এক গবেষণায় জানিয়েছে, গত ৪৪ বছরে (১৯৮৮ থেকে ২০২৪) ঢাকাতেই ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হারিয়ে গেছে ঢাকার ৬০ শতাংশ জলাধার। অবশিষ্ট জলাধার রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায়। ২১ দশমিক ৬ শতাংশ ঢাকার সবুজ আচ্ছাদন কমতে কমতে নেমেছে মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ঢাকার কোনো এলাকা ৩০ ডিগ্রি সেলিসিয়াস তাপমাত্রার নিচে নেই। ফলে নদী ও প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা বেদের জনগোষ্ঠীর জীবন কতোটা দিশেহারা সেটা সহজেই অনুমেয়।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক

বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন অনেক গুরুত্বপূর্ন নেতারাও। কোথাও জনসমাগমে দাঁড়িয়ে গুলি ছোড়া হয়েছে, কোথাও বিস্ফোরণে থেমে গেছে এক নেতার প্রচারণা, কোথাও আবার র্যালির মাঝেই ভেঙে পড়েছে রাজনৈতিক নিরাপত্তার দেয়াল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তান, ভারত থেকে জাপ
১৭ ঘণ্টা আগে
আজ মওলানা ভাসানীর জন্মদিন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে অত্যন্ত আবেগময় ও যুক্তিপূর্ণ বার্তা পাঠান। এই বার্তাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছে পাকিস্তান
১৯ ঘণ্টা আগে
জেনে অবাক হবেন যে রাজশাহীর জঙ্গলে শেষ বাঘটি দেখা যায় ১২৫ বছর আগে। আর কোন কোন বন্যপ্রাণী সেখানে ছিল? নদী, জলাভূমি ও পুকুরে কী কী মাছ পাওয়া যেত? কী কী পাখি দেখা যেত? ১৯১৬ সালে প্রকাশিত এল এস এস ওম্যালি-এর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (রাজশাহী) থেকে অনুবাদ করেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
১ দিন আগে
আজ এক ‘অগ্নিপুরুষ’-এর জন্মদিন। ইতিহাসের পাতায় যার নাম লেখা আছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে, কিন্তু শোষকের কলিজা কাঁপাতে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দাবানল। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১ দিন আগে