সমাজের প্রচলিত ধারণা এমন, মেয়েরা প্রচুর গসিপ করে আর ‘ব্যাটামানুষ’-রা গসিপের নাম শুনলেই ভ্রু কুঁচকায়। সেলিব্রেটি বা তারকাদের নিয়ে আমাদের সমাজের গসিপ এবং তার মেজাজটি কেমন? শাকিব-বুবলী-অপু গসিপের টর্নেডোর বাতাস কতটা আপনার গায়ে লেগেছে?
আদ্রিতা কবির
অনুপম রায় ও পিয়া চক্রবর্তীর ডিভোর্সের কত দিন পর পরমব্রত আর পিয়ার প্রেম হয়েছিল, এটা ইন্সটাগ্রাম স্টক করে আবিষ্কার করতে আমার লেগেছিলো মোট ২৭ মিনিটের কাছাকাছি। এত সময় লাগার কারণ পিয়ার ইন্সটাগ্রামে খুব কম ছবি আর পরমব্রত-অনুপমের ইন্সটা পিআর দিয়ে অতি সাবধানে কিউরেটেড। তাঁদের নানান ট্যাগড ছবি ধরে বন্ধুবান্ধবকে স্টক করে মোটামুটি একটা টাইমলাইন পেলাম। তখন হঠাৎ পিয়া চক্রবর্তীর লিংকডইন চোখে পড়ল। তার একাডেমিক ডিগ্রির বহর দেখে ডিপ্রেসড হয়ে গেলাম। মনে পড়ল, আমারও বিশিষ্ট ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার আশা ছিল একসময়। আর এখন এই আমি বিনোদন পাতার ‘নেটিজেন’দের মতো সেলেব্রিটি গসিপ দেখছি।
প্রচুর সেলফহেট নিয়ে আমি একটু ‘সিরিয়াস’ কিছু পড়ার ট্রাই করলাম। কিন্তু একটু পরই আবার গায়েবিভাবে ট্যাব চেঞ্জ হয়ে ‘নিউ ইয়র্কার’ থেকে ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে ব্যাক করল। টিম অনুপম ততক্ষণে টিম পরমব্রতকে ‘বন্ধু হয়েও কীভাবে বন্ধুর প্রাক্তনকে বিয়ে করলে?’ লাইনে গালিগালাজ বাদ দিয়ে ‘রাইমা সেনকে ধোঁকা দিয়ে কীভাবে পিয়াকে বিয়ে করলে?’ লাইনে গালিগালাজ শুরু করছে। এর মধ্যে আবার রাইমা সেন এসে পিয়া-পরমব্রতর বিয়ের পোস্টে অভিনন্দন জানিয়ে কমেন্ট করেছেন। এটিতে পিওর পাবলিক দিশাহারা বোধ করছে। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ মধুসূদনের মতো বলছে, একেই কি বলে সভ্যতা?
এর আগে টিম তাহসান আর টিম সৃজিতের কাইজ্জার সময়ও আমার একই নেশা হয়ে গিয়েছিল। এইবার দেব-শুভশ্রী আর শাকিব-অপু-বুবলী সাগার সময় আমি ঠিক করি যে– না, অনেক হইছে। আমি আর এমন শ্যালো গসিপখোর থাকব না। আই উইল বি আ বেটার পারসন।
কিন্তু যাঁরা সেলেব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাইতে গলাইতে পুরাপুরি ঢুকায় দেয়, তাঁরা কি খারাপ বা নিম্নমেধার লোকজন? কোনো বুদ্ধিমান মানুষ কি গসিপে আমোদ পায় না?
সিরিয়াস ইন্টেলেকচুয়ালরা কি গসিপ করে
১৯১৮ সালে বিখ্যাত লেখক ভার্জিনিয়া উলফ যখন মোটামুটিভাবে জনশূন্য এলাকা আশেশামে থাকেন, তখন তিনি তাঁর বন্ধুকে চিঠি লিখেন যে তিনি তীব্র একাকিত্বে ভুগছেন। তাঁর ভাষ্যে, তিনি হিউম্যান টাচ মানে গসিপ মিস করেন যেখানে মানুষ অনুভব করে তার আশেপাশে আরও মানুষ আছে, যাদের জীবনে নানা কিছু ঘটছে, যা ফিসফাস করার মতো ইন্টারেস্টিং। এর বাদে জীবন খুবই একাকী এবং নন-হিউম্যান।
জেন অস্টিন তাঁর উপন্যাস ‘পারসুয়েশন’-এ গসিপকে কিছুটা এভাবেই দেখিয়েছেন, গসিপ আমোদ দেয় এবং বোধ করায় যে আমি একটা বৃহত্তর জাতি বা স্পিসির অংশ, যে জাতিকে আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি গসিপ দিয়ে।
এইরকম আরও অনেক ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ দেওয়া সম্ভব গসিপের পক্ষে কিন্তু যেহেতু দুইটা দিয়ে আমি আমার ইন্টেলেকচুয়ালিটির একটু আভাস দিতে সফল হয়েছি, তাই ক্ষ্যান্ত দিলাম। আবার এই উদাহরণগুলা শুনে মনে হতে পারে, গসিপ শুধু বৃহত্তর মানবস্বার্থের আদর্শ কোনো বিষয়। এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। গসিপ পিওর বিনোদনও হতে পারে।
পালাব কোথায়?
মার্কিন লেখক জুলি ক্ল্যাম তাঁর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর লেখা ‘টু স্টে সেন, রিড মোর সেলেব্রিটি গসিপ’ -এর শুরুই করছেন এভাবে যে জগৎ এখন খুবই ভঙ্গুর আর ভায়োলেন্ট। ঘুম থেকে উঠেই দেখতে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আজ কয়টা দেশে নিউক্লিয়ার আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন। এই ডিপ্রেসিং দশায় গসিপ দেখা–কার প্রেম, কার ব্রেকাপ হলো দেখাই আমাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে, আশেপাশের সমস্যাগুলোকে ক্ষুদ্র বলে ফিল করায়।
মজার ব্যাপার হলো, এই জুলি ক্ল্যামের সেলেব্রিটি কালচার নিয়ে লেখা কূটিল-কঠিন বইও আছে। তারপরও তিনি তারকাবাজিকে ছোটবেলা থেকেই একটা ‘স্কেপ’ বা পলায়নপন্থা হিসেবে দেখেন, কখনো সেটা হোমওয়ার্ক থেকে, কখনো-বা ব্যক্তিগত বা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধাবস্থা থেকে।
লকডাউনের সময় কোন তারকা কী করেছেন, এটা আমি বিশদভাবে বলতে পারব। ২০২১ সালের যে দুই সপ্তাহ আমার মায়ের করোনা ছিল, তখন কাইলি জেনারের দিনলিপি আমার মুখস্থ। গসিপ দিয়ে বাস্তবতা থেকে পালানোর চেষ্টা আমরা সবাই করেছি। প্রচুর ট্র্যাজেডির লাইভ সাক্ষী হয়ে অ্যানা ক্যারেনিনার মতো ট্র্যাজিক ক্লাসিক পড়ে কোপ করা লোকের সংখ্যাই বরং কম।
‘গসিপ একটা মেয়েলি ব্যাপার’
মেয়েরা প্রচুর গসিপ করে, এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত। ব্যাটামানুষেরা কি তাহলে গসিপ করে না?
গসিপ শব্দটা আসছে ‘ গড-সিবলিং’ থেকে যার অর্থ হচ্ছে, এমন কোনো ব্যক্তি যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু এমন সখ্য (এবং ব্যাপটিজম বন্ড) আছে যে তার সঙ্গে গোপন কথা শেয়ার করা যায়। এখানে লিঙ্গের কোনো ব্যাপারস্যাপার নেই। তাহলে নারীর সঙ্গে গসিপকে যুক্ত করে দুয়ো দেওয়ার কালচারটার অরিজিন কই?
