leadT1ad

দক্ষিণ এশিয়ায় অভ্যুত্থান: তরুণেরা কেন অভিজাতদের বিরুদ্ধে

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১৩
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে জমে থাকা কয়েক দশকের ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়েছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

শ্রীলঙ্কার রাজপথ, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও রাজপথ, হিমালয়ের উচ্চভূমির শীতল মরু অঞ্চল লাদাখ কিংবা নেপালের অলিগলি—সর্বত্রই এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের ঢেউ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে জমে থাকা কয়েক দশকের ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়েছে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের পতন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পলায়ন এবং নেপালে তীব্র গণ-আন্দোলনে সরকারের পতন— ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এই আন্দোলনের পেছনের ভাষা ও কারণগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হলেও আছে এক অভিন্ন চালিকাশক্তি। ‘এলিট ক্যাপচার’ বা মুষ্টিমেয় অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের জিম্মি হয়ে পড়ার বিরুদ্ধে এসবই তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত দ্রোহ।

এই তরুণেরা কোনো নির্দিষ্ট নেতা বা দলের বিরুদ্ধে লড়ছে না; তারা লড়ছে একটি পচে যাওয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। যে ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ, প্রতিষ্ঠান ও নীতি—সবকিছুই সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে একটি ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। গণতন্ত্রের নামে চলা এই প্রাতিষ্ঠানিক লুণ্ঠন আর ফাঁপা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যখন তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, তখনই তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের বার্তা স্পষ্ট: সাজানো কোনো ব্যবস্থায় আর তাদের আস্থা নেই।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের পতন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পলায়ন এবং নেপালে তীব্র গণ-আন্দোলনে সরকারের পতন— ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়।

এই ক্ষোভের উৎস বুঝতে হলে জানতে হবে, কীভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক—প্রতিটি স্তরে এই ‘এলিট ক্যাপচার’ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের তরুণদের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তবে এই চিত্র কেবল এই তিনটি দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারেও একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে— যা এই আঞ্চলিক জাগরণকে আরও গভীর তাৎপর্য দিয়েছে।

রাজনৈতিক দখল: রাষ্ট্র যখন পারিবারিক সম্পত্তি বা দলীয় ক্লাব

এই দেশগুলোতে এলিটদের রাষ্ট্র দখলের প্রথম ধাপ ছিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবার রাষ্ট্রকে প্রায় পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল। সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপতির হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে তারা একটি আইনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরিবারের সদস্য ও অনুগতদের রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে তারা সম্পদ আহরণের জন্য একটি নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তখন ভোট দেওয়াটা একটা অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশে এই দখল প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হয়েছে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে একটি কার্যকর একদলীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত সবকিছুই দলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকারের বড় বড় চুক্তি, লাইসেন্স ও নীতিগত সুবিধাগুলো পেয়েছে দলের কাছের ব্যবসায়ী ও নেতারা। ফলে এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়, যেখানে জনগণের ভূমিকা দর্শক হওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

এই ক্ষোভের উৎস বুঝতে হলে জানতে হবে, কীভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক—প্রতিটি স্তরে এই ‘এলিট ক্যাপচার’ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের তরুণদের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তবে এই চিত্র কেবল এই তিনটি দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারেও একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে— যা এই আঞ্চলিক জাগরণকে আরও গভীর তাৎপর্য দিয়েছে।

নেপালের চিত্র আরও জটিল। সেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও বাস্তবে কয়েকটি দলের শীর্ষস্থানীয় কিছু বয়স্ক নেতা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন। আদর্শের ভিত্তিতে নয়, বরং ক্ষমতার ভাগাভাগি আর দুর্নীতির সুযোগ বণ্টনের ভিত্তিতে তাদের জোট তৈরি হয়। এই রাজনৈতিক রাজনৈতিক সিন্ডিকেট বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক জোট একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে, যেখানে সাধারণ তরুণদের প্রবেশাধিকার নেই। রাজনীতি যখন এমন একটি বন্ধ দরজার ক্লাবে পরিণত হয়, তখন তরুণদের ক্ষোভ রাস্তায় আছড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।

এই চিত্রের ভিন্ন কিন্তু আরও শক্তিশালী রূপ দেখা যায় ভারত ও মিয়ানমারে। ভারতে গণতন্ত্রের কাঠামো থাকলেও একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক-করপোরেট আঁতাত রাষ্ট্রীয় নীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে হাতেগোনা কয়েকটি করপোরেট গোষ্ঠীর অস্বাভাবিক উত্থান এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের প্রভাব এক নতুন ধরনের অভিজাততন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে ভারতের লাদাখে। ২০১৯ সালে লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পর সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে দিল্লির আমলাতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পদক্ষেপকে স্থানীয়রা তাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও স্বতন্ত্র পরিচয় মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে।

ভারতে গণতন্ত্রের কাঠামো থাকলেও একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক-করপোরেট আঁতাত রাষ্ট্রীয় নীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে হাতেগোনা কয়েকটি করপোরেট গোষ্ঠীর অস্বাভাবিক উত্থান এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের প্রভাব এক নতুন ধরনের অভিজাততন্ত্রের জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে, মিয়ানমার এই এলিট দখলের সবচেয়ে নৃশংস উদাহরণ। সেখানে রাষ্ট্র সরাসরি সামরিক জান্তার দখলে। সেনাবাহিনী বা ‘তাতমাদো’ শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা দেশের অর্থনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রশাসনিক কাঠামোকেও নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।

অর্থনৈতিক দখল: উন্নয়নের আড়ালে লুণ্ঠন

রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। এই তিনটি দেশেই এলিটরা অর্থনীতিকে নিজেদের পকেট ভরার যন্ত্রে পরিণত করেছিল, আর সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব আর ঋণের বোঝায়।

শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। রাজাপক্ষে পরিবার ঋণ করে এমন সব বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, যা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই ছিল না কিন্তু সেখান থেকে কমিশন পাওয়ার সুযোগ ছিল প্রচুর। অন্যদিকে, ধনীদের জন্য কর ছাড়ের মতো নীতিগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শূন্য করে দেয়। যখন অর্থনীতি ভেঙে পড়ল তখন সাধারণ মানুষ খাবার আর জ্বালানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল, আর এলিটরা বিদেশে জমানো সম্পদে আয়েশে দিন কাটাচ্ছিল।

বাংলাদেশে ‘উন্নয়নের বিস্ময়কর’ গল্পের আড়ালে চলছিল এক শোষণের অর্থনৈতিক মডেল। তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে মুষ্টিমেয় মালিক, আর শ্রমিকদের মজুরি থেকেছে অবহেলিত। ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, কিন্তু তাদের কোনো বিচার হয়নি। শিক্ষিত তরুণদের জন্য এই ‘কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন’ ছিল এক নিষ্ঠুর পরিহাস।

নেপালের অর্থনীতি এলিটদের জন্য ‘রেমিট্যান্স আহরণের যন্ত্র’ হিসেবে কাজ করেছে। দেশের ভেতরে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এতটাই সীমিত যে তরুণদের জন্য বিদেশে সস্তা শ্রম বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বাংলাদেশে ‘উন্নয়নের বিস্ময়কর’ গল্পের আড়ালে চলছিল এক শোষণের অর্থনৈতিক মডেল। তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে মুষ্টিমেয় মালিক, আর শ্রমিকদের মজুরি থেকেছে অবহেলিত। ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, কিন্তু তাদের কোনো বিচার হয়নি।

ভারত একদিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, অন্যদিকে অক্সফামের মতো সংস্থার রিপোর্ট বলছে, দেশটির সম্পদের সিংহভাগই মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত। তরুণদের জন্য মানসম্মত চাকরির অভাব, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব আর আকাশছোঁয়া জীবনযাত্রার ব্যয় দেশটির ‘উন্নয়ন’ গল্পের আড়ালের কঠিন বাস্তবতা। তরুণদের ক্ষোভ এখানে রাস্তায় সহিংস বিপ্লব হিসেবে আবির্ভূত না হলেও তা হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা ও বিকল্প পথের সন্ধান হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক বঞ্চনার এক জ্বলন্ত উদাহরণ লাদাখের আন্দোলন। স্থানীয়দের অভিযোগ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর তাদের ভূমির উপর করপোরেট গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারে অর্থনীতি পুরোপুরি সামরিক এলিটদের নিয়ন্ত্রণে। জেড পাথর, বনজ সম্পদ থেকে শুরু করে দেশের সব লাভজনক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন দুটি বৃহৎ করপোরেশন—এমইএইচএল ও এমইসি। দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে একটি ক্ষুদ্র সামরিক গোষ্ঠী ধনী হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধের মধ্যে নিষ্পেষিত হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে।

প্রশাসনিক বিচারিক দখল: রক্ষকই যখন ভক্ষক

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখলকে টেকসই করতে এলিটরা প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মেধার পরিবর্তে অনুগতদের সরকারি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্দোলনের সূত্রপাত, যা রূপ নেয় তীব্র সরকার বিরোধী আন্দোলনে।

নেপালে এই সামাজিক দখলের বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে ‘#NepoBaby’ হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে। যেখানে পারিবারিক পরিচয়ই সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায় এবং যোগ্যতা ও মেধার কোনো মূল্য থাকে না, সেই স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই ছিল তরুণদের এই প্রতিবাদ।

একইভাবে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক নিয়োগ একটি সাধারণ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারি দপ্তরগুলো সাধারণ মানুষের সেবার পরিবর্তে এলিটদের স্বার্থরক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যখন কোনো কাজ করার জন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ বা ঘুষ অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র আর জনগণের থাকে না।

এর চূড়ান্ত ধাপ হলো বিচারব্যবস্থাকে দখল করা। তিনটি দেশেই বড় বড় দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনায় শীর্ষস্থানীয় এলিটদের কারও বিচার হওয়ার নজির প্রায় নেই। আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে সমালোচকদের দমন করতে। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যার চাক্ষুষ প্রমাণ। যখন বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচারের বদলে এলিটদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তরুণদের ক্ষোভ বিদ্রোহে রূপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না।

অন্যদিকে ভারতে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ব্যবহার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রায়শই ওঠে। মিয়ানমারে কোনো স্বাধীন প্রশাসন বা বিচারব্যবস্থার অস্তিত্বই নেই; সবকিছু চলে সামরিক জান্তার নির্দেশে। ফলে রাষ্ট্র পরিণত হয় একটি নিপীড়নের যন্ত্রে। লাদাখের ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক দখলের চিত্র স্পষ্ট। সেখানে স্থানীয় সমস্যার সমাধানের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে। আন্দোলনকে দমন করতে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; জলবায়ু কর্মী সোনাম ওয়াংচুক-সহ একাধিক আন্দোলনকারীকে জাতীয় সুরক্ষা আইনের মতো কঠোর আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা নেপালের তরুণেরা শুধু সরকারের পতন ঘটায়নি, তারা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার এলিট শাসকদের কাছে ‘ডিজিটাল যুগে তথ্য আর চাপা থাকে না’ — এই শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম বা ইতিহাসের দোহাই দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আর বোকা বানানো যাবে না।

সামাজিক দখল: বিভাজন আর স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি

নিজেদের শাসনকে বৈধতা দিতে এলিটরা সমাজে বিভাজনের রাজনীতি উসকে দেয়। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসেরা সিংহলী-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে সঙ্গে রেখেছিল, যাতে তাদের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের দিকে কারও নজর না যায়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর বংশগত অধিকারে পরিণত করা হয়েছিল, যা তরুণদের মধ্যে তীব্র অবিচারের বোধ তৈরি করে।

নেপালে এই সামাজিক দখলের বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে ‘#NepoBaby’ হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে। যেখানে পারিবারিক পরিচয়ই সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায় এবং যোগ্যতা ও মেধার কোনো মূল্য থাকে না, সেই স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই ছিল তরুণদের এই প্রতিবাদ।

একইভাবে, ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের তরুণদের এই বিদ্রোহ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরে চলা বঞ্চনা, অবিচার আর চুরি হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে এক অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া।

চুরি হওয়া ভবিষ্যতের পুনরুদ্ধার

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের তরুণদের এই বিদ্রোহ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরে চলা বঞ্চনা, অবিচার আর চুরি হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে এক অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া। যখন একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, যখন গণতন্ত্র পরিণত হয় একটি প্রহসনে আর যখন আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয় না, তখন সেই রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়ে।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা নেপালের মতো ভারত বা মিয়ানমারে একই ধরনের গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। এর কারণ প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ভারতের বিশাল ভৌগোলিক বিস্তার, গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় দমনযন্ত্রের শক্তি একটি দেশব্যাপী আন্দোলনকে কঠিন করে তোলে। তবে কৃষক আন্দোলন বা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী বিক্ষোভের মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, অসন্তোষের বারুদ সেখানেও মজুদ রয়েছে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে, এলিটদের দখল এতটাই নিরঙ্কুশ যে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে আরও ভয়াবহ। সেখানে তরুণদের দ্রোহ রূপ নিয়েছে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা নেপালের তরুণেরা শুধু সরকারের পতন ঘটায়নি, তারা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার এলিট শাসকদের কাছে ‘ডিজিটাল যুগে তথ্য আর চাপা থাকে না’ — এই শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম বা ইতিহাসের দোহাই দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আর বোকা বানানো যাবে না। একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি উপেক্ষা করার পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, কলম্বো, ঢাকা আর কাঠমান্ডুর রাজপথ সেটাই দেখিয়ে দিয়েছে। এই বিদ্রোহ একটি নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের প্রথম ধাপ, যেখানে নিয়মগুলো সবার জন্য সমান হবে এবং দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পরিবর্তে ৯৯ শতাংশ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত