leadT1ad

‘টাইটানিক’ থেকে শুরু, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও বাংলাদেশে কেন এত জনপ্রিয়

‘আই অ্যাম দ্য কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড!’ টাইটানিক সিনেমার সেই সংলাপ আজও প্রতিধ্বনিত হয় সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে। কিন্তু সেই সিনেমার নায়ক লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর যাত্রা থেমে থাকেনি জাহাজের ডেকে। প্রায় তিন দশক পরে আজও ডিক্যাপ্রিও আছেন নিজের আসনেই। আজ এই অভিনেতার জন্মদিন।

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ৩৯
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

কিছু কিছু নাম পরিচয় ছাপিয়ে প্রজন্মের স্মৃতি হয়ে ওঠে। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রি তেমনই একজন। তাঁর নাম শুনলে নব্বইয়ের দশকের কোনো কিশোরের ঘরের দেয়ালে সাঁটা পোস্টারের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে আটলান্টিকের হিমশীতল জলে ডুবে যাওয়া জাহাজের কথা। আর জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিশ্বজয় করার স্বপ্নে বিভোর তরুণের ছবি।

কিন্তু সেই স্বপ্নের ভেলা শুধু ‘টাইটানিক’ হয়ে সমুদ্রের হিমশীতল জলেই ভেসে থাকেনি, সময়ের স্রোতে তা পরিণত হয়েছে শিল্পের সুবিশাল জাহাজে। মার্টিন স্করসেজি থেকে কোয়েন্টিন টারান্টিনো, ক্রিস্টোফার নোলান থেকে আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু—সিনেমার সেরা সব কারিগরদের ক্যানভাসে ডিক্যাপ্রিও এঁকেছেন একের পর এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। এই অবিশ্বাস্য ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ই তাঁকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার শিখরে।

টাইটানিক সিনেমার একটি দৃশ্য। সংগৃহীত ছবি
টাইটানিক সিনেমার একটি দৃশ্য। সংগৃহীত ছবি

প্রায় তিন দশক পরে আজও ডিক্যাপ্রিও আছেন নিজের আসনেই। সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওয়ান ব্যাটেল আফটার অ্যানাদার’-এর জন্য দর্শক ও সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা আবারো প্রমাণ করে, ডিক্যাপ্রিও হয়ে উঠেছেন আরও অপ্রতিরোধ্য। আজ এই কিংবদন্তি অভিনেতার জন্মদিন।

কে এই ডিক্যাপ্রিও?

লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে শুধু অভিনেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে ভুল হবে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই একজন আইকন, একজন ‘ফেনোমেনন’। তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল টেলিভিশনের ছোট পর্দায়, শিশুশিল্পী হিসেবে। কিন্তু সিনেমাপ্রেমীরা তাঁকে প্রথম চিনতে শুরু করেছিল ‘হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ’ সিনেমা থেকে। সেখানে জনি ডেপের মতো তারকার পাশে থেকেও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডিক্যাপ্রিও। এরপর বাজ লারম্যানের ‘রোমিও + জুলিয়েট’-এ তিনি হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে ঝড় তোলা আধুনিক সময়ের চিরায়ত প্রেমিকের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিল ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’ সিনেমা। সিনেমার গল্পে জাহাজের সঙ্গে ডুবে গিয়েছিল কোটি কোটি দর্শকের মন, আর জ্যাক ডসন নামের সেই ভবঘুরে শিল্পী ছেলেটি অমর হয়ে গিয়েছিল লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর চেহারায়।

টাইটানিক সিনেমার নায়ক চরিত্র জ্যাক ডসনের ট্র্যাজিক প্রেমের গল্প এদেশের তরুণ-তরুণীদের মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল, যা আগে কোনো ইংরেজি সিনেমা পারেনি। জ্যাক ভালোবাসার জন্য জীবন দেয়। এভাবেই ডিক্যাপ্রিও শুধু বিদেশি নায়ক রইলেন না, হয়ে উঠলেন ‘আমাদের ডিক্যাপ্রিও’।

রোমান্টিক খোলস ভেঙে নতুন ডিক্যাপ্রিও

টাইটানিক সিনেমার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা খুব সহজেই ডিক্যাপ্রিওকে রোমান্টিক নায়কের খোলসে আটকে ফেলতে পারত। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি। সচেতনভাবে বেছে নিয়েছেন জটিল, মনস্তাত্ত্বিক ও চ্যালেঞ্জিং সব চরিত্র। এখানেই তিনি আর দশজন ‘সুপারস্টার’ থেকে আলাদা।

