leadT1ad

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী, ভারত কেন বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেয় না

মাহবুবুল আলম তারেক
মাহবুবুল আলম তারেক
ঢাকা
তিস্তা দুই ধরনের হুমকি সৃষ্টি করে— বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙন, আর শুকনো মৌসুমে তীব্র পানিশূন্যতা। স্ট্রিম গ্রাফিক

তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার মশাল কর্মসূচি পালন করে রংপুর বিভাগের হাজার হাজার মানুষ। আগামী ৩০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টা থেকে ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

হিমালয়ের সিকিমের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন তিস্তা নদী ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ—এর মধ্যে ৩০৫ কিলোমিটার ভারতের মধ্যে এবং ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে এ নদীর পানির ওপর।

ভারতের প্রায় ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর ও বাংলাদেশের ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি সেচের জন্য তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু উজানে ভারতের বাঁধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে নদীর পানিপ্রবাহ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ থেকে বাঁচতেই বাংলাদেশ তিস্তা মহাপরিকল্পনা তৈরি করে।

২০১১ সালে প্রস্তাবিত একটি চুক্তিতে ভারতকে ৪২.৫ শতাংশ ও বাংলাদেশকে ৩৭.৫ শতাংশ পানি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের স্বার্থের কারণ দেখিয়ে তাতে ভেটো দেন। এর ফলে আলোচনার অগ্রগতি থেমে যায়।

বিরোধের ইতিহাস

তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যু ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকেই বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। দেশভাগে তিস্তার উজানভূমি ভারতের অংশে পড়ে, যা পরে পানি বণ্টনে জটিলতা সৃষ্টি করে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের প্রাথমিক আলোচনার ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। কমিশন এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৭টি বৈঠক করেছে, যার মধ্যে অনেকগুলো বৈঠক ছিল তিস্তা ইস্যু নিয়ে।

১৯৮৩ সালের একটি অস্থায়ী চুক্তিতে ভারতকে তিস্তার ৩৯ শতাংশ আর বাংলাদেশকে ৩৬ শতাংশ পানি দেওয়া হয়। ২৫ শতাংশ পানি অনির্ধারিত রাখা হয়। বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ দাবি করেছিল। কিন্তু চুক্তিটি কখনো পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি।

১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি, যা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও তিস্তা ইস্যু তখনও অনিষ্পন্ন থেকে যায়। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে একাধিক যৌথ কমিটি শুকনো মৌসুমে পানির ঘাটতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।

২০১১ সালে প্রস্তাবিত একটি চুক্তিতে ভারতকে ৪২.৫ শতাংশ ও বাংলাদেশকে ৩৭.৫ শতাংশ পানি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের স্বার্থের কারণ দেখিয়ে তাতে ভেটো দেন। এর ফলে আলোচনার অগ্রগতি থেমে যায়।

২০১১ সালের পর থেকে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করছে ভারত। এমনকি অভিন্ন নদীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক রীতি না মেনে পানি সরাতে ২০২৩ সালে উজানে আরও দুটি খাল খননের উদ্যোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

ভারতের সিকিম ও জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের সিকিম ও জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।

ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে ঢোকা তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে ভারতের উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে প্রায় শুকিয়ে যায়। আবার বর্ষাকালে যখন নদী উপচে পড়ে, তখন বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা দেখা দেয়। বর্ষাকালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই পানির চাপ কমাতে গজলডোবা ব্যারেজে ফ্লাডগেট খুলে দেয়।

এর প্রতিক্রিয়ায় অবশেষে বাংলাদেশ নিজ উদ্যোগে ২০১৫ সালে তিস্তা নিয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির চিন্তা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) ও চীনের পাওয়ার চায়না-র মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়।

কয়েকবছরের সমীক্ষা শেষে ২০১৯ সালে চীনের সহায়তায় তিস্তা কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট বা তিস্তা মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০২৪ সালের এপ্রিলে চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশ চাইলে চীন প্রকল্পটি শুরু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ভারত এই প্রকল্প নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু সামনে আনে এবং চীনের অর্থায়নের বিরোধিতা করে। ভারতের দাবী চীন এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব খাটাবে। এতে শেখ হাসিনা সরকার আর চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকল্পটি নতুন গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের পানি কনভেনশনে যোগ দেয়, যা বহুপাক্ষিক সমাধানের দিকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্দেশ করে।

গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

কিন্তু বর্ষাকালে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি বন্যায় প্লাবিত হয়। আবার ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত খরার সময় নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে মাত্র ৩০০ কিউসেকে দাঁড়ায়। এতে ফসলি জমি শুকিয়ে যায় এবং প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি প্রায় ২ ফুট করে নিচে নেমে যায়।

তিস্তা মাস্টার প্ল্যান কী, এর গুরুত্ব কোথায়

তিস্তা মাস্টার প্ল্যান বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী তিস্তাকে পুনরুদ্ধার ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। এর মূল লক্ষ্য তিস্তাকে অনিয়ন্ত্রিত ও বহুপ্রবাহী নদী থেকে একটি স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় রূপান্তর করা। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে—১০২ কিলোমিটার নদী খনন করে নৌ চলাচল সহজ করা, ভাঙনরোধে গ্রোয়েন ও বাঁধ নির্মাণ, শুকনো মৌসুমে পানি সংরক্ষণের জন্য খাল ও জলাধার তৈরি।

ভূমি উদ্ধার ও উন্নয়ন করা হবে ১৭১ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। বাঁধ নির্মিত হবে ২০৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া চর খনন, নদীর দুই পাড়ে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার করা হবে। শিল্পপার্ক ও কৃষি উন্নয়ন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নদীর দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকবে। এ ছাড়া বাঁধের দুই পাশে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ ও পর্যটন নগরী, পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।

বর্তমানে প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন চলছে, যেখানে বিশেষজ্ঞ মতামত ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাব্য সময় জানুয়ারি ২০২৬।

বাংলাদেশের একটি নিম্ন অববাহিকার দেশ, যা বহু আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই এই পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা দুই ধরনের হুমকি সৃষ্টি করে— বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙন, আর শুকনো মৌসুমে তীব্র পানিশূন্যতা। এর ফলে চাষযোগ্য জমির ৬৫ শতাংশ অনাবাদী থেকে যাচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।

উত্তরবঙ্গের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলা নিয়ে গঠিত। এখানে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এই অঞ্চল জাতীয়ভাবে চাষযোগ্য জমির ১৪ শতাংশ যোগান দেয়।

কিন্তু বর্ষাকালে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি বন্যায় প্লাবিত হয়। আবার ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত খরার সময় নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে মাত্র ৩০০ কিউসেকে দাঁড়ায়। এতে ফসলি জমি শুকিয়ে যায় এবং প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি প্রায় ২ ফুট করে নিচে নেমে যায়।

এই পরিস্থিতি দারিদ্র্যকে আরও ঘনীভূত করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সেচ সুবিধা নিশ্চিত হলে ফসল উৎপাদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন বন্দর, শিল্পকারখানা স্থাপন হলে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে।

শুষ্ক মৌসুমে এভাবেই বাংলাদেশ অংশে শুকিয়ে যায় তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।
শুষ্ক মৌসুমে এভাবেই বাংলাদেশ অংশে শুকিয়ে যায় তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কেবল একটি অবকাঠামো প্রকল্প নয়। এটি একটি ন্যায্য পানিবণ্টনের চেষ্টা, যা উত্তরবঙ্গের জীবন-জীবিকার ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যদি কূটনৈতিক সমন্বয় বজায় থাকে, তাহলে এই প্রকল্প ৫৪টি অভিন্ন নদীর জন্যও একটি সহনশীলতার মডেল হতে পারে।

প্রস্তাবিত তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা (৯৮৩ মিলিয়ন ডলার)। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগবে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর। পুরো প্রকল্পটি ২০৩৫ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে পূর্ণভাবে চালু হবে।

তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (ফার্স্ট ফেজ) বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৭৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ (ডলারপ্রতি ১২২ টাকা ধরে)। এর মধ্যে চীনের কাছ থেকে ঋণ চাওয়া হয়েছে ৫৫ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা)। বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজের সময়কাল ধরা হয়েছে ২০২৬ থেকে ২০২৯ সাল।

তবে ভারতের সঙ্গে স্থগিত পানি-বণ্টন আলোচনা এ প্রকল্পে ভূরাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করেছে। তিস্তা ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে একটি সংবেদনশীল প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ আরও ১২টি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কে (আইপিইএফ) বাংলাদেশকে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে চীন চায় বাংলাদেশ যেন তাদের সঙ্গে থাকে। চীন এখন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি ফোরামে বাংলাদেশকে চাইছে।

এ পরিস্থিতিতে তিস্তার মতো ‘কৌশলগত’ প্রকল্পে কে বিনিয়োগ করবে, তা নিয়ে নানা সমীকরণ আছে। তবু বাংলাদেশ এটিকে আত্মনির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছে— যা জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

চিঠিতে মমতা লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করব না।’

বাংলাদেশকে পানি দিতে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি কেন

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন বামফ্রন্টের জ্যোতি বসু, যার পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশ। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল ৩০ বছরের জন্য, ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় অভিন্ন আরেক নদী তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের সবই ঠিকঠাক হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে ঘটেছে পালাবদল। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে রাজ্যটিতে ক্ষমতায় আসা মমতা ব্যানর্জি আপত্তি তুললে সেই চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি।

কংগ্রেসের পর বিজেপি সরকার গঠনের পর নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে নানা সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির আশ্বাস দিলেও মমতা থাকেন অনড়। ভারত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। ফলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অমতে মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি নিয়ে আর এগোতে পারেনি।

২০২৪ সালে ক্ষমতা হারানোর আগে জুনে শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে ভারতের সঙ্গে ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। সেসময় গঙ্গা চুক্তি নবায়নের কথা যেমন উঠেছে, তেমনি তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার মধ্যে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের তিস্তা মহাপরিকল্পনায়ও ভারত যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

কিন্তু এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আবারও দিল্লিতে চিঠি লিখে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবায়ন এবং তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চিঠিতে মমতা লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করব না।’

ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত।

মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি প্রবাহের কমার পক্ষে হাইড্রোলজিকাল তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, তিস্তার পানি ভাগাভাগি করলে পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ইস্যুতে তিনি কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চান। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ভোটব্যাংকও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা।

তিস্তা নদীর বার্ষিক পানিপ্রবাহ প্রায় ৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। তবে এর ৯০ শতাংশই বর্ষাকালে প্রবাহিত হয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজে প্রয়োজনীয় ১ হাজার ৬০০ কিউসেকের পরিবর্তে কখনও কখনও মাত্র ১০০ কিউসেক পানি পাওয়া যায়।

উত্তরের সিকিম অঞ্চলে ২০টির বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের কারণে পানির প্রবাহ প্রয়োজনের তুলনায় ষোল ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এর ফলে বাংলাদেশে খরার প্রকোপ দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে ৪ হাজার ৫০০ কিউসেক প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশ কখনও কখনও মাত্র ৫৫৩ কিউসেক পানি পায়।

জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। হিমবাহ গলে যাওয়ার হার বেড়েছে এবং বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

নদী বিশেষজ্ঞ ড. কল্যাণ রুদ্র ২০১৭ সালে বলেন, ‘ভারত উপরের দিকে একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করায় তিস্তা নদীতে পানির ঘাটতি তৈরি হয়েছে।’ (সূত্র: ডায়ালগ আর্থ, ২০২৫ সালের বিশ্লেষণে উদ্ধৃত)

তবে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক নীলাঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘এই ব্যাখ্যাগুলো নদীবিজ্ঞান ও কৃষিভিত্তিক হিসাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং এতে আরও প্রশ্ন তৈরি হয়।’ (ওআরএফ, ২০১৬; ২০২৫ সালের পর্যালোচনায় উদ্ধৃত)

ভারতের সংবিধানে বিদেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও চুক্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ফলে রাজ্যকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে চুক্তিটি করতে পারে। কিন্তু এর রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। আর এ জন্যই বিজেপি বা এর আগে কংগ্রেস সরকারও তিস্তা চুক্তি সই করেনি।

কিন্তু শুধুই কি উত্তরবঙ্গের বিপুল সংখ্যক কৃষকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই মমতা এই তিস্তা জল বণ্টন নিয়ে বিরোধিতা, যার জেরে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্কে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে?

বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির সঙ্গে অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিরোধও রয়েছে এর পেছনে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, মমতার বিরোধিতাটা রাজনৈতিক কারণেও হতে পারে। তিনি দিল্লিকে চাপে রাখার একটি কৌশল হিসাবে এটাকে ব্যবহার করতে পারেন।

মমতার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার তিস্তা চুক্তির বিরোধিতাকে একটি রাজনৈতিক চমক হিসাবে দেখেন। তাই অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে আন্তঃরাষ্ট্রীয় পানি সহযোগিতা এখন জটিল আকার ধারণ করেছে।

ভারতের সংবিধানে বিদেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও চুক্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ফলে রাজ্যকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে চুক্তিটি করতে পারে। কিন্তু এর রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। আর এ জন্যই বিজেপি বা এর আগে কংগ্রেস সরকারও তিস্তা চুক্তি সই করেনি।

২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশন সভায় তথ্য বিনিময় ও পরিবেশগত মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। তবে তিস্তা ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর পেছনে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন পরবর্তী দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা, একটি বড় কারণ।

বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব অক্টোবর মাসে দিল্লি সফর করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি। ফলাফল বাংলাদেশ পক্ষের জন্য হতাশাজনক ছিল।

ভারতে তিস্তার প্রবাহ। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতে তিস্তার প্রবাহ। ছবি: সংগৃহীত।

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ বন্যায় তিস্তা নদীর পানি রাস্তাঘাট ডুবিয়ে দেয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ তিস্তা নদীসহ আরও ১৪টি নদীর জন্য নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি বন্যা ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা জোরদার করার প্রস্তাবও উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এই নদীগুলো দুই দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের জীবিকা, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌপরিবহন ও পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। এগুলোর বেশিরভাগই গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা অববাহিকার অংশ, যা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নদী অঞ্চল।

তবে এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের পানি-সম্পর্কে অবিশ্বাস ও উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। ভারতের উজানে বাঁধ ও ব্যারাজ (যেমন গঙ্গার ফারাক্কা ব্যারাজ) নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে পড়ে। অন্যদিকে, বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বন্যার ঝুঁকি বাড়ে। এখন পর্যন্ত কেবল দুটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছে—১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি-বণ্টন চুক্তি (যার মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বর ২০২৬-এ) এবং ২০২২ সালের কুশিয়ারা নদী বিষয়ক সমঝোতা স্মারক।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী ‘ভাটির রাষ্ট্রের অধিকার’ দাবি করে। ন্যূনতম পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ ও বন্যা পূর্বাভাসের জন্য তথ্য আদান-প্রদান চায়। অপরদিকে, ভারত নদীগুলোকে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। ফলে নিজেদের রাজ্যগুলোর স্বার্থ রক্ষায় তারা নতুন চুক্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাসই দুই দেশের যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত