leadT1ad

ধনী দেশগুলোতে কাজের জন্য অভিবাসন কেন কমছে

আল-জাজিরা এক্সপ্লেইনার
আল-জাজিরা এক্সপ্লেইনার

স্ট্রিম গ্রাফিক

সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত ও ধনী দেশগুলোতে শ্রমবাজার দুর্বল হয়ে পড়ছে। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো ভিসা নীতি কঠোর করায় গত বছর কাজের উদ্দেশ্যে অভিবাসন ২০ শতাংশেরও বেশি বা এক-পঞ্চমাংশ কমেছে। ৩৮টি ধনী ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ নিয়ে গঠিত ‘অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে’র (ওইসিডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কাজের উদ্দেশ্যে অভিবাসন বা ‘লেবার মাইগ্রেশন’ কমেছে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের সংখ্যা কমানোর আগেই ‘কমার’ এই প্রবণতা শুরু হয়।

কোভিড-১৯ মহামারির পর বিশ্বব্যাপী কয়েক বছর ধরে অভিবাসনের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। কিন্তু গত বছর ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে স্থায়ী কাজের জন্য অনুমোদিত মানুষের সংখ্যা ২১ শতাংশ কমে প্রায় ৯ লাখ ৩৪ হাজারে নেমে এসেছে।

এই পতনের বড় কারণ হলো ভিসা নীতির কড়াকড়ি। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে ২০২৪ সালে নেট মাইগ্রেশন বা মোট অভিবাসন ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। তবে যেসব দেশে নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি, সেখানেও লেবার মাইগ্রেশন কমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অধিকাংশ দেশে এই সংখ্যা ২০১৯ সালের স্তরের নিচে নেমে গেছে।

কেন এখন কাজের উদ্দেশ্যে অভিবাসন কমছে?

ওইসিডির আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিভাগের প্রধান জঁ-ক্রিস্টোফ ডুমন্ট বলেন, এই মন্দার পেছনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি বড় কারণ।

এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫ সালের জন্য তাদের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ০ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধকে এর অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেসব দেশ ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী গ্রহণ করত, তারা এখন প্রবেশের নিয়ম কঠোর করেছে। গত দুই বছরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য—সবাই কাজের উদ্দেশ্যে অভিবাসন সীমিত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

ডুমন্ট আরও উল্লেখ করেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার পুরোদস্তুর আগ্রাসনের পর বিপুল সংখ্যক ইউক্রেনীয় ইউরোপে অস্থায়ী সুরক্ষা পেয়েছেন। এর ফলে বিভিন্ন খাতে শ্রম ঘাটতি কিছুটা কমেছে, যা বিদেশি কর্মীদের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।

ওইসিডির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত আনুমানিক ৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় এখন ওইসিডি সদস্য দেশগুলোতে বসবাস করছেন।

শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের আগমন কমলেও, মানবিক কারণে অভিবাসন বাড়ার ফলে ২০২৪ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে মোট স্থায়ী অভিবাসন আগের বছরের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাত্র ৪ শতাংশ কমেছে।

অন্যান্য ধরনের অভিবাসনের কী অবস্থা?

ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নতুন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় কঠোর ভিসা নীতি এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। অভিবাসন সংক্রান্ত জালিয়াতি ও স্থানীয় আবাসন বাজারের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যেই মূলত এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

এর বিপরীতে, মানবিক কারণে অভিবাসন বেড়েই চলেছে। গত বছর বাইডেন প্রশাসনের শেষ মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের আবেদন বা ‘এসাইলাম অ্যাপ্লিকেশন’ বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইইউ দেশগুলো থেকে ছোট নৌকায় করে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে আগমনের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের আগমন কমলেও, মানবিক কারণে অভিবাসন বাড়ার ফলে ২০২৪ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে মোট স্থায়ী অভিবাসন আগের বছরের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাত্র ৪ শতাংশ কমেছে।

তবুও ২০২৪ সালে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন বা ৬২ লাখ নতুন মানুষ এসেছে, যা মহামারি-পূর্ব স্তরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। তবে ‘টেম্পোরারি লেবার মোবিলিটি’ (যেসব ভিসায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নেই) প্রায় ২ দশমিক ৩ মিলিয়নে স্থির আছে।

অভিবাসনের সংখ্যা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?

