leadT1ad

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় জামায়াতের কী লাভ

ভোট দিলেন বটে, কিন্তু সংসদে কোনো আসন পেল না আপনার দল। এটাই ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’-ব্যবস্থার শুভঙ্করের ফাঁকি। ভোটের সংখ্যা নয়, এখানে জয় নির্ধারিত হয় অল্পের ব্যবধানে। এই ‘সমস্যা’ ঠেকাতে অনেকের দাবি ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা’। কেন জামায়াত এই ব্যবস্থায় আগ্রহী, আর কোন দল কেন বিরোধী—তা নিয়ে এই বিশ্লেষণ।

রাতুল আল আহমেদ
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১৬: ৫৫
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ১৯: ৩৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

গণতন্ত্রের মূল দর্শন হলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আর সে জন্যই ভোট-ব্যবস্থা। প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি ভোট সমান গুরুত্বপূর্ণ। সরকার গঠনে প্রত্যেক ভোটারের ইচ্ছা যথাযথভাবে উঠে আসা উচিৎ। তবে বাস্তবে সব ধরনের নির্বাচনীব্যবস্থা এই লক্ষ্য সমানভাবে অর্জন করতে পারে না।

বাংলাদেশ, ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান এমন দেশে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’-ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থায় পুরো দেশকে নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনে ভাগ করা হয়। নির্দিষ্ট আসনে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান, তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। শুনতে ভালো লাগলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। ধরা যাক, একটি রাজনৈতিক দল সারা দেশের ভোটারদের থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেল; কিন্তু বেশিরভাগ আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে তারা হেরে গেল। ফলে দেখা যাচ্ছে, মোট ভোটারদের ৪০ শতাংশের প্রতিনিধি সংসদে অনুপস্থিত। বলা যায়, এ ভোটগুলো ‘নষ্ট’ হচ্ছে। বিপরীতে আরেকটি দল মোট ভোটের ৩৭ শতাংশ পেল বটে, কিন্তু অধিকাংশ আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে জিতে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলো তারা। এই জয়ী সরকার চাইলে সংসদে একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি করতে পারে। ফলে অনেকের আশঙ্কা, গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এ অবস্থা।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা কী

এর সমাধান হিসেবে অনেক গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা (পিআর) চালু করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট আসনের সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয় না। বরং এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট যেন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে পার্টি তালিকা পদ্ধতি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে একটি প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করে। ভোটাররা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীকে নয়, একটি দলকে ভোট দেন। নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পায়, সেই অনুপাতে তার তালিকা থেকে প্রার্থীরা সংসদে নির্বাচিত হন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটাররা কীভাবে বুঝবেন কে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যাচ্ছেন?

তারও বেশকিছু উপায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দিন তারিখ ঠিক করলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা কমিশনের কাছে জমা দেয়।

এ তালিকা ঠিক করারও রয়েছে দুইটি ধরন। এর একটি হলো সুনির্দিষ্ট তালিকা, আর অপরটি উন্মুক্ত তালিকা।

সুনির্দিষ্ট তালিকায় দল শুরুতেই ঠিক করে দেয় প্রার্থীদের কে কোন অবস্থানে থাকবেন। আর উন্মুক্ত তালিকার ক্ষেত্রে ভোটাররা দলের মধ্যে পছন্দের প্রার্থীও বেছে নিতে পারেন। উন্মুক্ত তালিকার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড, যেখানে সংসদীয় নির্বাচনে ভোটাররা শুধুই দল নয় বরং দলের ভেতরের প্রার্থীকেও আলাদাভাবে ভোট দেন। এভাবে যে প্রার্থী বেশি ভোট পান, তিনি তালিকায় ওপরের দিকে উঠে আসেন এবং সংসদে যাওয়ার সুযোগ পান।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়—যদিও নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে জোহরান মামদানির মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্থানীয় ও দলীয় নির্বাচন–সেটাও কিছুটা উন্মুক্ত তালিকার মত। এখানে দলীয় ভোটাররা প্রাথমিক ভোটের মাধ্যমে ঠিক করেন, কে প্রার্থী হবেন। মামদানি সেখানে জনপ্রিয় হয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

আরেকটু সহজ করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, বাংলাদেশের তিন শ আসনের বিপরীতে রাজনৈতিক দল ‘ক’ নির্বাচন কমিশনের কাছে তিন শ প্রার্থীর একটি তালিকা জমা দিল। দলটি ১৫ শতাংশ ভোট পেল নির্বাচনী ফলাফলে। ফলে, দলটি কমিশনের কাছে জমা দেওয়া লিস্টের প্রথম ৪৫ জন প্রার্থীকে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পাঠাবে।

অনেকে এখন প্রশ্ন করতে পারেন, তবে কি নির্দিষ্ট আসন থেকে জনগণের কোনো প্রতিনিধি থাকবে না?

উত্তর হচ্ছে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় দলীয় অনুপাতের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়; কোনো ভৌগোলিক আসনের ভিত্তিতে নয়। সংসদ সদস্যরা এখানে পুরো দেশের একটি নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে একটি দলীয় আদর্শ বা নীতিকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

তবে, এই পদ্ধতির আরও একটি সংস্করণ রয়েছে। তা হলো আঞ্চলিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় দেশকে কিছু বড় অঞ্চল যেমন ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, ইত্যাদিতে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা প্রার্থী তালিকা তৈরি করা হয়। এই মডেলে যদি ‘ক’ দল ঢাকা বিভাগে ৩০ শতাংশ ভোট পায় এবং ধরে নিই ঢাকা বিভাগ থেকে ২০টি আসন বরাদ্দ, তাহলে ‘ক’ দল এ বিভাগে পাবে ৬টি আসন।

তখন প্রশ্ন উঠবে, কে হবে এই ছয়জন?

দলটি নির্বাচন কমিশনে যে ‘ঢাকা বিভাগীয় প্রার্থী তালিকা’ জমা দিয়েছিল, সে তালিকার প্রথম ছয়জনই হবেন সংসদ সদস্য। এখন যদি উন্মুক্ত তালিকা পদ্ধতি হয়, তাহলে দলটির ভোটাররাও তালিকার মধ্যে প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন। যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন, তাঁর স্থান হবে তালিকায় ওপরে।

এই আঞ্চলিক তালিকা পদ্ধতি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা দূর করে। এতে নিশ্চিত হয়, প্রতিটি অঞ্চল থেকে নির্দিষ্টসংখ্যক সংসদ সদস্য থাকবে। অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্বও বজায় থাকে এ ব্যবস্থায়।

এভাবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা নয়, বরং দলীয় সমর্থনের ভিত্তিতে একজন প্রার্থী সংসদে প্রবেশ করেন। এতে ছোট দলগুলোর পক্ষে সংসদে প্রবেশের সুযোগ বাড়ে এবং একক আধিপত্য কমে আসে।

বাংলাদেশে এ পদ্ধতি কীভাবে কাজ করতে পারে

সংসদ সদস্যদের মূল কাজ আইনপ্রণয়ন হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাঁরা তাঁদের আসনের উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হতে পারে। সংসদ সদস্যদের যদি সুনির্দিষ্ট আসনই না, থাকে তবে তাঁরা এই উন্নয়নে সামিল হবেন কীভাবে।

উত্তর হচ্ছে, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সক্রিয় ও জোরালো করে তোলা। উন্নয়নমূলক কাজ, রাস্তা, ড্রেন বা স্কুল মেরামতের মতো বিষয়গুলো পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ বা জেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর সংসদ সদস্যদের কাজ হবে জাতীয় বাজেট, আইন ও নীতিনির্ধারণে অংশ নেওয়া। ফলে জনগণের দাবি প্রথমে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কাছে যাবে, পরে সেগুলো জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরবেন সংসদ সদস্যরা।

জামায়াত কেন এই ব্যবস্থা চায়

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় নির্বাচনের দাবি জানালেও তা কার্যকর হয়নি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। গঠিত হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এ সংস্কার কমিশনে একাধিক দল সংখ্যানুপাতিক হারে ভোটের দাবি জানান। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি সংখ্যানুপাতিক হারে ভোট-ব্যবস্থায় একমত হতে পারেনি। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই ভোট চায়। বিপরীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেখা যায় প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর-ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে।

কেন বিএনপি বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভোট চায়? আর জামায়াতই বা কেন জোর দিচ্ছে পিআর ব্যবস্থার ওপর?

উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশের সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ তিনটি নির্বাচন বেছে নেওয়ার কারণ হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে আয়োজিত এই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নিরপেক্ষ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’-ব্যবস্থায় বড় দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্পষ্ট সুবিধা পেলেও জামায়াতের মতো দলগুলো কম আসন পেয়েছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬টি আসন পেলেও পিআর পদ্ধতিতে তারা পেত ১১২টি। অপরদিকে জামায়াত ৮.৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে পায় মাত্র ৩টি আসন, যেখানে পিআর পদ্ধতিতে তারা পেত প্রায় ২৬টি।

২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ ভোটে পায় ১৯৩টি আসন, যা পিআর পদ্ধতিতে নেমে দাঁড়াত ১২৩টি আসনে। জামায়াত পায় ৪.২৮ শতাংশ ভোটে ১৭টি আসন, যেখানে পিআর পদ্ধতি অনুযায়ী হতো ১৩টি। তবে এই নির্বাচনে তারা বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল, ফলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থী ছিল না।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ ভোটে পায় ২৩০টি আসন, যা পিআর পদ্ধতিতে হতো মাত্র ১৪৪টি। জামায়াত ৪.৭ শতাংশ ভোটে পায় মাত্র ২টি আসন, অথচ পিআর পদ্ধতিতে পদ্ধতিতে তারা পেত অন্তত ১৪টি। এই নির্বাচনেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট ছিল।

এ থেকে বোঝা যায়, পিআর পদ্ধতিতে জামায়াতের মতো দলগুলো কেন আগ্রহী। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তারা ভোট পেলেও কার্যত এ ভোটগুলো ‘হারিয়ে’ যায়। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় ভোট হলে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে অনেক বেশি গুরুত্ব পেত। একইসঙ্গে বাস্তব ভোটের অনুপাতে সংসদে আরও বেশি জায়গা করে নিতে পারত জামায়াত।

Ad 300x250

সম্পর্কিত