leadT1ad

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মুনতাসির মারাইয়ের লেখা

তাহারির স্কয়ারের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অনেক মিল আছে

সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন আল-জাজিরার মিডিয়া ইনিশিয়েটিভস-এর ব্যবস্থাপক মুনতাসির মারাই। জর্ডানের বাসিন্দা ফিলিস্তিন বংশদ্ভূত সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা তিনি। ২০১১ সালে তিনি মিশরের তাহরির স্কয়ার থেকে যে ‘আরব বসন্ত’ হয়েছিল, সেখানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানেরও তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষক। এই সাংবাদিক কথা বলেছেন স্ট্রিমের সঙ্গে। জানিয়েছেন জনগণের বিক্ষোভ-বিপ্লবে মূলধারা আর বিকল্প ধারার গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি আর সম্ভাবনা নিয়ে। এই লেখা তৈরি হয়েছে সেই কথোপকথনের ভিত্তিতে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ৩০
মুনতাসির মারাই। স্ট্রিম ছবি

আমি আরব বসন্তের সময় মিশরে তাহরির স্কয়ারে গিয়েছিলাম ওই বিপ্লব কাভার করতে। আর সম্প্রতি বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলনও আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমার কাছে এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় লেগেছে। এর সঙ্গে তাহরির স্কয়ারের অনেক মিল আছে। সাংবাদিক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি, কীভাবে মূলধারার গণমাধ্যম এবং সাধারণ নাগরিক সাংবাদিকেরা মানুষকে আন্দোলনের খবর জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ আর জনগণের বিকল্প কণ্ঠ

মিশর বা বাংলাদেশ—দুই দেশেই মূলধারার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানদের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাই আরব বসন্ত হোক বা জুলাই আন্দোলন—খবরের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আর মোবাইল ফোন। আমি দেখেছি, দুই ক্ষেত্রেই মিলটা প্রবল। এটিই আশার জায়গা। কারণ, সাধারণ মানুষ মিডিয়ার সেন্সরশিপ এড়িয়ে নিজেদের কণ্ঠ তুলে ধরতে পেরেছে, নিজের গল্প বলতে পেরেছে—অবস্থা যা-ই হোক না কেন।

তাহরির স্কয়ারে গণআন্দোলন। সংগৃহীত ছবি
তাহরির স্কয়ারে গণআন্দোলন। সংগৃহীত ছবি

স্বাধীন গণমাধ্যমের শূন্যস্থান পূরণের ডাক

গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হওয়া উচিত কণ্ঠহীনদের কণ্ঠ হয়ে ওঠা। সমস্যা হয় তখন, গণমাধ্যম যখন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা সেলিব্রিটিদের প্রতিধ্বনি হয়ে যায়। মূল সমস্যা হলো, তারা যখন ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে, তখন সাধারণ মানুষ, রাস্তায় বা সীমান্তে থাকা মানুষ উপেক্ষিত হয়।

এই বাস্তবতায় স্বাধীন গণমাধ্যম বা বিকল্প প্ল্যাটফর্মগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন প্রজন্ম, যাঁরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছেন, ছোট পডকাস্ট চালাচ্ছেন, অথবা অন্য রকম গণমাধ্যমের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন—তাঁদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। জনগণের স্বার্থ তুলে ধরা, কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর হওয়া—এটাই তাঁদের দায়িত্ব। এজন্য তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, নইলে মূলধারার গণমাধ্যম আগের মতোই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে আর ভুয়া খবর ছড়াবে।

আমি সব গণমাধ্যমের কথা বলছি না। তবে ইতিহাস থেকে আমরা জানি, বড় বড় গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠান অনেক সময়ই জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং তা উপেক্ষা করে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমের দ্বিমুখীতা

দুর্ভাগ্যজনকভাবে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম যেভাবে খবর উপস্থাপন করে, তা কেবল ফিলিস্তিনিদের নয়, গোটা গ্লোবাল সাউথের বাস্তবতার সঙ্গেও মেলে না। তারা নিহত আর হত্যাকারীর মধ্যে সমতা আনার চেষ্টা করে। গাজার যুদ্ধ কাভার করার সময়, মনে হয় যেন ইসরায়েলি দখলদার আর নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

মিশর বা বাংলাদেশ—দুই দেশেই মূলধারার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানদের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাই আরব বসন্ত হোক বা জুলাই আন্দোলন—খবরের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আর মোবাইল ফোন। আমি দেখেছি, দুই ক্ষেত্রেই মিলটা প্রবল।

খেয়াল করলে দেখবেন, যখন ইসরায়েলি হামলার কথা আসে, তখন বলা হয়, ‘একটি ফিলিস্তিনি দল নিহত হয়েছে।’ কিন্তু তারা বলে না, এরা কাদের হাতে নিহত হলো, কোথা থেকে বোমা এল, কে মারল। অথচ ফিলিস্তিনিদের প্রসঙ্গে উল্টোটা ঘটে।

আমার মতে, পশ্চিমা গণমাধ্যম আসলে ফিলিস্তিনের গণহত্যায় অংশীদার। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা সবসময় ভুয়া খবর, বিভ্রান্তি আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু আজকের দিনে আমরা দেখছি, ফিলিস্তিনিদের হতাহতের খবর দিতে গিয়েই তারাই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

উদাহরণ দিই। ইসরায়েল যখন সাধারণ মানুষ বা সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করছে, তখন বলা হচ্ছে, ‘একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত।’ কিন্তু কে হত্যা করল, তা উল্লেখ করা হয় না। অথচ ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তারা স্পষ্ট লেখে, ‘রাশিয়ার বোমায় একজন ইউক্রেনীয় নিহত।’ এখানেই পার্থক্য। হত্যাকারী আর নিহতকে এক পাল্লায় তোলার চেষ্টা চলছে।

সত্য যাচাইয়ের দায়িত্ব

পশ্চিমা গণমাধ্যমের ওপর ভরসা করা যায় না। আশা রাখা যায় সেই সাহসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর, যাঁরা মাঠ থেকে খবর আনছেন। তাঁরা পশ্চিমা কাঠামোর বিপরীতে ভিন্ন কাঠামো দাঁড় করাচ্ছেন। তাঁরা তুলে ধরছে হতাহতদের, সাধারণ মানুষের, শিশুদের এবং নির্দোষদের কণ্ঠ—যাঁরা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার।

আমার মতে, পশ্চিমা গণমাধ্যম আসলে ফিলিস্তিনের গণহত্যায় অংশীদার। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা সবসময় ভুয়া খবর, বিভ্রান্তি আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু আজকের দিনে আমরা দেখছি, ফিলিস্তিনিদের হতাহতের খবর দিতে গিয়েই তারাই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

আজকাল সাংবাদিকদের হাতে অনেক সরঞ্জাম আছে—ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্ট বা ওপেন সোর্স কনটেন্ট যাচাই করার। তবে এর চেয়েও জরুরি হলো সাংবাদিকের ব্যক্তিগত অভ্যাস। যে কোনো খবর পেলে তা যেমন আছে সেভাবে মেনে নিলে হবে না। সন্দেহ করতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে, যাচাই করতে হবে।

কারণ, প্রতিটি খবরের প্রেক্ষাপট থাকে। যেমন, কোনো প্রেসিডেন্ট যদি বলেন, ‘আমি ১০ লাখ চাকরি দিয়েছি।’ সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব শুধু সেই বক্তব্য ছাপানো নয়, যাচাই করা—সত্যিই কি ১০ লাখ, নাকি ১ লাখ? আমি কারও ডাকবাক্স হতে চাই না।

এই তথ্য যাচাই একটি সংস্কৃতি। গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক উভয়ের ভেতরেই এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। উৎস যেখান থেকেই আসুক—রাজনীতিবিদ, সরকার বা প্রভাবশালী—সবাইকে সন্দেহ করতে হবে। কারণ, ভুয়া খবর আজকাল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়, আসে শাসক আর রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে।

নৈতিকতার প্রশ্ন

সাংবাদিকের কাজ শুধু খবর দেওয়া নয়, আরও বড় দায়িত্ব আছে। যদি কোনো কর্মকর্তা বা সাংবাদিক গণহত্যায় জড়িত থাকে, তাকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্ভাগ্য, আজ আমাদের গণমাধ্যমকে প্রশ্ন করতে হয়—কারণ, অনেক সময় তারা স্বৈরশাসক, জান্তা বা গণহত্যাকারীর পক্ষে প্রচারণা চালায়। যেমন ইসরায়েলি দখল বা বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বৈরশাসক সরকার।

Ad 300x250

‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা হয় গণভবনে: রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুন

রিটকারীকে গণধর্ষণের হুমকি: শিবিরের দিকে আঙুল তুলছে সবাই

নির্বাচন বানচালের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সতর্ক হতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা

হিউম্যান রাইটস ডিউ ডিলিজেন্স বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিল বিলস

তাহারির স্কয়ারের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অনেক মিল আছে

সম্পর্কিত