২০২৩ সালে রেকর্ড সংখ্যক ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা ৬৫ লাখ মানুষ ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। যা ২০২২ সালের আগের রেকর্ড ৬ মিলিয়নের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি । সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল যুক্তরাজ্যে।

২০২৩ সালে ওইসিডির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দেশে রেকর্ড মাত্রার অভিবাসন দেখা গেছে, যার মধ্যে কানাডা, ফ্রান্স ও জাপান অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ১ দশমিক ২ মিলিয়ন স্থায়ী বৈধ অভিবাসী গ্রহণ করেছিল। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণা অভিবাসন কমানোর ওপর ভিত্তি করেই সাজিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের গবেষণায় দেখা গেছে য, ২০২৩ সালে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পেছনে অভিবাসনই প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রেও এটি ৪০ লাখেরও বেশি নতুন চাকরি যুক্ত করেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল প্ল্যান সমন্বয় করতে ১৯৪৮ সালে ওইসিডি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে ইউরোপীয় সদস্যদের মধ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাণিজ্য বাধা দূর করার ওইসিডি ফোরাম হিসেবে কাজ করত।

ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে?

ডুমন্ট ধারণা করছেন, ২০২৫ সালে ওইসিডি দেশগুলোতে সামগ্রিক অভিবাসন সামান্য কমতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অভিবাসন নীতি সত্ত্বেও উচ্চ পর্যায়েই থাকবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, শ্রমবাজারে অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের হার বেশ শক্তিশালী।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীদের কর্মসংস্থানের হার ছিল প্রায় ৭৬ শতাংশ—যা স্থানীয় বা দেশে জন্ম নেওয়া কর্মীদের হারের চেয়ে সামান্য বেশি।

ডুমন্ট এর কারণ হিসেবে দুটি বিষয় উল্লেখ করেন: প্রথমত, উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন পদের জন্য ভিসা স্কিম চালু থাকা; এবং দ্বিতীয়ত, স্বল্প-দক্ষ অভিবাসীরা এমন কাজগুলো করতে ইচ্ছুক যা যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা করতে চান না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অভিবাসন বিষয়ক সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ফাবিওলা মিয়ারেস আল জাজিরাকে বলেন, ‘কৃষি, নির্মাণ ও স্বাস্থ্য খাতের মতো ক্ষেত্রগুলোতে (যেখানে অভিবাসী কর্মীরা বেশি কাজ করেন) স্থানীয় শ্রমিকের ঘাটতি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। স্পষ্টতই, ন্যূনতম মজুরি ও কাজের পরিবেশ এই সমস্যার একটি অংশ।’

মিয়ারেস আরও বলেন, ‘অভিবাসন সম্ভবত বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েই থাকবে। কারণ এই ইস্যু মানুষের মধ্যে প্রচুর আবেগ ও উত্তেজনা তৈরি করে।’

ওইসিডি কী?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল প্ল্যান সমন্বয় করতে ১৯৪৮ সালে ওইসিডি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে ইউরোপীয় সদস্যদের মধ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাণিজ্য বাধা দূর করার ওইসিডি ফোরাম হিসেবে কাজ করত।

১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে যখন ইউরোপের পুনর্গঠন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বৈশ্বিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে অন্তর্ভুক্ত করে ওইসিডি তার সদস্যপদ সম্প্রসারিত করে।

পরবর্তী কয়েক দশকে ওইসিডি এশিয়া প্যাসিফিক, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মাধ্যমে আটলান্টিক-কেন্দ্রিক গ্রুপ থেকে উন্নত ও উদীয়মান দেশগুলোর বৃহত্তর কমিউনিটিতে পরিণত হয় সংস্থাটি।

বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ওইসিডি অর্থনৈতিক গবেষণা, নীতি বিশ্লেষণ ও শাসনের মানদণ্ড উন্নয়নের কেন্দ্রীয় হাবে পরিণত হয়। শিক্ষা, শ্রমবাজার এবং পরিবেশ নীতি নিয়ে কাজ ও গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে।

২০১৯ সালে ওইসিডি বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর অন্তত ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাবনা পেশ করে। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকারগুলোর মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা কর প্রতিযোগিতার অবসান ঘটানো।

২০২১ সালের অক্টোবরে জি-২০ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার ফলে গুগল, আমাজন, ফেসবুক, মাইক্রোসফট ও অ্যাপলের মতো বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য কম করের দেশে অফিস খুলে কর ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক্সপ্লেইনার। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত