.png)
আজ ২৪ অক্টোবর, বিশ্ব জাতিসংঘ দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে শান্তি ও সহযোগিতার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এই সংস্থা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নে ফাটল ধরেছে। ভেটো রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক বিভাজন, জলবায়ু বিপর্যয়—সব মিলিয়ে জাতিসংঘ এখন অস্ত্বিত্ব সংকটে। তাই বারবার প্রশ্ন জাগছে, জনগণের আস্থা কি এখনও জাতিসংঘের সঙ্গে আছে, নাকি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে?

তুফায়েল আহমদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল জাতিসংঘ। একুশ শতকে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক মহামারির সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা কারোরই অজানা নয়। বড় বড় দেশগুলোর তোয়াক্কা না করার স্বভাব এবং অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোর জাতিসংঘের ওপর ক্রমাগত হতাশা এক জটিল পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে।
সাধারণ মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে তৈরি এই সংস্থা তাই ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষেরই আস্থা হারাচ্ছে। বিভিন্ন জনমত, বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ ও ভূরাজনৈতিক অচলাবস্থার বাস্তবতা আমাদের বলছে, জাতিসংঘ ক্রমশ আস্থাহীনতার গভীর স্রোতে আটকে পড়ছে। যদিও অনেক বিশ্বনেতা ও সাধারণ মানুষ এখনো এর প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে নারাজ।
জনমতের মিশ্র রায়
সাম্প্রতিক জরিপগুলো জাতিসংঘ সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরস্পরবিরোধী চিত্র তুলে ধরেছে। ২০২৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৩৫টি দেশের মধ্যে গড়ে ৫৮ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এই জরিপে কেনিয়া, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন এবং থাইল্যান্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশও অংশ নিয়েছিল।

তবে এই সংখ্যা বেশ কিছু দেশের সাধারণ মানুষের জাতিসংঘের প্রতি অনাস্থার ইঙ্গিতকেও আড়াল করেছে। একই জরিপ বলছে, যুক্তরাজ্যে এক বছরের মধ্যেই জাতিসংঘ সম্পর্কে ইতিবাচক মত ৭২ শতাংশ থেকে কমে ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। একই প্রবণতা দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনমত আরও বিভক্ত। পিউ-এর জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ আমেরিকান জাতিসংঘকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, যা আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ কম। অন্যদিকে গ্যালাপের একই বছরের আরেক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৩ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন বিশ্ব বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ ‘ভালো কাজ করছে’। এর বিপরীতে ৫৮ শতাংশের মতে জাতিসংঘ ‘কাজের কাজ কিছু করতে পারছে না’।
২০২৪-এ ২৮টি দেশে ৩২ হাজার মানুষের ওপর করা এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার সমীক্ষায় জাতিসংঘের প্রতি আস্থা দেশভেদে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন দেখা গেছে। ভারত ও কেনিয়ায় ৭৭ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘ ‘সঠিক কাজ করবে’ বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু জাপান ও আর্জেন্টিনায় এই সংখ্যা মাত্র ৩৮ শতাংশ।
জাতিসংঘের প্রতি আস্থার এই পতন নতুন কিছু নয়। বৈশ্বিক জনসংযোগ সংস্থা এডেলম্যানের রিপোর্ট মতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ২৭টি দেশের ২৩টিতেই জাতিসংঘের প্রতি আস্থা উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে।
জরিপগুলো বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও গাজায় গণহত্যায় জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা আস্থা কমে যাওয়ার মূল কারণ।
ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার
জাতিসংঘের প্রতি অসন্তোষ ও হতাশার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নিরাপত্তা পরিষদ। এই পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য—চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা প্রায়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। এই বিশেষাধিকার দেশগুলোকে যেকোনো প্রস্তাব আটকে দেওয়ার সুযোগ দেয়। ফলে জরুরি সংকট মোকাবিলায় পরিষদ প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং গাজার চলমান গণহত্যায় বারবার ভেটো প্রয়োগ দেখিয়েছে কীভাবে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
এই ধারাবাহিক অচলাবস্থা জাতিসংঘের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। সিঙ্গাপুরের কূটনীতিক টমি কোহের মতে, ‘এটি জাতিসংঘের জন্মগত ত্রুটি, যার কোনো চিকিৎসা নেই।’ কোহের মতে, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় এই ক্ষমতা হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু এখন এই পাঁচ দেশ কখনোই স্বেচ্ছায় ভেটোর ক্ষমতা ত্যাগ করবে না।
ভেতর থেকেও উদ্বেগের স্বর
জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ শুধু বাইরের সমালোচকদের নয়, সংস্থার ভেতরের নেতারাও বহুবার তা স্বীকার করেছেন। বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘আস্থার ভাঙন এখন মূল্যবোধের ভাঙনে’ পরিণত হচ্ছে।
গুতেরেসের মতে, জাতিসংঘকে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করতে হবে এবং কাজের ধরনে সংস্কার আনতে হবে। এখন সময় এসেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুই স্তরেই ‘মানুষ ও নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের’। গুতেরেস আহ্বান জানিয়েছেন, জাতিসংঘকে ‘প্রক্রিয়ার চেয়ে ফলাফলে’ এবং ‘আমলাতন্ত্রের চেয়ে মানুষের ওপর’ বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
তাঁর আগের মহাসচিবরাও একই সুর তুলেছিলেন। প্রয়াত কফি আনান বারবার বলেছেন, জাতিসংঘের আদর্শ ও বাস্তব পারফরম্যান্সের মধ্যে একটা ফাঁক আছে। কফি আনান বিশ্বাস করতেন, ‘আমরা সবাই এক মানব জাতির অংশ’ এবং জাতিসংঘ সেই যৌথ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অপরিহার্য।

কফি আনানের উত্তরসূরি বান কি মুন বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিভাজনই জাতিসংঘের বড় বাধা। বিস্তৃত সমস্যার সমাধান আসে বিস্তৃত অংশীদারত্বের মাধ্যমে। বান কি মুনের মতে, ‘জাতিসংঘের সাফল্যের প্রকৃত মাপকাঠি হলো আমরা কত প্রতিশ্রুতি দিই, তা নয়—বরং যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের জন্য আমরা আসলে কতটা করতে পারি।’
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অ্যালব্রাইট জাতিসংঘের ত্রুটি স্বীকার করেও সংস্থাটিকে বিশ্ব শান্তির জন্য ‘অপরিহার্য অংশীদার’ হিসেবে দেখতেন।
২০১৪ সালে জাতিসংঘে দেওয়া এক ভাষণে ভাষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোম চমস্কি বলেন, ‘জাতিসংঘ কেবল ততক্ষণই কাজ করতে পারে, যতক্ষণ বৃহৎ শক্তিগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাকে অনুমতি দেয়।’
চমস্কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে বলেন, এই ক্ষমতা কেবল পাঁচটি দেশের হাতে থাকা সংস্থাটিকে অগণতান্ত্রিক করে তুলেছে। চমস্কি যুক্তি দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ইসরায়েলের মতো মিত্রদের আন্তর্জাতিক আইন ও জবাবদিহিতা থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
২০২৪ সালের পেন পিন্টার পুরস্কার গ্রহণকালে লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা থামাতে ব্যর্থ হয়, তখন আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান প্রায়ই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ বিগার দ্যান ফাইভ’ স্লোগান ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভেটো ক্ষমতার সমালোচনা করেন। তার মতে, এই ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক এবং বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বুদ্ধিজীবী ও লেখক ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর ‘টোয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ে দাবি করেছেন, ‘জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূল কারণ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী রাজনীতি।’
অদৃশ্য সাফল্য ও আগামীর পথ
সব সমালোচনার পরও মনে রাখা জরুরি, জাতিসংঘের গল্প শুধু ব্যর্থতার নয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মসূচি নীরবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগ প্রতিরোধে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বাস্তুচ্যুত মানুষের সুরক্ষায় কাজ করছে।
জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে তার সংস্কার করার ক্ষমতা ও জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের সামর্থ্যের ওপর। গুতেরেস যে ‘আস্থার ঘাটতির’ কথা বলেছেন, তা কাটিয়ে উঠতে শুধু বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে প্রভাবশালী দেশগুলোর আন্তরিক ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত সংস্কার।
করোনার মহামারির মতো একুশ শতকে বিভিন্ন সংকট আমাদের বারবার বলছে, সম্মিলিত সহায়তা আর পারস্পরিক সহযোগিতাই আমাদের রক্ষা করতে পারে। এই উদ্যোগের জন্য তাই একটি বৈশ্বিক মঞ্চের প্রয়োজন যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘকে আবার নিজেদের আস্থার সংস্থায় পরিণত করা শুধু জাতিসংঘের জন্য নয়, বরং আমাদের জন্যই প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: বেটার ওয়ার্ল্ড ক্যাম্পেইন, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন ইউএন ওয়াচ, পিউ রিসার্চ সেন্টার, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কনটেম্পরারি রিসার্চ, দ্য রেস্ট জার্নাল, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং দ্য গ্লোবাল অবজারভেটরি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল জাতিসংঘ। একুশ শতকে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক মহামারির সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা কারোরই অজানা নয়। বড় বড় দেশগুলোর তোয়াক্কা না করার স্বভাব এবং অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোর জাতিসংঘের ওপর ক্রমাগত হতাশা এক জটিল পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে।
সাধারণ মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে তৈরি এই সংস্থা তাই ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষেরই আস্থা হারাচ্ছে। বিভিন্ন জনমত, বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ ও ভূরাজনৈতিক অচলাবস্থার বাস্তবতা আমাদের বলছে, জাতিসংঘ ক্রমশ আস্থাহীনতার গভীর স্রোতে আটকে পড়ছে। যদিও অনেক বিশ্বনেতা ও সাধারণ মানুষ এখনো এর প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে নারাজ।
জনমতের মিশ্র রায়
সাম্প্রতিক জরিপগুলো জাতিসংঘ সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরস্পরবিরোধী চিত্র তুলে ধরেছে। ২০২৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৩৫টি দেশের মধ্যে গড়ে ৫৮ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এই জরিপে কেনিয়া, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন এবং থাইল্যান্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশও অংশ নিয়েছিল।

তবে এই সংখ্যা বেশ কিছু দেশের সাধারণ মানুষের জাতিসংঘের প্রতি অনাস্থার ইঙ্গিতকেও আড়াল করেছে। একই জরিপ বলছে, যুক্তরাজ্যে এক বছরের মধ্যেই জাতিসংঘ সম্পর্কে ইতিবাচক মত ৭২ শতাংশ থেকে কমে ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। একই প্রবণতা দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনমত আরও বিভক্ত। পিউ-এর জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ আমেরিকান জাতিসংঘকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, যা আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ কম। অন্যদিকে গ্যালাপের একই বছরের আরেক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৩ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন বিশ্ব বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ ‘ভালো কাজ করছে’। এর বিপরীতে ৫৮ শতাংশের মতে জাতিসংঘ ‘কাজের কাজ কিছু করতে পারছে না’।
২০২৪-এ ২৮টি দেশে ৩২ হাজার মানুষের ওপর করা এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার সমীক্ষায় জাতিসংঘের প্রতি আস্থা দেশভেদে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন দেখা গেছে। ভারত ও কেনিয়ায় ৭৭ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘ ‘সঠিক কাজ করবে’ বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু জাপান ও আর্জেন্টিনায় এই সংখ্যা মাত্র ৩৮ শতাংশ।
জাতিসংঘের প্রতি আস্থার এই পতন নতুন কিছু নয়। বৈশ্বিক জনসংযোগ সংস্থা এডেলম্যানের রিপোর্ট মতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ২৭টি দেশের ২৩টিতেই জাতিসংঘের প্রতি আস্থা উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে।
জরিপগুলো বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও গাজায় গণহত্যায় জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা আস্থা কমে যাওয়ার মূল কারণ।
ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার
জাতিসংঘের প্রতি অসন্তোষ ও হতাশার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নিরাপত্তা পরিষদ। এই পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য—চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা প্রায়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। এই বিশেষাধিকার দেশগুলোকে যেকোনো প্রস্তাব আটকে দেওয়ার সুযোগ দেয়। ফলে জরুরি সংকট মোকাবিলায় পরিষদ প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং গাজার চলমান গণহত্যায় বারবার ভেটো প্রয়োগ দেখিয়েছে কীভাবে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
এই ধারাবাহিক অচলাবস্থা জাতিসংঘের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। সিঙ্গাপুরের কূটনীতিক টমি কোহের মতে, ‘এটি জাতিসংঘের জন্মগত ত্রুটি, যার কোনো চিকিৎসা নেই।’ কোহের মতে, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় এই ক্ষমতা হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু এখন এই পাঁচ দেশ কখনোই স্বেচ্ছায় ভেটোর ক্ষমতা ত্যাগ করবে না।
ভেতর থেকেও উদ্বেগের স্বর
জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ শুধু বাইরের সমালোচকদের নয়, সংস্থার ভেতরের নেতারাও বহুবার তা স্বীকার করেছেন। বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘আস্থার ভাঙন এখন মূল্যবোধের ভাঙনে’ পরিণত হচ্ছে।
গুতেরেসের মতে, জাতিসংঘকে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করতে হবে এবং কাজের ধরনে সংস্কার আনতে হবে। এখন সময় এসেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুই স্তরেই ‘মানুষ ও নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের’। গুতেরেস আহ্বান জানিয়েছেন, জাতিসংঘকে ‘প্রক্রিয়ার চেয়ে ফলাফলে’ এবং ‘আমলাতন্ত্রের চেয়ে মানুষের ওপর’ বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
তাঁর আগের মহাসচিবরাও একই সুর তুলেছিলেন। প্রয়াত কফি আনান বারবার বলেছেন, জাতিসংঘের আদর্শ ও বাস্তব পারফরম্যান্সের মধ্যে একটা ফাঁক আছে। কফি আনান বিশ্বাস করতেন, ‘আমরা সবাই এক মানব জাতির অংশ’ এবং জাতিসংঘ সেই যৌথ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অপরিহার্য।

কফি আনানের উত্তরসূরি বান কি মুন বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিভাজনই জাতিসংঘের বড় বাধা। বিস্তৃত সমস্যার সমাধান আসে বিস্তৃত অংশীদারত্বের মাধ্যমে। বান কি মুনের মতে, ‘জাতিসংঘের সাফল্যের প্রকৃত মাপকাঠি হলো আমরা কত প্রতিশ্রুতি দিই, তা নয়—বরং যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের জন্য আমরা আসলে কতটা করতে পারি।’
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অ্যালব্রাইট জাতিসংঘের ত্রুটি স্বীকার করেও সংস্থাটিকে বিশ্ব শান্তির জন্য ‘অপরিহার্য অংশীদার’ হিসেবে দেখতেন।
২০১৪ সালে জাতিসংঘে দেওয়া এক ভাষণে ভাষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোম চমস্কি বলেন, ‘জাতিসংঘ কেবল ততক্ষণই কাজ করতে পারে, যতক্ষণ বৃহৎ শক্তিগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাকে অনুমতি দেয়।’
চমস্কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে বলেন, এই ক্ষমতা কেবল পাঁচটি দেশের হাতে থাকা সংস্থাটিকে অগণতান্ত্রিক করে তুলেছে। চমস্কি যুক্তি দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ইসরায়েলের মতো মিত্রদের আন্তর্জাতিক আইন ও জবাবদিহিতা থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
২০২৪ সালের পেন পিন্টার পুরস্কার গ্রহণকালে লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা থামাতে ব্যর্থ হয়, তখন আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান প্রায়ই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ বিগার দ্যান ফাইভ’ স্লোগান ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভেটো ক্ষমতার সমালোচনা করেন। তার মতে, এই ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক এবং বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বুদ্ধিজীবী ও লেখক ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর ‘টোয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ে দাবি করেছেন, ‘জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূল কারণ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী রাজনীতি।’
অদৃশ্য সাফল্য ও আগামীর পথ
সব সমালোচনার পরও মনে রাখা জরুরি, জাতিসংঘের গল্প শুধু ব্যর্থতার নয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মসূচি নীরবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগ প্রতিরোধে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বাস্তুচ্যুত মানুষের সুরক্ষায় কাজ করছে।
জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে তার সংস্কার করার ক্ষমতা ও জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের সামর্থ্যের ওপর। গুতেরেস যে ‘আস্থার ঘাটতির’ কথা বলেছেন, তা কাটিয়ে উঠতে শুধু বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে প্রভাবশালী দেশগুলোর আন্তরিক ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত সংস্কার।
করোনার মহামারির মতো একুশ শতকে বিভিন্ন সংকট আমাদের বারবার বলছে, সম্মিলিত সহায়তা আর পারস্পরিক সহযোগিতাই আমাদের রক্ষা করতে পারে। এই উদ্যোগের জন্য তাই একটি বৈশ্বিক মঞ্চের প্রয়োজন যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘকে আবার নিজেদের আস্থার সংস্থায় পরিণত করা শুধু জাতিসংঘের জন্য নয়, বরং আমাদের জন্যই প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: বেটার ওয়ার্ল্ড ক্যাম্পেইন, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন ইউএন ওয়াচ, পিউ রিসার্চ সেন্টার, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কনটেম্পরারি রিসার্চ, দ্য রেস্ট জার্নাল, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং দ্য গ্লোবাল অবজারভেটরি।
.png)

বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নেওয়া জাতিসংঘকে একসময় মনে করা হতো মানবতার শেষ আশ্রয়। মানুষের কাছে জাতিসংঘ ছিল এমন এক সংস্থা, যারা পৃথিবীকে আবারও যুদ্ধের অন্ধকারে পতিত হতে দেবে না।
১৫ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানি রোসনেফট ও লুকঅয়েল-এর বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন সূচিত করেছে।
১ দিন আগে
বাংলাদেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দ্রুত বিকাশ যোগাযোগ, প্রশাসন ও দৈনন্দিন জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে। তবে এর সঙ্গে এসেছে কিছু ঝুঁকিও—যেমন ভুয়া তথ্য, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন ও সাইবার হামলার আশঙ্কা।
১ দিন আগে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর মূল অর্থনৈতিক নীতি আবারও চীনের সঙ্গে পূর্ণ মাত্রার বাণিজ্য যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। এই নীতিতে রয়েছে উচ্চ শুল্ক, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-ভিত্তিক অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার হুমকি। বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’।
২ দিন আগে