বৃটিশ রেঁনেসার সময় গসিপ বলতে সেসব সখিদের বোঝাত, যারা সন্তানপ্রসবের সময় উপস্থিত থাকে এবং নানাবিধ গল্প করে প্রসূতি মাকে ব্যস্ত রাখে। সোজা বাংলায়, অ্যানেস্থেশিয়াহীন যুগে ডিসকাউন্ট অ্যানেস্থেশিয়া বান্ধবীকূল।
এই ব্যথা প্রশমণকারী গসিপকে আবার ব্রিটিশ পুরুষেরা তখন ভালো চোখে দেখেনি, যেহেতু এই মহলে (আঁতুড়ঘরে) এবং মেজাজে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এক্সক্লুশন আনে সাসপিশন। ক্যাথলিক এথিক্সে গসিপ হয়ে যায় পাপ। বেশির ভাগ ধর্মেই তা-ই। তবে মানুষ গসিপ করা থামায় না, যদিও দোষ গিয়ে লাগে মানুষের একাংশে, নারীর গায়ে।
নারীর গসিপকে কোপিং মেকানিজম বা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও দেখেন অনেকে। মার্ক্সিস্ট নারীবাদী স্কলার সিলভিয়া ফেদিরিচি বলেন, গসিপ সব সময়ই নারীবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ১৫০০ সালের পর ইংল্যান্ডে গসিপকে খারাপ বিষয় হিসেবে দেখা শুরু হয় কারণ, তখন নারীর ‘আদর্শ’ ইমেজের প্রচার শুরু হয়, যেখানে তাঁর যাবতীয় মনোযোগ নিবিষ্ট থাকবে স্বামী-সংসারে। আর জগতসংসারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হবে সীমিত। বাপের বা বান্ধবীর বাড়ি যাওয়াকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। মেয়েলি আলাপ বা ‘গার্ল টক’-কে শুধু অনুৎসাহিত করা হয়, তা নয়, বরং ১৫৪৭ সালে ইংল্যান্ডে ইশতেহার জারি হয়, যেখানে এ ধরনের অলস আলাপচারিতা ওরফে গসিপ নিষিদ্ধ করা হয়। আর স্বামীদের হুকুম করা হয়, তাদের স্ত্রীরা যাতে বাসায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে।
সেই জায়গা থেকে আমরা বিশাল উন্নতি করছি বললে পুরোপুরি সত্য হবে না। ‘গসিপে এখনো পাপ, পাপে এখনো নারী’। ইশতেহার না থাকলেও নারীর ফিসফিসানো জিহ্বা টেনে ধরা নিয়ে অনুচ্চারিত হুকুম এখনো সমাজে আছে।
তারকাদের ডিভোর্স কেন পাবলিকের মেজাজ খারাপ করে?
গসিপের ইতিহাস, ফজিলত ইত্যাদি নিয়ে আলাপের পরও অ্যাকচুয়াল তারকা-গসিপ এবং গসিপারদের নিয়ে আমিসহ অনেকেরই একটু উন্নাসিকতা কাজ করে। কেউ কেউ গসিপারদের ফেসবুকে গালি দেয়, ‘অমুকের তমুক হইছে, তাতে তোর কী?’ এরপর নিজের বিজনেস, চরকায় তেল, কাচের বাড়ির পাথর ডিউরাবিলিটি ইত্যাদি বিষয় অর্থনৈতিক উপদেশ।
আসলেই মানুষ কেন এত কেয়ার করে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, বিশেষ করে প্রেম-বিয়ে-ডিভোর্স নিয়ে?
মার্কিন লেখক লরেন মিশেল জ্যাকসন নিউ ইয়র্কারে ‘হাউ ডেয়ার সেলেব্রিটিস চিট?’ শিরোনামের লেখায় বলছেন, তারকারা চিট করলে মানুষ যত রাগ করে, তত রাগ গাড়ি দিয়ে কাউকে চাপা দিলেও করে না। এই অঞ্চলের সালমান খানের কেসই এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। খেয়াল করে দেখবেন, মানুষ তাঁর ‘ড্রাংক ড্রাইভিং’ নিয়ে কতটা দুঃখী আর কতটা পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে না করা নিয়ে।
লরেনের মতে, তারকাদের বিচ্ছেদ এবং বিশেষ করে চিটিং মানুষের নার্ভে খোঁচা দেয়। মনে করিয়ে দেয় যে কোনো টাকাপয়সা, খ্যাতি, সৌন্দর্য—কিছুই যথেষ্ট না পার্টনারকে এক নারী/পুরুষে আসক্ত করে রাখতে। অমুক হটশট তারকার পার্টনার যদি চিট করে বা তাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমার মতো যদুমধুর কী হবে—এই ইনসিকিউরিটিতে সে ভোগে এবং ভোগায়।
শুরু হয় ‘স্লাটশেমিং’ থেকে শুরু করে ‘ম্যানহেটিং’। জাত-কূল-পাত—সব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। মেয়েরা ছলনাময়ী থেকে চলে ‘ব্যাডামানুষ তো এমনই’। মাঝখানে যখন অভিষেক বচ্চনের চিটিংয়ের গুজব শোনা গিয়েছিল, তখন লোকে এক্স ভরিয়ে ফেলেছিল পোস্ট এবং মিমে; যার মোদ্দাকথা এই যে এত সুন্দরী বউ রেখে তুমি কীভাবে অসুন্দরীর সঙ্গে পরকীয়া করছ? সবচেয়ে প্রচলিত জোক ছিল, গ্যারেজে মার্সিডিজ রেখে কে টয়োটা চালায়?
এই পুরো ‘বিউটি কন্টেস্ট’ জনতার ইনসিকিউরিটির নির্দেশক। ঐশ্বরিয়াও যদি ইনাফ না হয়, তাহলে আমার কী চান্স? যত বেশি আদর্শ কাপল, তত বেশি জনতার ডিভোর্সের হার্টব্রেক। তাহসান-মিথিলা যেমন এক ‘বাংলাদেশি ড্রিম’কে রিপ্রেজেন্ট করত, যেখানে একই সঙ্গে আইবিএতে পড়ে পিএইচডি করে নাটক-সিনেমা করা যায়, হওয়া যায় ‘পাওয়ার কাপল’।
ঈদের আট দিনব্যাপী আয়োজনের তৃতীয় দিনে ‘জুটিদের ছুটি’ টাইপ নামের কোনো প্রোগ্রামে পাওয়ার কাপলেরা তাঁদের প্রেমকাহিনি শোনান। জনতা তার একাডেমিক-রোমান্টিক-ইকোনমিক—সব স্বপ্নের ঘুঁটা সেই কিসসায় খুঁজে পায়। সে জীবনে কী কী চায় এবং কোনটা পেলে কন্ডিশনালি আরেকটা পাওয়া যাবে, সেই ইমেজ পাকাপোক্ত হয়। এই ইমেজ ক্র্যাক হলে পাবলিকের মাথাও সাময়িক ক্র্যাক হবে, এটাও স্বাভাবিক। তারকারা যে এখানে পুরো ‘দায়মুক্ত’ তা নন। তাঁরাও এই ইমেজ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করেন কঠিন পিআর টিম দিয়ে। নিয়মিত নানা তথ্য জনতার পাতে তুলে দেয় যাতে পাবলিক অ্যাপিটাইট বজায় থাকে।
তবে ব্যক্তিগত জীবন পুরা বেআব্রু করতেও তারকারা রাজি নন স্বাভাবিকভাবেই। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রতিদিন ইন্সটায় ছবি দিয়ে বাঁধা অডিয়েন্সকে আরও বেঁধে রাখতেও তাঁরা ক্লান্ত। কিন্তু লাইক-কমেন্ট-সাবস্ক্রাইবের যুগে ‘নো কমেন্ট’ বলে কুলুপ আঁটা কঠিন।
যাঁরা গসিপ করেন এবং যাঁদের ব্যাপারে করা হয়—দুই পক্ষই মূলত তাঁদের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এই গসিপে খুঁজে পান। তবে গসিপ সেই টানাপোড়েন থেকে কাউকে নিস্তার দিতে পারে না।
ফিসফাস কখনো বন্ধ করা যাবে না, বিশাল কোনো প্রতিবাদের হাতিয়ারও হয়ে উঠবে না। কারণ, ৪০ ডেসিবেলের নিচের কোনো শব্দ খুব বেশি ওপরে পৌঁছাতে পারে না।
অনুপম রায় ও পিয়া চক্রবর্তীর ডিভোর্সের কত দিন পর পরমব্রত আর পিয়ার প্রেম হয়েছিল, এটা ইন্সটাগ্রাম স্টক করে আবিষ্কার করতে আমার লেগেছিলো মোট ২৭ মিনিটের কাছাকাছি। এত সময় লাগার কারণ পিয়ার ইন্সটাগ্রামে খুব কম ছবি আর পরমব্রত-অনুপমের ইন্সটা পিআর দিয়ে অতি সাবধানে কিউরেটেড। তাঁদের নানান ট্যাগড ছবি ধরে বন্ধুবান্ধবকে স্টক করে মোটামুটি একটা টাইমলাইন পেলাম। তখন হঠাৎ পিয়া চক্রবর্তীর লিংকডইন চোখে পড়ল। তার একাডেমিক ডিগ্রির বহর দেখে ডিপ্রেসড হয়ে গেলাম। মনে পড়ল, আমারও বিশিষ্ট ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার আশা ছিল একসময়। আর এখন এই আমি বিনোদন পাতার ‘নেটিজেন’দের মতো সেলেব্রিটি গসিপ দেখছি।
প্রচুর সেলফহেট নিয়ে আমি একটু ‘সিরিয়াস’ কিছু পড়ার ট্রাই করলাম। কিন্তু একটু পরই আবার গায়েবিভাবে ট্যাব চেঞ্জ হয়ে ‘নিউ ইয়র্কার’ থেকে ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে ব্যাক করল। টিম অনুপম ততক্ষণে টিম পরমব্রতকে ‘বন্ধু হয়েও কীভাবে বন্ধুর প্রাক্তনকে বিয়ে করলে?’ লাইনে গালিগালাজ বাদ দিয়ে ‘রাইমা সেনকে ধোঁকা দিয়ে কীভাবে পিয়াকে বিয়ে করলে?’ লাইনে গালিগালাজ শুরু করছে। এর মধ্যে আবার রাইমা সেন এসে পিয়া-পরমব্রতর বিয়ের পোস্টে অভিনন্দন জানিয়ে কমেন্ট করেছেন। এটিতে পিওর পাবলিক দিশাহারা বোধ করছে। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ মধুসূদনের মতো বলছে, একেই কি বলে সভ্যতা?
এর আগে টিম তাহসান আর টিম সৃজিতের কাইজ্জার সময়ও আমার একই নেশা হয়ে গিয়েছিল। এইবার দেব-শুভশ্রী আর শাকিব-অপু-বুবলী সাগার সময় আমি ঠিক করি যে– না, অনেক হইছে। আমি আর এমন শ্যালো গসিপখোর থাকব না। আই উইল বি আ বেটার পারসন।
কিন্তু যাঁরা সেলেব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাইতে গলাইতে পুরাপুরি ঢুকায় দেয়, তাঁরা কি খারাপ বা নিম্নমেধার লোকজন? কোনো বুদ্ধিমান মানুষ কি গসিপে আমোদ পায় না?
সিরিয়াস ইন্টেলেকচুয়ালরা কি গসিপ করে
১৯১৮ সালে বিখ্যাত লেখক ভার্জিনিয়া উলফ যখন মোটামুটিভাবে জনশূন্য এলাকা আশেশামে থাকেন, তখন তিনি তাঁর বন্ধুকে চিঠি লিখেন যে তিনি তীব্র একাকিত্বে ভুগছেন। তাঁর ভাষ্যে, তিনি হিউম্যান টাচ মানে গসিপ মিস করেন যেখানে মানুষ অনুভব করে তার আশেপাশে আরও মানুষ আছে, যাদের জীবনে নানা কিছু ঘটছে, যা ফিসফাস করার মতো ইন্টারেস্টিং। এর বাদে জীবন খুবই একাকী এবং নন-হিউম্যান।
জেন অস্টিন তাঁর উপন্যাস ‘পারসুয়েশন’-এ গসিপকে কিছুটা এভাবেই দেখিয়েছেন, গসিপ আমোদ দেয় এবং বোধ করায় যে আমি একটা বৃহত্তর জাতি বা স্পিসির অংশ, যে জাতিকে আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি গসিপ দিয়ে।
এইরকম আরও অনেক ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ দেওয়া সম্ভব গসিপের পক্ষে কিন্তু যেহেতু দুইটা দিয়ে আমি আমার ইন্টেলেকচুয়ালিটির একটু আভাস দিতে সফল হয়েছি, তাই ক্ষ্যান্ত দিলাম। আবার এই উদাহরণগুলা শুনে মনে হতে পারে, গসিপ শুধু বৃহত্তর মানবস্বার্থের আদর্শ কোনো বিষয়। এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। গসিপ পিওর বিনোদনও হতে পারে।
পালাব কোথায়?
মার্কিন লেখক জুলি ক্ল্যাম তাঁর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর লেখা ‘টু স্টে সেন, রিড মোর সেলেব্রিটি গসিপ’ -এর শুরুই করছেন এভাবে যে জগৎ এখন খুবই ভঙ্গুর আর ভায়োলেন্ট। ঘুম থেকে উঠেই দেখতে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আজ কয়টা দেশে নিউক্লিয়ার আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন। এই ডিপ্রেসিং দশায় গসিপ দেখা–কার প্রেম, কার ব্রেকাপ হলো দেখাই আমাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে, আশেপাশের সমস্যাগুলোকে ক্ষুদ্র বলে ফিল করায়।
মজার ব্যাপার হলো, এই জুলি ক্ল্যামের সেলেব্রিটি কালচার নিয়ে লেখা কূটিল-কঠিন বইও আছে। তারপরও তিনি তারকাবাজিকে ছোটবেলা থেকেই একটা ‘স্কেপ’ বা পলায়নপন্থা হিসেবে দেখেন, কখনো সেটা হোমওয়ার্ক থেকে, কখনো-বা ব্যক্তিগত বা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধাবস্থা থেকে।
লকডাউনের সময় কোন তারকা কী করেছেন, এটা আমি বিশদভাবে বলতে পারব। ২০২১ সালের যে দুই সপ্তাহ আমার মায়ের করোনা ছিল, তখন কাইলি জেনারের দিনলিপি আমার মুখস্থ। গসিপ দিয়ে বাস্তবতা থেকে পালানোর চেষ্টা আমরা সবাই করেছি। প্রচুর ট্র্যাজেডির লাইভ সাক্ষী হয়ে অ্যানা ক্যারেনিনার মতো ট্র্যাজিক ক্লাসিক পড়ে কোপ করা লোকের সংখ্যাই বরং কম।
‘গসিপ একটা মেয়েলি ব্যাপার’
মেয়েরা প্রচুর গসিপ করে, এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত। ব্যাটামানুষেরা কি তাহলে গসিপ করে না?
গসিপ শব্দটা আসছে ‘ গড-সিবলিং’ থেকে যার অর্থ হচ্ছে, এমন কোনো ব্যক্তি যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু এমন সখ্য (এবং ব্যাপটিজম বন্ড) আছে যে তার সঙ্গে গোপন কথা শেয়ার করা যায়। এখানে লিঙ্গের কোনো ব্যাপারস্যাপার নেই। তাহলে নারীর সঙ্গে গসিপকে যুক্ত করে দুয়ো দেওয়ার কালচারটার অরিজিন কই?
বৃটিশ রেঁনেসার সময় গসিপ বলতে সেসব সখিদের বোঝাত, যারা সন্তানপ্রসবের সময় উপস্থিত থাকে এবং নানাবিধ গল্প করে প্রসূতি মাকে ব্যস্ত রাখে। সোজা বাংলায়, অ্যানেস্থেশিয়াহীন যুগে ডিসকাউন্ট অ্যানেস্থেশিয়া বান্ধবীকূল।
এই ব্যথা প্রশমণকারী গসিপকে আবার ব্রিটিশ পুরুষেরা তখন ভালো চোখে দেখেনি, যেহেতু এই মহলে (আঁতুড়ঘরে) এবং মেজাজে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এক্সক্লুশন আনে সাসপিশন। ক্যাথলিক এথিক্সে গসিপ হয়ে যায় পাপ। বেশির ভাগ ধর্মেই তা-ই। তবে মানুষ গসিপ করা থামায় না, যদিও দোষ গিয়ে লাগে মানুষের একাংশে, নারীর গায়ে।
নারীর গসিপকে কোপিং মেকানিজম বা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও দেখেন অনেকে। মার্ক্সিস্ট নারীবাদী স্কলার সিলভিয়া ফেদিরিচি বলেন, গসিপ সব সময়ই নারীবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ১৫০০ সালের পর ইংল্যান্ডে গসিপকে খারাপ বিষয় হিসেবে দেখা শুরু হয় কারণ, তখন নারীর ‘আদর্শ’ ইমেজের প্রচার শুরু হয়, যেখানে তাঁর যাবতীয় মনোযোগ নিবিষ্ট থাকবে স্বামী-সংসারে। আর জগতসংসারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হবে সীমিত। বাপের বা বান্ধবীর বাড়ি যাওয়াকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। মেয়েলি আলাপ বা ‘গার্ল টক’-কে শুধু অনুৎসাহিত করা হয়, তা নয়, বরং ১৫৪৭ সালে ইংল্যান্ডে ইশতেহার জারি হয়, যেখানে এ ধরনের অলস আলাপচারিতা ওরফে গসিপ নিষিদ্ধ করা হয়। আর স্বামীদের হুকুম করা হয়, তাদের স্ত্রীরা যাতে বাসায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে।
সেই জায়গা থেকে আমরা বিশাল উন্নতি করছি বললে পুরোপুরি সত্য হবে না। ‘গসিপে এখনো পাপ, পাপে এখনো নারী’। ইশতেহার না থাকলেও নারীর ফিসফিসানো জিহ্বা টেনে ধরা নিয়ে অনুচ্চারিত হুকুম এখনো সমাজে আছে।
তারকাদের ডিভোর্স কেন পাবলিকের মেজাজ খারাপ করে?
গসিপের ইতিহাস, ফজিলত ইত্যাদি নিয়ে আলাপের পরও অ্যাকচুয়াল তারকা-গসিপ এবং গসিপারদের নিয়ে আমিসহ অনেকেরই একটু উন্নাসিকতা কাজ করে। কেউ কেউ গসিপারদের ফেসবুকে গালি দেয়, ‘অমুকের তমুক হইছে, তাতে তোর কী?’ এরপর নিজের বিজনেস, চরকায় তেল, কাচের বাড়ির পাথর ডিউরাবিলিটি ইত্যাদি বিষয় অর্থনৈতিক উপদেশ।
আসলেই মানুষ কেন এত কেয়ার করে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, বিশেষ করে প্রেম-বিয়ে-ডিভোর্স নিয়ে?
মার্কিন লেখক লরেন মিশেল জ্যাকসন নিউ ইয়র্কারে ‘হাউ ডেয়ার সেলেব্রিটিস চিট?’ শিরোনামের লেখায় বলছেন, তারকারা চিট করলে মানুষ যত রাগ করে, তত রাগ গাড়ি দিয়ে কাউকে চাপা দিলেও করে না। এই অঞ্চলের সালমান খানের কেসই এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। খেয়াল করে দেখবেন, মানুষ তাঁর ‘ড্রাংক ড্রাইভিং’ নিয়ে কতটা দুঃখী আর কতটা পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে না করা নিয়ে।
লরেনের মতে, তারকাদের বিচ্ছেদ এবং বিশেষ করে চিটিং মানুষের নার্ভে খোঁচা দেয়। মনে করিয়ে দেয় যে কোনো টাকাপয়সা, খ্যাতি, সৌন্দর্য—কিছুই যথেষ্ট না পার্টনারকে এক নারী/পুরুষে আসক্ত করে রাখতে। অমুক হটশট তারকার পার্টনার যদি চিট করে বা তাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমার মতো যদুমধুর কী হবে—এই ইনসিকিউরিটিতে সে ভোগে এবং ভোগায়।
শুরু হয় ‘স্লাটশেমিং’ থেকে শুরু করে ‘ম্যানহেটিং’। জাত-কূল-পাত—সব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। মেয়েরা ছলনাময়ী থেকে চলে ‘ব্যাডামানুষ তো এমনই’। মাঝখানে যখন অভিষেক বচ্চনের চিটিংয়ের গুজব শোনা গিয়েছিল, তখন লোকে এক্স ভরিয়ে ফেলেছিল পোস্ট এবং মিমে; যার মোদ্দাকথা এই যে এত সুন্দরী বউ রেখে তুমি কীভাবে অসুন্দরীর সঙ্গে পরকীয়া করছ? সবচেয়ে প্রচলিত জোক ছিল, গ্যারেজে মার্সিডিজ রেখে কে টয়োটা চালায়?
এই পুরো ‘বিউটি কন্টেস্ট’ জনতার ইনসিকিউরিটির নির্দেশক। ঐশ্বরিয়াও যদি ইনাফ না হয়, তাহলে আমার কী চান্স? যত বেশি আদর্শ কাপল, তত বেশি জনতার ডিভোর্সের হার্টব্রেক। তাহসান-মিথিলা যেমন এক ‘বাংলাদেশি ড্রিম’কে রিপ্রেজেন্ট করত, যেখানে একই সঙ্গে আইবিএতে পড়ে পিএইচডি করে নাটক-সিনেমা করা যায়, হওয়া যায় ‘পাওয়ার কাপল’।
ঈদের আট দিনব্যাপী আয়োজনের তৃতীয় দিনে ‘জুটিদের ছুটি’ টাইপ নামের কোনো প্রোগ্রামে পাওয়ার কাপলেরা তাঁদের প্রেমকাহিনি শোনান। জনতা তার একাডেমিক-রোমান্টিক-ইকোনমিক—সব স্বপ্নের ঘুঁটা সেই কিসসায় খুঁজে পায়। সে জীবনে কী কী চায় এবং কোনটা পেলে কন্ডিশনালি আরেকটা পাওয়া যাবে, সেই ইমেজ পাকাপোক্ত হয়। এই ইমেজ ক্র্যাক হলে পাবলিকের মাথাও সাময়িক ক্র্যাক হবে, এটাও স্বাভাবিক। তারকারা যে এখানে পুরো ‘দায়মুক্ত’ তা নন। তাঁরাও এই ইমেজ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করেন কঠিন পিআর টিম দিয়ে। নিয়মিত নানা তথ্য জনতার পাতে তুলে দেয় যাতে পাবলিক অ্যাপিটাইট বজায় থাকে।
তবে ব্যক্তিগত জীবন পুরা বেআব্রু করতেও তারকারা রাজি নন স্বাভাবিকভাবেই। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রতিদিন ইন্সটায় ছবি দিয়ে বাঁধা অডিয়েন্সকে আরও বেঁধে রাখতেও তাঁরা ক্লান্ত। কিন্তু লাইক-কমেন্ট-সাবস্ক্রাইবের যুগে ‘নো কমেন্ট’ বলে কুলুপ আঁটা কঠিন।
যাঁরা গসিপ করেন এবং যাঁদের ব্যাপারে করা হয়—দুই পক্ষই মূলত তাঁদের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এই গসিপে খুঁজে পান। তবে গসিপ সেই টানাপোড়েন থেকে কাউকে নিস্তার দিতে পারে না।
ফিসফাস কখনো বন্ধ করা যাবে না, বিশাল কোনো প্রতিবাদের হাতিয়ারও হয়ে উঠবে না। কারণ, ৪০ ডেসিবেলের নিচের কোনো শব্দ খুব বেশি ওপরে পৌঁছাতে পারে না।
সম্প্রতি মাহফুজ আলম থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সংবাদমাধ্যম ‘কনটেক্সট নিউজ’-কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি জুলাই অভ্যুত্থানসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। মো. তাহমিদ জামি’র নেওয়া সাক্ষাৎকারটি স্ট্রিম পাঠকদের জন্য অনূদিত হল।
১ দিন আগেবিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন রিডার’স ডাইজেস্ট এমনই ১০টি বইয়ের তালিকা তৈরি করেছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই তালিকায় বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইটির নামও আছে।
২ দিন আগেজয়া না বিপাশা– কে বেশি সুন্দর? দুই দিন ধরে ফেসবুকীয় বাহাসের শীর্ষে এই প্রশ্ন। শুনে মনে হতে পারে সালটা ২০০৪। যেখানে সদ্য গোঁফ-গজানো দুই কিশোর সিডির দোকানের বাইরে এই তর্কে-বিতর্কে মশগুল।
২ দিন আগে১৯৫০ সাল। মাত্র ২১ বছর বয়স তখন কিশোর কুমারের। বছর চারেক আগেই আভাস কুমার গাঙ্গুলী নাম পাল্টে হয়েছেন ‘কিশোর কুমার’। গায়ক হিসেবে তেমন পরিচিত নন তখনও। তাঁর দাদা অশোক কুমার সে সময় হিন্দি সিনেমার আইকনিক অভিনেতা। অশোকের ছোট ভাই হিসেবেই মানুষ তাঁকে চেনে।
২ দিন আগে