সিনেমার প্রতি একনিষ্ঠতা থেকে তিনি জুটি বেঁধেছেন বিশ্বের সেরা সব পরিচালকের সঙ্গে। বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসেজির সঙ্গে তাঁর জুটি অতুলনীয়। ‘দ্য অ্যাভিয়েটর’, ‘দ্য ডিপার্টেড’, ‘শাটার আইল্যান্ড’, ‘দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট’ থেকে শুরু করে ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’—প্রতিটি ছবিতে ডিক্যাপ্রিও নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়েছেন।

ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইনসেপশন’-এ ডিক্যাপ্রিও দর্শকদের নিয়ে গেছেন স্বপ্নের জটিল গোলকধাঁধায়। আবার কোয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’-এ হয়েছেন বর্ণবাদী নিষ্ঠুর মালিক। তাঁর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো চরিত্রের গভীরে ডুব দেওয়ার ক্ষমতা। ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবির জন্য অস্কার জেতার আগ পর্যন্ত ডিক্যাপ্রিওর প্রতিটি মনোনয়ন ছিল তাঁর প্রতিভার প্রতি এক একটি স্বীকৃতি।

ডিক্যাপ্রিও অভিনীত সিনেমার পোস্টার। সংগৃহীত ছবি
ডিক্যাপ্রিও অভিনীত সিনেমার পোস্টার। সংগৃহীত ছবি

ডিক্যাপ্রিও বাংলাদেশে কেন এত জনপ্রিয়

হলিউডের বহু তারকা সময়ের সঙ্গে এসেছেন এবং চলেও গেছেন। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার বা সিলভেস্টার স্ট্যালোনের অ্যাকশন কিংবা টম হ্যাঙ্কসের হৃদয়ছোঁয়া অভিনয়—সবই বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মন জয় করেছে। কিন্তু ডিক্যাপ্রিওর জনপ্রিয়তা যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যখন স্যাটেলাইট টিভি আর ভিসিডির মাধ্যমে বিশ্ব চলচ্চিত্র বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে, তখন টাইটানিক ও সেই ঢেউয়ের অংশ হয়ে আসে। এরপর ২০০০ সালের পর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কিছু ডাব স্টুডিও নিজেদের উদ্যোগে টাইটানিকের বাংলা ডাব সংস্করণ তৈরি করে। সিনেমাটি তখন ভিসিডি আর ডিভিডির মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখনকার তরুণ প্রজন্মের অনেকের মনে সেই স্মৃতি আজও অমলিন।

টাইটানিক সিনেমার নায়ক চরিত্র জ্যাক ডসনের ট্র্যাজিক প্রেমের গল্প এদেশের তরুণ-তরুণীদের মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল, যা আগে কোনো ইংরেজি সিনেমা পারেনি। জ্যাক ভালোবাসার জন্য জীবন দেয়। এভাবেই ডিক্যাপ্রিও শুধু বিদেশি নায়ক রইলেন না, হয়ে উঠলেন ‘আমাদের ডি ক্যাপ্রিও’।

মার্টিন স্করসেজি থেকে কোয়েন্টিন টারান্টিনো, ক্রিস্টোফার নোলান থেকে আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু—সিনেমার সেরা সব কারিগরদের ক্যানভাসে ডিক্যাপ্রিও এঁকেছেন একের পর এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। এই অবিশ্বাস্য ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ই তাঁকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার শিখরে।

এরপর কেটে গেছে বহু বছর। যে প্রজন্ম জ্যাকের জন্য কেঁদেছিল, তাঁরা বড় হয়েছে। আর সেই সঙ্গেই যেন বড় হয়েছেন ডিক্যাপ্রিও। তিনি যখন ‘ইনসেপশন’-এর মতো জটিল ‘সাই-ফাই’ জনরার সিনেমা বা ‘শাটার আইল্যান্ড’-এর মতো মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার করেছেন, তখন তাঁর সেই পুরোনো দর্শকেরাও সিনেমার গল্পের গভীরতা বোঝার মতো পরিপক্ব হয়ে উঠেছেন।

‘টাইটানিক’খ্যাত এ অভিনেতার অগণিত বাংলাদেশী ভক্ত অনুরাগী এখনো তাঁর সিনেমা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। মাসখানেক আগেও বাংলাদেশের মাল্টিপ্লেক্সের পর্দায় এসেছে লিওনার্দোর নতুন সিনেমা ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’।

পর্দার বাইরে ডিক্যাপ্রিও

অভিনয়ের পাশাপাশি লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সংকট নিয়ে বরাবরই সোচ্চার। ১৯৯৮ সালে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রজাতি রক্ষা, বন ও মহাসাগর সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ফাউন্ডেশন’। কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি ‘আমেরিকা'স ফুড ফান্ড’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। তিনি জাতিসংঘের শান্তিদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার এই পদক্ষেপগুলো ডিক্যাপ্রিওকে অন্য যেকোনো অভিনেতার চেয়ে বড় পরিচয়ে আসীন করেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত