মাহবুবুল আলম তারেক
ফ্যাসিবাদের দায়ে গত বছর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ক্ষমতা হারায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। এবার ভারতে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধেও জোরালোভাবে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর সুপারস্টার বিজয় থালাপতি তাঁর নতুন রাজনৈতিক দলের রাজ্য সম্মেলনে মোদি ও বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যায়িত করেন।
মোদি ও বিজেপির বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তবে থালাপতির মতো এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি শুরু করার ঘটনা ভারতে এই প্রথম।
থালাপতির ওই বিশাল জনসভার ভিডিও বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ আলোড়ন তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় কি ফ্যাসিবাদের আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংস্করণ দেখা যাচ্ছে? এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের জন্য কতটা হুমকির?
ফ্যাসিবাদ কী
ফ্যাসিবাদের ধারণাটি এসেছে ইউরোপ থেকে। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি ও ইতালির দুটি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে। ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক দর্শন। স্বৈরাচারী জাতীয়তাবাদের একটি চরম রূপ। ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিক দর্শন, আন্দোলন বা শাসন ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এতে জাতিগত এবং বর্ণগত পরিচয়কে সবার ওপরে রাখা হয়। এটি কেন্দ্রীভূত স্বৈরশাসক ও তার শাসনের পক্ষে থাকে।
এতে কঠোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং বিরোধীদের জোরপূর্বক দমন করা হয়। এই মতাদর্শে একটি সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের দাবি থাকে। যেখানে একজন নেতা সব রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন। সেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম থাকে এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানো হয়। প্রয়োজনে সন্ত্রাসের ব্যবহারও ঘটে।
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি দখল ও নিয়ন্ত্রণ করেন। এই শাসনব্যবস্থা তীব্র জাতীয়তাবাদী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক, বৈশ্বিক কমিউনিজম-বিরোধী, সামরিকতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে।
ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সীমিত যোগাযোগ; নাগরিক স্বাধীনতার প্রায় বিলুপ্তি; রাজনৈতিক সমালোচনার কঠোর নিয়ন্ত্রণ; বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের আহ্বান; এসবের সঙ্গে আছে গণতন্ত্র-উত্তর ও শিল্পযুগ-উত্তর চরিত্র। উচ্চবিত্ত শিল্পপতিরাও ফ্যাসিবাদের বর্ণবাদী যুদ্ধে সমর্থন জোগায়।
বিশ্বের বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী দল ও আন্দোলন পরস্পর থেকে আলাদা হলেও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন চরম সামরিকায়িত জাতীয়তাবাদ, নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদারতাবাদের বিরোধিতা, প্রাকৃতিক আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবিভাজন এবং শীর্ষ নেতৃত্বের শাসনে বিশ্বাস। তারা এমন এক জনসমাজ গড়তে চায়, যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ কথিত জাতীয় কল্যাণের জন্য বাজেয়াপ্ত থাকবে।
তবে কোনও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদী নাও হতে পারে। জার্মানির হিটলারের নাৎসি রাষ্ট্রের মতো সমস্ত বৈশিষ্ট্য নাও থাকতে পারে। তবুও সেটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সমাজের মতো আচরণ করতে পারে।
নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি কতটা ফ্যাসিবাদী
বর্তমান ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে কিছু পার্থক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, গবেষকরা ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা নিয়ে একমত নন; তাঁরা একক কোনো সংজ্ঞায় পৌঁছাতে পারেননি। তবুও, ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব।
সেই নিরিখে ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ থেকে আলাদা হলেও বর্তমান ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা ও বিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর উত্থান ও বিকাশের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বিজেপি-আরএসএস বারবার ইতালির বেনিতো মুসোলিনি ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের দর্শন ও নীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। আরএসএস তাদের মতাদর্শ ও কৌশল ভারতেও অনুসরণ করতে চেয়েছে।
১৯৪৮ সালে বিজেপির জন্মদাত্রী সংগঠন আরএসএসের একজন সমর্থক এবং বর্তমান হিন্দুত্ববাদের প্রতীক নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আরএসএসকে নাৎসিদের মতোই ফ্যাসিবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। নাৎসিদের মতো আরএসএসও প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করেছিল।
বিজেপি প্রধান নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁকেও প্রায়ই ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা হয়। সমালোচক, বিরোধী নেতারা, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম— সকলেই এই অভিযোগ তুলেছেন। এই অভিযোগের প্রধান ভিত্তি হলো—হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শ (হিন্দুত্ব) প্রচার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (বিশেষত মুসলমানদের) বিরুদ্ধে সহিংসতাকে প্রশ্রয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল করা, ভিন্নমত দমন এবং কর্তৃত্ববাদী কায়দায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা।
২০২২ সালে রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী এক বিশ্লেষণে মোদিকে ‘একজন নিখুঁত, ক্লিনিক্যাল ফ্যাসিস্ট’ বলে অভিহিত করেন। তিনি ১৯৯০-র দশকের একটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বলেন— মোদি একাধারে সন্দেহপ্রবণ, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণপ্রিয় ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবসম্পন্ন।
এই মতামত বিভিন্ন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের রিপোর্টেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ২০২১ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক রানা আইয়ুব লেখেন, ‘ভারত এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই একটি ফ্যাসিবাদী ও হিন্দু মৌলবাদী রাষ্ট্র।’
এ প্রসঙ্গে তিনি মুসলমানদের ওপর ধারাবাহিক হামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। যেমন— গরুর মাংসের দোকান বন্ধে জোরপূর্বক নির্দেশ, গণপিটুনি, বজরং দল-সহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণ। শাহরুখ খানের ছেলের গ্রেপ্তারের ঘটনাকেও তুলে ধরে তিনি বলেন— ইসলাম বিদ্বেষের সমালোচনার ‘শাস্তি’ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালে ফরাসি লে মঁদ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘মোদি-ঘনিষ্ঠ চিন্তাবিদরা প্রকাশ্যে হিটলার ও মুসোলিনিকে পূজা করে।’ তিনি আরও বলেন, হিন্দুত্ববাদের লক্ষ্য হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা। রায় সতর্ক করেন, ‘হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ এখন সমাজের সর্বত্র ঢুকে পড়েছে।’
ভারতের কমিউনিস্টরা অবশ্য মোদিকে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদী বলতে নারাজ। দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে মতে, ২০২৫ সালের মার্চে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিআই (এম) জানায়, মোদি সরকার ফ্যাসিস্ট নয়, এমনকি নব্য-ফ্যাসিবাদীও নয়।
তাদের মতে, মোদি সরকারের মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য, যেমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বিদ্যমান। সিপিআই(এম) নেতা প্রকাশ কারাত বলেন, ‘আমরা বলছি না মোদি সরকার একটি ফ্যাসিবাদী বা নব্য-ফ্যাসিবাদী সরকার। তবে তাদের মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।’
সিপিআই (এম) তাদের এক প্রস্তাবে বিজেপিকে সরাসরি ‘ফ্যাসিবাদী’ না বলে একটি ‘হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত করে। তারা বলে, এর মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য থাকলেও এটি পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ নয়।
মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টিকেও (বিজেপি) আন্তর্জাতিক মহলে হরহামেশাই ফ্যাসিবাদের অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়। এই অভিযোগের পেছনে রয়েছে এর আরএসএসভিত্তিক আদর্শ এবং হিন্দুত্ববাদের প্রচার, যা অনেক গবেষকের মতে ডানপন্থী চরমপন্থার একটি রূপ।
২০২০ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা বই ও জার্নাল প্রকাশক টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস ‘হিন্দুত্ব: অ্যাজ অ্যা ভেরিয়েন্ট অব রাইট-উইং এক্সট্রিমিজম’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। গবেষণাটি করেছেন গণতন্ত্রবিরোধী রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ড. এভিয়ানে লেইডিগ। তিনি বলেন, হিন্দুত্বের উৎস ঔপনিবেশিক ভারতে এবং এর সঙ্গে ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি মতাদর্শীদের যোগাযোগ ছিল। তিনি হিন্দুত্ববাদকে ‘ডানপন্থী চরমপন্থার একটি সংস্করণ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
হিন্দুত্ববাদের প্রবতর্কদের চিন্তায় ফ্যাসিবাদ
হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের প্রাথমিক প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীর সাভারকর। ১৯৩৮ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের উচিত মুসলিম সমস্যা সমাধানে জার্মানির পথ অনুসরণ করা। জার্মানির নাৎসিবাদ ও ইতালির ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার ছিল—এবং ঘটনাপ্রবাহে সেই মতবাদগুলো সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।’
হিন্দুত্ববাদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর; তিনি আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান। তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে হিটলারের জার্মানির প্রশংসা। তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্তানে বিদেশি জাতিগুলোকে অবশ্যই তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে হিন্দু জাতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তারা কোনো ধরনের সুবিধা বা নাগরিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়।’
তিনি মনে করতেন, জার্মানির মতো জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই একটি জাতির অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এই মতবাদে বহুত্ববাদ বা ভিন্ন মত, ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিন্দি ভাষা, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু পুরাণ ও রাষ্ট্রের প্রতি অটুট আনুগত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একতার জন্য সংগ্রাম করে।
বিএস মুঞ্জে, যিনি আরএসএসের ঘনিষ্ঠ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন, ১৯৩১ সালের ১৯ মার্চ মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফরের পর তিনি আরএসএসকে ইতালীয় ফ্যাসিবাদী কায়দায় গঠনের জন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি হিন্দু যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণে জোর দেন।
এই তিন নেতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মকাণ্ডে একটি মিল পাওয়া যায়: তাঁরা মনে করতেন, জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি হতে হবে একজাতিক ও একধর্মীয়। তাদের মতে, জাতি গঠনে বহুত্ববাদ একটি অন্তরায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, জাতীয়তা মানেই বিভিন্নতা-বিরোধী একরূপতা। এমন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ফ্যাসিবাদের মিল রয়েছে।
ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সাধারণত সমাজকে ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’— দুভাগে ভাগ করে। ভারতে, আগে থেকেই বিদ্যমান হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি— বিশেষত আরএসএস ও বিজেপি— আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে মোদির ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে, তাঁর সরকার হিন্দু জনগণের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে গেছে।
এর ফলে, মুসলিমদের জনসম্মুখে অপমান করা, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে, নিজের বাসায় নামাজ পড়ার জন্যও মুসলিমদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোদি সরকার মুসলিমদের বৈষম্যকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গত কয়েকমাস ধরে ভারতজুড়ে বাংলাভাষী ও ভিন্ন উচ্চারণে কথা বলা মুসলিমদের অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে অভিযান চলছে। চলমান এই অভিযানের কারণে বর্তমানে ভারতের বাংলাভাষী ও মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন।
২০২৪ সালের মার্চে ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হয়েছে। ওই আইনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত ‘নিপীড়িত’ সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিষ্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও কোনও মুসলমানকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি। এভাবে বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠীকে কাল্পনিক শত্রু বানানো, এটাও ফ্যাসিবাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
নাৎসিরা যেমন জাতিগত বিশুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দিত, তেমনি হিন্দুত্ববাদেও হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবল চেষ্টা দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে গোলওয়ালকর একটি বইয়ে হিন্দু রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে বক্তব্য দেন। বর্তমানে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতিগত বিশুদ্ধতা অনুসন্ধানে একটি আধুনিক জেনেটিক ডেটাবেস তৈরি করছে। এটিকে অনেকেই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের একটি বিপজ্জনক ধারা হিসেবে দেখছেন।
মোদি শাসনে ভিন্নমতের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। এটিও একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার স্পষ্ট লক্ষণ। মোদিকে বলা হয়েছে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার শত্রু’। তাঁর আমলে সংবাদমাধ্যম ও একাডেমিক স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেক সময়, সংসদে বিতর্ক ছাড়াই আইন পাস করা হচ্ছে।
মোদির চারপাশে গড়ে উঠেছে একটি ব্যক্তিপূজাভিত্তিক ‘মোদি-সংস্কৃতি’, যা অনেকটা হিটলারের নেতৃত্ব কৌশলের অনুরূপ। মোদির ছবি সর্বত্র দেখা যায়। গোদি মিডিয়া, যা দলদাস গণমাধ্যম নামে পরিচিত, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এই মিডিয়া মোদির কর্মব্যস্ততা ও ‘পরিশ্রমী’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ব্যস্ত থাকে। এই মিডিয়া ঘৃণার ভাষা প্রচার করছে, শুধু মুসলিমদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং যেকোনো বিরোধী কণ্ঠের বিরুদ্ধেই।
ফ্যাসিবাদ ইতিহাসকেও বিকৃত করে। মৌলিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আক্রমণ করে। মোদি সরকারের অধীনে পাঠ্যবই থেকে আন্দোলন ও প্রতিবাদের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। এর জায়গায় যুক্ত হয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ও হিন্দুদের অতীত গৌরবগাথা।
ফ্যাসিবাদের আঞ্চলিক সংস্করণ
বিজেপি-আরএসএসের ফ্যাসিবাদ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, এর মূল উপাদানগুলো ভারতীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজিত— যেমন হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ, সংখ্যালঘু (বিশেষ করে মুসলিম) দমন, জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ ও কর্পোরেট-সমর্থিত কর্তৃত্ববাদ। এটাকে ‘গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’ বা ‘হিন্দু ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় গতিপথের সঙ্গে যুক্ত। ফলে একে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংস্করণ হিসেবে দেখা হয়।
২০২৩ সালে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য রাইজ অব স্যাফরন ফ্যাসিজম’ শিরোনামের একটি গবেষণায় বিজেপির প্রচারিত মতাদর্শকে ‘স্যাফরন বা গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়, এটি ফ্যাসিবাদের একটি স্থানীয়, আঞ্চলিক ও নতুন রূপ, যা গণতন্ত্রের মধ্যে প্রবাহিত হলেও, গড়ে উঠতে অনেক সময় নিলেও গণতন্ত্রকে ক্রমেই ক্ষয় করছে। এই ফ্যাসিবাদের পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছেও বলে সতর্ক করা হয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্য ফ্যাসিজম বিষয়ক এক চ্যাপ্টারে একে ‘হিন্দুত্ব: গেরুয়া ফ্যাসিবাদের উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে বিজেপির মতাদর্শকে ‘এথনিকালি বা নৃতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্রের’ স্বপ্ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের ২২ জুলাই দ্য ফোর্জ-এর ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ: দক্ষিণ এশিয়া থেকে শেখা পাঠ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ-এর বিস্তারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৩ সালে কাউন্টারকারেন্টস-এর একটি প্রবন্ধে ‘কর্পোরেট-গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’-কে ‘আরএসএস নব্য-ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য কতটা হুমকি
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। কারণ এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ বিজেপির ফ্যাসিবাদ থেকে বাড়তি শক্তি পেয়েছিল। ফলে এটি বাংলাদেশের জন্য এখনো বিশেষ হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এই ফ্যাসিবাদ যত শক্তিশালী হবে বাংলাদেশে আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার ঝুঁকিও বাড়বে। এ ছাড়া ভারতের বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ইতিমধ্যেই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গবেষকদের মতে, ভারতে যেভাবে সম্প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষমূলক অপরাধ বাড়ছে, তা ভারতের সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপি সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। ২০২৪ সালে বিজেপির টানা তৃতীয়বারের মতো জয় ভারতীয় সমাজে এমন কিছু সাংবিধানিক, বিচারিক ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যা ভারতের মুসলিম জনগণের দৈনন্দিন জীবনের পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।
বিজেপির উত্থান এবং ১২ বছর ক্ষমতায় থাকায় বর্তমান ভারতের অবস্থাকে বিশ শতকের জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হিন্দু সমাজ জাতীয় স্বার্থ এবং বৃহৎ সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির নামে একতাবদ্ধ হয়েছে, যা দুর্বল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। মোদি সরকারের ঘৃণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিজাত, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ থেকে যথেষ্ট প্রতিরোধ দেখানো হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত ভারতের সাবেক শাসক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) মুসলিমদের ভোট পেলেও মুসলিমদের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তা সংরক্ষণের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের কাছ থেকেই মুসলিমদের হতাশা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিকল্প খোঁজার দিকে ঠেলে দেবে। মুসলিমদের প্রতি ভারতের এই সম্মিলিত দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া এই প্রবণতাকে কেবল ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা আঞ্চলিক শান্তি বিঘ্নিত করার একটি শক্তিশালী কারণ হতে পারে।
তাই ভারতের মুসলিমদের দুর্দশা বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি যেকোনো ধরনের সমস্যা বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক। তবে এর বিশাল প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিষয়টি যথাযথ একাডেমিক ও মিডিয়া মনোযোগ এখনও পায়নি। বাংলাদেশের একাডেমিয়া, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ও নীতিনির্ধারণী নেতৃত্বের বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করা উচিত। যাতে বাংলাদেশ নিজের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারে। একই সঙ্গে এই বিষয়ে একটি ব্যাপক কৌশল তৈরি করতে পারে।
তথ্যসূত্র: রিসার্চ গেট, দ্য গার্ডিয়ান, হেমাল ম্যাগাজিন ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ফ্যাসিবাদের দায়ে গত বছর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ক্ষমতা হারায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। এবার ভারতে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধেও জোরালোভাবে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর সুপারস্টার বিজয় থালাপতি তাঁর নতুন রাজনৈতিক দলের রাজ্য সম্মেলনে মোদি ও বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যায়িত করেন।
মোদি ও বিজেপির বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ফ্যাসিবাদের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তবে থালাপতির মতো এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি শুরু করার ঘটনা ভারতে এই প্রথম।
থালাপতির ওই বিশাল জনসভার ভিডিও বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ আলোড়ন তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় কি ফ্যাসিবাদের আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংস্করণ দেখা যাচ্ছে? এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের জন্য কতটা হুমকির?
ফ্যাসিবাদ কী
ফ্যাসিবাদের ধারণাটি এসেছে ইউরোপ থেকে। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি ও ইতালির দুটি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে। ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক দর্শন। স্বৈরাচারী জাতীয়তাবাদের একটি চরম রূপ। ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিক দর্শন, আন্দোলন বা শাসন ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এতে জাতিগত এবং বর্ণগত পরিচয়কে সবার ওপরে রাখা হয়। এটি কেন্দ্রীভূত স্বৈরশাসক ও তার শাসনের পক্ষে থাকে।
এতে কঠোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং বিরোধীদের জোরপূর্বক দমন করা হয়। এই মতাদর্শে একটি সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের দাবি থাকে। যেখানে একজন নেতা সব রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন। সেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম থাকে এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানো হয়। প্রয়োজনে সন্ত্রাসের ব্যবহারও ঘটে।
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি দখল ও নিয়ন্ত্রণ করেন। এই শাসনব্যবস্থা তীব্র জাতীয়তাবাদী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক, বৈশ্বিক কমিউনিজম-বিরোধী, সামরিকতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে।
ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সীমিত যোগাযোগ; নাগরিক স্বাধীনতার প্রায় বিলুপ্তি; রাজনৈতিক সমালোচনার কঠোর নিয়ন্ত্রণ; বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের আহ্বান; এসবের সঙ্গে আছে গণতন্ত্র-উত্তর ও শিল্পযুগ-উত্তর চরিত্র। উচ্চবিত্ত শিল্পপতিরাও ফ্যাসিবাদের বর্ণবাদী যুদ্ধে সমর্থন জোগায়।
বিশ্বের বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী দল ও আন্দোলন পরস্পর থেকে আলাদা হলেও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন চরম সামরিকায়িত জাতীয়তাবাদ, নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদারতাবাদের বিরোধিতা, প্রাকৃতিক আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবিভাজন এবং শীর্ষ নেতৃত্বের শাসনে বিশ্বাস। তারা এমন এক জনসমাজ গড়তে চায়, যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ কথিত জাতীয় কল্যাণের জন্য বাজেয়াপ্ত থাকবে।
তবে কোনও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদী নাও হতে পারে। জার্মানির হিটলারের নাৎসি রাষ্ট্রের মতো সমস্ত বৈশিষ্ট্য নাও থাকতে পারে। তবুও সেটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সমাজের মতো আচরণ করতে পারে।
নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি কতটা ফ্যাসিবাদী
বর্তমান ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে কিছু পার্থক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, গবেষকরা ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা নিয়ে একমত নন; তাঁরা একক কোনো সংজ্ঞায় পৌঁছাতে পারেননি। তবুও, ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব।
সেই নিরিখে ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ থেকে আলাদা হলেও বর্তমান ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা ও বিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর উত্থান ও বিকাশের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বিজেপি-আরএসএস বারবার ইতালির বেনিতো মুসোলিনি ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের দর্শন ও নীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। আরএসএস তাদের মতাদর্শ ও কৌশল ভারতেও অনুসরণ করতে চেয়েছে।
১৯৪৮ সালে বিজেপির জন্মদাত্রী সংগঠন আরএসএসের একজন সমর্থক এবং বর্তমান হিন্দুত্ববাদের প্রতীক নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আরএসএসকে নাৎসিদের মতোই ফ্যাসিবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। নাৎসিদের মতো আরএসএসও প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করেছিল।
বিজেপি প্রধান নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁকেও প্রায়ই ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা হয়। সমালোচক, বিরোধী নেতারা, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম— সকলেই এই অভিযোগ তুলেছেন। এই অভিযোগের প্রধান ভিত্তি হলো—হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শ (হিন্দুত্ব) প্রচার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (বিশেষত মুসলমানদের) বিরুদ্ধে সহিংসতাকে প্রশ্রয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল করা, ভিন্নমত দমন এবং কর্তৃত্ববাদী কায়দায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা।
২০২২ সালে রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী এক বিশ্লেষণে মোদিকে ‘একজন নিখুঁত, ক্লিনিক্যাল ফ্যাসিস্ট’ বলে অভিহিত করেন। তিনি ১৯৯০-র দশকের একটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বলেন— মোদি একাধারে সন্দেহপ্রবণ, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণপ্রিয় ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবসম্পন্ন।
এই মতামত বিভিন্ন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের রিপোর্টেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ২০২১ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক রানা আইয়ুব লেখেন, ‘ভারত এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই একটি ফ্যাসিবাদী ও হিন্দু মৌলবাদী রাষ্ট্র।’
এ প্রসঙ্গে তিনি মুসলমানদের ওপর ধারাবাহিক হামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। যেমন— গরুর মাংসের দোকান বন্ধে জোরপূর্বক নির্দেশ, গণপিটুনি, বজরং দল-সহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণ। শাহরুখ খানের ছেলের গ্রেপ্তারের ঘটনাকেও তুলে ধরে তিনি বলেন— ইসলাম বিদ্বেষের সমালোচনার ‘শাস্তি’ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালে ফরাসি লে মঁদ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘মোদি-ঘনিষ্ঠ চিন্তাবিদরা প্রকাশ্যে হিটলার ও মুসোলিনিকে পূজা করে।’ তিনি আরও বলেন, হিন্দুত্ববাদের লক্ষ্য হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা। রায় সতর্ক করেন, ‘হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ এখন সমাজের সর্বত্র ঢুকে পড়েছে।’
ভারতের কমিউনিস্টরা অবশ্য মোদিকে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদী বলতে নারাজ। দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে মতে, ২০২৫ সালের মার্চে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিআই (এম) জানায়, মোদি সরকার ফ্যাসিস্ট নয়, এমনকি নব্য-ফ্যাসিবাদীও নয়।
তাদের মতে, মোদি সরকারের মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য, যেমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বিদ্যমান। সিপিআই(এম) নেতা প্রকাশ কারাত বলেন, ‘আমরা বলছি না মোদি সরকার একটি ফ্যাসিবাদী বা নব্য-ফ্যাসিবাদী সরকার। তবে তাদের মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।’
সিপিআই (এম) তাদের এক প্রস্তাবে বিজেপিকে সরাসরি ‘ফ্যাসিবাদী’ না বলে একটি ‘হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত করে। তারা বলে, এর মধ্যে নব্য-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য থাকলেও এটি পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ নয়।
মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টিকেও (বিজেপি) আন্তর্জাতিক মহলে হরহামেশাই ফ্যাসিবাদের অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়। এই অভিযোগের পেছনে রয়েছে এর আরএসএসভিত্তিক আদর্শ এবং হিন্দুত্ববাদের প্রচার, যা অনেক গবেষকের মতে ডানপন্থী চরমপন্থার একটি রূপ।
২০২০ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা বই ও জার্নাল প্রকাশক টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস ‘হিন্দুত্ব: অ্যাজ অ্যা ভেরিয়েন্ট অব রাইট-উইং এক্সট্রিমিজম’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। গবেষণাটি করেছেন গণতন্ত্রবিরোধী রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ড. এভিয়ানে লেইডিগ। তিনি বলেন, হিন্দুত্বের উৎস ঔপনিবেশিক ভারতে এবং এর সঙ্গে ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি মতাদর্শীদের যোগাযোগ ছিল। তিনি হিন্দুত্ববাদকে ‘ডানপন্থী চরমপন্থার একটি সংস্করণ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
হিন্দুত্ববাদের প্রবতর্কদের চিন্তায় ফ্যাসিবাদ
হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের প্রাথমিক প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীর সাভারকর। ১৯৩৮ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের উচিত মুসলিম সমস্যা সমাধানে জার্মানির পথ অনুসরণ করা। জার্মানির নাৎসিবাদ ও ইতালির ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার ছিল—এবং ঘটনাপ্রবাহে সেই মতবাদগুলো সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।’
হিন্দুত্ববাদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর; তিনি আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান। তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে হিটলারের জার্মানির প্রশংসা। তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্তানে বিদেশি জাতিগুলোকে অবশ্যই তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে হিন্দু জাতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তারা কোনো ধরনের সুবিধা বা নাগরিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়।’
তিনি মনে করতেন, জার্মানির মতো জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই একটি জাতির অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এই মতবাদে বহুত্ববাদ বা ভিন্ন মত, ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিন্দি ভাষা, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু পুরাণ ও রাষ্ট্রের প্রতি অটুট আনুগত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একতার জন্য সংগ্রাম করে।
বিএস মুঞ্জে, যিনি আরএসএসের ঘনিষ্ঠ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন, ১৯৩১ সালের ১৯ মার্চ মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফরের পর তিনি আরএসএসকে ইতালীয় ফ্যাসিবাদী কায়দায় গঠনের জন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি হিন্দু যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণে জোর দেন।
এই তিন নেতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মকাণ্ডে একটি মিল পাওয়া যায়: তাঁরা মনে করতেন, জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি হতে হবে একজাতিক ও একধর্মীয়। তাদের মতে, জাতি গঠনে বহুত্ববাদ একটি অন্তরায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, জাতীয়তা মানেই বিভিন্নতা-বিরোধী একরূপতা। এমন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ফ্যাসিবাদের মিল রয়েছে।
ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সাধারণত সমাজকে ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’— দুভাগে ভাগ করে। ভারতে, আগে থেকেই বিদ্যমান হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি— বিশেষত আরএসএস ও বিজেপি— আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে মোদির ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে, তাঁর সরকার হিন্দু জনগণের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে গেছে।
এর ফলে, মুসলিমদের জনসম্মুখে অপমান করা, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে, নিজের বাসায় নামাজ পড়ার জন্যও মুসলিমদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোদি সরকার মুসলিমদের বৈষম্যকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গত কয়েকমাস ধরে ভারতজুড়ে বাংলাভাষী ও ভিন্ন উচ্চারণে কথা বলা মুসলিমদের অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে অভিযান চলছে। চলমান এই অভিযানের কারণে বর্তমানে ভারতের বাংলাভাষী ও মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন।
২০২৪ সালের মার্চে ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হয়েছে। ওই আইনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত ‘নিপীড়িত’ সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিষ্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও কোনও মুসলমানকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি। এভাবে বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠীকে কাল্পনিক শত্রু বানানো, এটাও ফ্যাসিবাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
নাৎসিরা যেমন জাতিগত বিশুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দিত, তেমনি হিন্দুত্ববাদেও হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবল চেষ্টা দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে গোলওয়ালকর একটি বইয়ে হিন্দু রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে বক্তব্য দেন। বর্তমানে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতিগত বিশুদ্ধতা অনুসন্ধানে একটি আধুনিক জেনেটিক ডেটাবেস তৈরি করছে। এটিকে অনেকেই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের একটি বিপজ্জনক ধারা হিসেবে দেখছেন।
মোদি শাসনে ভিন্নমতের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। এটিও একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার স্পষ্ট লক্ষণ। মোদিকে বলা হয়েছে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার শত্রু’। তাঁর আমলে সংবাদমাধ্যম ও একাডেমিক স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেক সময়, সংসদে বিতর্ক ছাড়াই আইন পাস করা হচ্ছে।
মোদির চারপাশে গড়ে উঠেছে একটি ব্যক্তিপূজাভিত্তিক ‘মোদি-সংস্কৃতি’, যা অনেকটা হিটলারের নেতৃত্ব কৌশলের অনুরূপ। মোদির ছবি সর্বত্র দেখা যায়। গোদি মিডিয়া, যা দলদাস গণমাধ্যম নামে পরিচিত, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এই মিডিয়া মোদির কর্মব্যস্ততা ও ‘পরিশ্রমী’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ব্যস্ত থাকে। এই মিডিয়া ঘৃণার ভাষা প্রচার করছে, শুধু মুসলিমদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং যেকোনো বিরোধী কণ্ঠের বিরুদ্ধেই।
ফ্যাসিবাদ ইতিহাসকেও বিকৃত করে। মৌলিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আক্রমণ করে। মোদি সরকারের অধীনে পাঠ্যবই থেকে আন্দোলন ও প্রতিবাদের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। এর জায়গায় যুক্ত হয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ও হিন্দুদের অতীত গৌরবগাথা।
ফ্যাসিবাদের আঞ্চলিক সংস্করণ
বিজেপি-আরএসএসের ফ্যাসিবাদ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, এর মূল উপাদানগুলো ভারতীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজিত— যেমন হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ, সংখ্যালঘু (বিশেষ করে মুসলিম) দমন, জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ ও কর্পোরেট-সমর্থিত কর্তৃত্ববাদ। এটাকে ‘গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’ বা ‘হিন্দু ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় গতিপথের সঙ্গে যুক্ত। ফলে একে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংস্করণ হিসেবে দেখা হয়।
