এবার নির্বাচন কমিশন ‘সবুজ ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন’ পরিচালনা করতে চায়। অতীতের অভিযোগ, বিশেষ করে প্রচারসামগ্রীর আধিক্য, পরিবেশ দূষণ ও আর্থিক বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যেই এবার নিয়মগুলো কঠোরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
স্ট্রিম ডেস্ক

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে গণভোটের তফসিল ঘোষণা হয়েছে বৃহস্পতিবার। নির্বাচন কমিশন এখন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ঝোলানো পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলতে রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইসি জানিয়ে দিয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব না সরালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আচরণবিধির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আজ শুক্রবার থেকে ভোট গ্রহণের দুদিন পর পর্যন্ত প্রতিটি উপজেলা ও থানায় কমপক্ষে দুজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের নির্দেশ দেওয়াও হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কশিমন গত ১১ নভেম্বর রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করে। এবার আচরণবিধি প্রণয়নে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নেয় নির্বাচন কমিশন।
‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’-এ নির্বাচনী প্রচারকে আরও সুশৃঙ্খল, পরিবেশবান্ধব ও ন্যায়সংগত করতে কঠোর নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০০৮ সালের আচরণবিধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কয়েকটি নতুন ও কঠোর বিধান যোগ করা হয়েছে।
এই আচরণবিধি ১৯৭২ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও)-এর ভিত্তিতে তৈরি। এতে স্বচ্ছতা, পরিবেশ রক্ষা এবং ডিজিটাল নীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের উপর এ বিধিমালা প্রযোজ্য।
আচরণবিধিতে ব্যানার, পোস্টার ও বিলবোর্ডসহ ভিজ্যুয়াল প্রচারসামগ্রীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ভিজ্যুয়াল দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ক্ষতি কমানো এবং ভোটারদের ওপর অযাচিত প্রভাব ঠেকানো।
পোস্টার
সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে (আচরণবিধির ধারা ৭)। এটি আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় একটি বড় পরিবর্তন; কারণ পোস্টার অতিরিক্ত বর্জ্য ও ভিজ্যুয়াল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রমও রাখা হয় নাই। ফলে পোস্টার ব্যবহার করা হলে তা স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
বিলবোর্ড
বিলবোর্ড ব্যবহার করা যাবে, তবে প্রতি প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ ২০টি পর্যন্ত। আকার ১৬ ফুট লম্বা ও ৯ ফুট চওড়া সীমার মধ্যে রাখতে হবে।
আলোকসজ্জায় শুধু ডিজিটাল বিলবোর্ডে বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করা যাবে। সাধারণ সজ্জা আলো নিষিদ্ধ।
ব্যানার ও অনুরূপ সামগ্রী
ব্যানার ব্যবহার করা যাবে, তবে তা সাদা-কালো হতে হবে। রঙ ব্যবহার করা যাবে না, যাতে ব্যয় কমে এবং পরিবেশের ক্ষতি কম হয়।
ব্যানারের আকার সর্বোচ্চ ১০ ফুট বাই ৪ ফুট; ফেস্টুন ১৮ ইঞ্চি বাই ২৪ ইঞ্চি; লিফলেট এ-ফোর সাইজের মধ্যে থাকতে হবে।
পিভিসি, পলিথিন, প্লাস্টিক, রেক্সিন বা অন্যান্য অ-পচনশীল উপাদান ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
ভোটার স্লিপ বিতরণ করা যাবে, তবে এতে প্রার্থীর নাম, ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না।
সাধারণ বিধান: প্রচারসামগ্রী স্থাপন, অনুমতি ও নিষেধাজ্ঞা
প্রচারসামগ্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, ধর্মীয় স্থান বা বিদেশে স্থাপন করা নিষিদ্ধ (ধারা ১৫ এবং ধারা ৬)।
প্রচার শুরুর আগে দল ও প্রার্থীকে বিস্তারিত প্রচার পরিকল্পনা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। এতে ব্যবহৃত প্রচারসামগ্রী ও অনলাইন প্রচারের জন্য ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্যও থাকতে হবে।
পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অতীতে পোস্টারবহুল প্রচারের কারণে যে ভিজ্যুয়াল দূষণ সৃষ্টি হয়েছিল তা রোধ করাই এর লক্ষ্য।
হেলিকপ্টার
হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে, তবে তা শুধু দলীয় শীর্ষ নেতাদের যাতায়াতের জন্য। কোনো প্রচারসামগ্রী নিক্ষেপ বা প্রদর্শন করা যাবে না।
লাউডস্পিকার
লাউডস্পিকার ব্যবহারের সংখ্যা প্রতি সমাবেশে সর্বোচ্চ ৩টি এবং পুরো আসনে সর্বোচ্চ ৯টি। শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের বেশি হতে পারবে না। ব্যবহার সময় সীমা দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা।
এই বিধানগুলো এবার নির্বাচন কমিশনের ‘সবুজ ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন’ পরিচালনার প্রচেষ্টার অংশ। অতীতের অভিযোগ, বিশেষ করে প্রচারসামগ্রীর আধিক্য, পরিবেশ দূষণ ও আর্থিক বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যেই এ নিয়মগুলো কঠোরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি হলো একটি বিস্তৃত নীতিমালা, যা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভুয়া বা বিকৃত তথ্য ও অযাচিত প্রভাব নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে শুধু প্রচারসামগ্রী নয়; বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, নৈতিকতা ও প্রচার কার্যক্রমের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত।
প্রধান নৈতিক নির্দেশনা
ঘৃণাসূচক বক্তব্য, ভুয়া বা বিকৃত তথ্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা কোনো উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিশেষত নারী, সংখ্যালঘু বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা যাবে না।
ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতি উসকে ভোট আদায়ের চেষ্টা নিষিদ্ধ।
প্রিন্ট, ডিজিটাল বা সম্প্রচার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারবিষয়ক কনটেন্ট শেয়ার করার আগে তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক। মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রচার করা যাবে না।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ডিপফেক, বিকৃত ছবি বা ভিডিও, অথবা যেকোনো ভুয়া ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার করা নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
প্রচারণায় ড্রোন বা অনুরূপ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। নির্বাচনের দিনও এসব নিষিদ্ধ থাকবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো যাবে, তবে ব্যবহৃত সব অ্যাকাউন্ট আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিবন্ধন করতে হবে। অনলাইনে ক্ষতিকর বা নিষিদ্ধ কন্টেন্ট পোস্ট করা যাবে না।
ইশতেহার
একটি আসনের সব প্রার্থীকে রিটার্নিং কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একই মঞ্চে যৌথভাবে ইশতেহার উপস্থাপন করতে হবে। এর লক্ষ্য স্বচ্ছতা বাড়ানো।
প্রচারণা
নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা নেওয়া যাবে না এবং প্রার্থীরা সরকারি সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না।
বিদেশে কোনো ধরনের প্রচারণা বা সমাবেশ করা নিষিদ্ধ।
নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
প্রতিটি প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণবিধি মানার লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে। কোনো বিধান লঙ্ঘিত হলে শাস্তি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত একই পরিমাণ জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।
ইসি তদন্ত পরিচালনা ও প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করতে পারবে (আরপিওর ৯১ ধারা অনুযায়ী)।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের ওপরও আচরণবিধির নজরদারি প্রয়োগ হবে; তারা কোনো ধরনের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।
এই আচরণবিধিতে পূর্ববর্তী সংস্করণের তুলনায় আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। জরিমানা তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পরিবেশবান্ধব প্রচারের ওপর আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আচরণবিধি ভঙ্গের কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে, যেমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পোস্টার লাগানো।
এবারের বিধানগুলোর উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত পরিবেশে নির্বাচনী প্রতিযোগিতাকে সমান রাখার সুযোগ তৈরি করা। ২০২৪ সালের আন্দোলন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে উত্তেজনা ও বৈষম্য কমানো, ছোট দলগুলোর খরচ কমানো এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক উসকানির ঝুঁকি হ্রাস করাই এ বিধানের অন্যতম লক্ষ্য। পোস্টার নিষিদ্ধকরণ ও বিলবোর্ড সীমিত করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভোটারদের দৃষ্টি ইশতেহার ও নীতিনির্ভর আলোচনার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
সমালোচকেরা মনে করেন, এসব বিধিনিষেধ কম পরিচিত প্রার্থীদের দৃশ্যমানতা কমাতে পারে। তবে সমর্থকেরা পরিবেশবান্ধব প্রচারণা ও ভুয়া তথ্য দমনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বিশাল ভোটারসংখ্যা (প্রায় ১২ কোটি ৭০ লাখ) এবং তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণের কারণে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আচরণবিধি পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার ঠেকানো না গেলে তা বিতর্ক ও নির্বাচনী বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য রাখতে এসব বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
এবার জাতীয় নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারের জন্য ২১ দিনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে কোনো সভা-সমাবেশ করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি নিতে হবে। প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিক প্রচার চালাতে চাইলে সেটিও প্রয়োজনীয় নজরদারির আওতায় রাখা হবে।
আচরণবিধির প্রয়োগ জোরদার করতে এ বছর ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি’র নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান ও বাস্তবায়ন কমিটি’ করা হয়েছে। এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন ৩০০ জন বিচারক। তারা শুধু আচরণবিধি মানা হচ্ছে কি না তা দেখবেন না; বরং কোনো লঙ্ঘন পেলেই তিন দিনের মধ্যে ইসিতে প্রতিবেদন দেবেন। তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে, ফলে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে তাৎক্ষণিক বিচার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে গণভোটের তফসিল ঘোষণা হয়েছে বৃহস্পতিবার। নির্বাচন কমিশন এখন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ঝোলানো পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলতে রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইসি জানিয়ে দিয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব না সরালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আচরণবিধির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আজ শুক্রবার থেকে ভোট গ্রহণের দুদিন পর পর্যন্ত প্রতিটি উপজেলা ও থানায় কমপক্ষে দুজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের নির্দেশ দেওয়াও হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কশিমন গত ১১ নভেম্বর রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করে। এবার আচরণবিধি প্রণয়নে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নেয় নির্বাচন কমিশন।
‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’-এ নির্বাচনী প্রচারকে আরও সুশৃঙ্খল, পরিবেশবান্ধব ও ন্যায়সংগত করতে কঠোর নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০০৮ সালের আচরণবিধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কয়েকটি নতুন ও কঠোর বিধান যোগ করা হয়েছে।
এই আচরণবিধি ১৯৭২ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও)-এর ভিত্তিতে তৈরি। এতে স্বচ্ছতা, পরিবেশ রক্ষা এবং ডিজিটাল নীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের উপর এ বিধিমালা প্রযোজ্য।
আচরণবিধিতে ব্যানার, পোস্টার ও বিলবোর্ডসহ ভিজ্যুয়াল প্রচারসামগ্রীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ভিজ্যুয়াল দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ক্ষতি কমানো এবং ভোটারদের ওপর অযাচিত প্রভাব ঠেকানো।
পোস্টার
সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে (আচরণবিধির ধারা ৭)। এটি আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় একটি বড় পরিবর্তন; কারণ পোস্টার অতিরিক্ত বর্জ্য ও ভিজ্যুয়াল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রমও রাখা হয় নাই। ফলে পোস্টার ব্যবহার করা হলে তা স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
বিলবোর্ড
বিলবোর্ড ব্যবহার করা যাবে, তবে প্রতি প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ ২০টি পর্যন্ত। আকার ১৬ ফুট লম্বা ও ৯ ফুট চওড়া সীমার মধ্যে রাখতে হবে।
আলোকসজ্জায় শুধু ডিজিটাল বিলবোর্ডে বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করা যাবে। সাধারণ সজ্জা আলো নিষিদ্ধ।
ব্যানার ও অনুরূপ সামগ্রী
ব্যানার ব্যবহার করা যাবে, তবে তা সাদা-কালো হতে হবে। রঙ ব্যবহার করা যাবে না, যাতে ব্যয় কমে এবং পরিবেশের ক্ষতি কম হয়।
ব্যানারের আকার সর্বোচ্চ ১০ ফুট বাই ৪ ফুট; ফেস্টুন ১৮ ইঞ্চি বাই ২৪ ইঞ্চি; লিফলেট এ-ফোর সাইজের মধ্যে থাকতে হবে।
পিভিসি, পলিথিন, প্লাস্টিক, রেক্সিন বা অন্যান্য অ-পচনশীল উপাদান ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
ভোটার স্লিপ বিতরণ করা যাবে, তবে এতে প্রার্থীর নাম, ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না।
সাধারণ বিধান: প্রচারসামগ্রী স্থাপন, অনুমতি ও নিষেধাজ্ঞা
প্রচারসামগ্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, ধর্মীয় স্থান বা বিদেশে স্থাপন করা নিষিদ্ধ (ধারা ১৫ এবং ধারা ৬)।
প্রচার শুরুর আগে দল ও প্রার্থীকে বিস্তারিত প্রচার পরিকল্পনা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। এতে ব্যবহৃত প্রচারসামগ্রী ও অনলাইন প্রচারের জন্য ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্যও থাকতে হবে।
পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অতীতে পোস্টারবহুল প্রচারের কারণে যে ভিজ্যুয়াল দূষণ সৃষ্টি হয়েছিল তা রোধ করাই এর লক্ষ্য।
হেলিকপ্টার
হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে, তবে তা শুধু দলীয় শীর্ষ নেতাদের যাতায়াতের জন্য। কোনো প্রচারসামগ্রী নিক্ষেপ বা প্রদর্শন করা যাবে না।
লাউডস্পিকার
লাউডস্পিকার ব্যবহারের সংখ্যা প্রতি সমাবেশে সর্বোচ্চ ৩টি এবং পুরো আসনে সর্বোচ্চ ৯টি। শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের বেশি হতে পারবে না। ব্যবহার সময় সীমা দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা।
এই বিধানগুলো এবার নির্বাচন কমিশনের ‘সবুজ ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন’ পরিচালনার প্রচেষ্টার অংশ। অতীতের অভিযোগ, বিশেষ করে প্রচারসামগ্রীর আধিক্য, পরিবেশ দূষণ ও আর্থিক বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যেই এ নিয়মগুলো কঠোরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি হলো একটি বিস্তৃত নীতিমালা, যা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভুয়া বা বিকৃত তথ্য ও অযাচিত প্রভাব নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে শুধু প্রচারসামগ্রী নয়; বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, নৈতিকতা ও প্রচার কার্যক্রমের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত।
প্রধান নৈতিক নির্দেশনা
ঘৃণাসূচক বক্তব্য, ভুয়া বা বিকৃত তথ্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা কোনো উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিশেষত নারী, সংখ্যালঘু বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা যাবে না।
ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতি উসকে ভোট আদায়ের চেষ্টা নিষিদ্ধ।
প্রিন্ট, ডিজিটাল বা সম্প্রচার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারবিষয়ক কনটেন্ট শেয়ার করার আগে তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক। মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রচার করা যাবে না।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ডিপফেক, বিকৃত ছবি বা ভিডিও, অথবা যেকোনো ভুয়া ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার করা নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
প্রচারণায় ড্রোন বা অনুরূপ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। নির্বাচনের দিনও এসব নিষিদ্ধ থাকবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো যাবে, তবে ব্যবহৃত সব অ্যাকাউন্ট আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিবন্ধন করতে হবে। অনলাইনে ক্ষতিকর বা নিষিদ্ধ কন্টেন্ট পোস্ট করা যাবে না।
ইশতেহার
একটি আসনের সব প্রার্থীকে রিটার্নিং কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একই মঞ্চে যৌথভাবে ইশতেহার উপস্থাপন করতে হবে। এর লক্ষ্য স্বচ্ছতা বাড়ানো।
প্রচারণা
নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা নেওয়া যাবে না এবং প্রার্থীরা সরকারি সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না।
বিদেশে কোনো ধরনের প্রচারণা বা সমাবেশ করা নিষিদ্ধ।
নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
প্রতিটি প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণবিধি মানার লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে। কোনো বিধান লঙ্ঘিত হলে শাস্তি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত একই পরিমাণ জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।
ইসি তদন্ত পরিচালনা ও প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করতে পারবে (আরপিওর ৯১ ধারা অনুযায়ী)।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের ওপরও আচরণবিধির নজরদারি প্রয়োগ হবে; তারা কোনো ধরনের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।
এই আচরণবিধিতে পূর্ববর্তী সংস্করণের তুলনায় আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। জরিমানা তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পরিবেশবান্ধব প্রচারের ওপর আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আচরণবিধি ভঙ্গের কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে, যেমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পোস্টার লাগানো।
এবারের বিধানগুলোর উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত পরিবেশে নির্বাচনী প্রতিযোগিতাকে সমান রাখার সুযোগ তৈরি করা। ২০২৪ সালের আন্দোলন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে উত্তেজনা ও বৈষম্য কমানো, ছোট দলগুলোর খরচ কমানো এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক উসকানির ঝুঁকি হ্রাস করাই এ বিধানের অন্যতম লক্ষ্য। পোস্টার নিষিদ্ধকরণ ও বিলবোর্ড সীমিত করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভোটারদের দৃষ্টি ইশতেহার ও নীতিনির্ভর আলোচনার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
সমালোচকেরা মনে করেন, এসব বিধিনিষেধ কম পরিচিত প্রার্থীদের দৃশ্যমানতা কমাতে পারে। তবে সমর্থকেরা পরিবেশবান্ধব প্রচারণা ও ভুয়া তথ্য দমনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বিশাল ভোটারসংখ্যা (প্রায় ১২ কোটি ৭০ লাখ) এবং তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণের কারণে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আচরণবিধি পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার ঠেকানো না গেলে তা বিতর্ক ও নির্বাচনী বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য রাখতে এসব বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
এবার জাতীয় নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারের জন্য ২১ দিনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে কোনো সভা-সমাবেশ করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি নিতে হবে। প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিক প্রচার চালাতে চাইলে সেটিও প্রয়োজনীয় নজরদারির আওতায় রাখা হবে।
আচরণবিধির প্রয়োগ জোরদার করতে এ বছর ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি’র নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান ও বাস্তবায়ন কমিটি’ করা হয়েছে। এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন ৩০০ জন বিচারক। তারা শুধু আচরণবিধি মানা হচ্ছে কি না তা দেখবেন না; বরং কোনো লঙ্ঘন পেলেই তিন দিনের মধ্যে ইসিতে প্রতিবেদন দেবেন। তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে, ফলে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে তাৎক্ষণিক বিচার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

বর্তমানে বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে, আর ভারত মহাসাগর অঞ্চল হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রস্থল। এ অঞ্চলে চীন তার ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশল ও ‘ব্লু ওয়াটার নেভি’ নিয়ে প্রভাব বিস্তার করছে, যা দিল্লির জন্য সরাসরি নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
৮ ঘণ্টা আগে
বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশের পর এ আলোচনা আরও জোরালো হয়।
১ দিন আগে
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) তাদের বহর আধুনিকায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। শক্তিশালী অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুন কিনতে ইতালীয় প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিও’র সঙ্গে চুক্তি করেছে। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিমানবাহিনী সদর দপ্তরে এই সম্মতিপত্র সই করা হয়।
২ দিন আগে
চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ৩৩ পৃষ্ঠার নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) প্রকাশ করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা সবার আগে’ ধারণাকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে।
৩ দিন আগে