২০২৩ সালে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য রাইজ অব স্যাফরন ফ্যাসিজম’ শিরোনামের একটি গবেষণায় বিজেপির প্রচারিত মতাদর্শকে ‘স্যাফরন বা গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়, এটি ফ্যাসিবাদের একটি স্থানীয়, আঞ্চলিক ও নতুন রূপ, যা গণতন্ত্রের মধ্যে প্রবাহিত হলেও, গড়ে উঠতে অনেক সময় নিলেও গণতন্ত্রকে ক্রমেই ক্ষয় করছে। এই ফ্যাসিবাদের পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছেও বলে সতর্ক করা হয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্য ফ্যাসিজম বিষয়ক এক চ্যাপ্টারে একে ‘হিন্দুত্ব: গেরুয়া ফ্যাসিবাদের উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে বিজেপির মতাদর্শকে ‘এথনিকালি বা নৃতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্রের’ স্বপ্ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের ২২ জুলাই দ্য ফোর্জ-এর ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ: দক্ষিণ এশিয়া থেকে শেখা পাঠ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ-এর বিস্তারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৩ সালে কাউন্টারকারেন্টস-এর একটি প্রবন্ধে ‘কর্পোরেট-গেরুয়া ফ্যাসিবাদ’-কে ‘আরএসএস নব্য-ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য কতটা হুমকি
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। কারণ এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ বিজেপির ফ্যাসিবাদ থেকে বাড়তি শক্তি পেয়েছিল। ফলে এটি বাংলাদেশের জন্য এখনো বিশেষ হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এই ফ্যাসিবাদ যত শক্তিশালী হবে বাংলাদেশে আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার ঝুঁকিও বাড়বে। এ ছাড়া ভারতের বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ইতিমধ্যেই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গবেষকদের মতে, ভারতে যেভাবে সম্প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষমূলক অপরাধ বাড়ছে, তা ভারতের সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপি সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। ২০২৪ সালে বিজেপির টানা তৃতীয়বারের মতো জয় ভারতীয় সমাজে এমন কিছু সাংবিধানিক, বিচারিক ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যা ভারতের মুসলিম জনগণের দৈনন্দিন জীবনের পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।
বিজেপির উত্থান এবং ১২ বছর ক্ষমতায় থাকায় বর্তমান ভারতের অবস্থাকে বিশ শতকের জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হিন্দু সমাজ জাতীয় স্বার্থ এবং বৃহৎ সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির নামে একতাবদ্ধ হয়েছে, যা দুর্বল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। মোদি সরকারের ঘৃণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিজাত, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ থেকে যথেষ্ট প্রতিরোধ দেখানো হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত ভারতের সাবেক শাসক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) মুসলিমদের ভোট পেলেও মুসলিমদের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তা সংরক্ষণের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের কাছ থেকেই মুসলিমদের হতাশা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিকল্প খোঁজার দিকে ঠেলে দেবে। মুসলিমদের প্রতি ভারতের এই সম্মিলিত দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া এই প্রবণতাকে কেবল ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা আঞ্চলিক শান্তি বিঘ্নিত করার একটি শক্তিশালী কারণ হতে পারে।
তাই ভারতের মুসলিমদের দুর্দশা বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি যেকোনো ধরনের সমস্যা বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক। তবে এর বিশাল প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিষয়টি যথাযথ একাডেমিক ও মিডিয়া মনোযোগ এখনও পায়নি। বাংলাদেশের একাডেমিয়া, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ও নীতিনির্ধারণী নেতৃত্বের বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করা উচিত। যাতে বাংলাদেশ নিজের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারে। একই সঙ্গে এই বিষয়ে একটি ব্যাপক কৌশল তৈরি করতে পারে।
তথ্যসূত্র: রিসার্চ গেট, দ্য গার্ডিয়ান, হেমাল ম্যাগাজিন ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুব সহজ নয়। ২০২১ সাল থেকে মিয়ানমারে চলা গৃহযুদ্ধে রাখাইন রাজ্য অন্যত ম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, অন্যদিকে আরাকান আর্মি—উভয় পক্ষই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।
১৪ ঘণ্টা আগেইসরায়েলি আগ্রাসনে সৃষ্ট গাজার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও গণহত্যার দৃশ্য জার্মানদের মনে করিয়ে দিচ্ছে নিজেদের অতীত ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়—নামিবিয়া, লেনিনগ্রাদ, ওয়ারশ গেটো কিংবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াল স্মৃতি। তবুও আজ জার্মানির নেতারা হত্যাকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্রচুক্তি করছে, গণহত্যাকে ‘মানবিক সংকট’ আখ্য
১ দিন আগেপ্রতিবছর ২৫ আগস্টকে স্মরণ করা হয় রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে। ২০১৭ সালের এই সময়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে সময়ে মিয়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত সহিংসতা ও গণহত্যার শিকার হয়।
২ দিন আগেদ্বৈরথ ভুলে এরইমধ্যে নিজেদের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারত। এছাড়া ভিসা প্রক্রিয়া সহজকরণ এবং সীমান্ত বাণিজ্য বাড়ানোরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
২ দিন আগে