leadT1ad

যখন নদী গিলে খায় জমি: ভাঙনের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিরাম লড়াই

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ৪৪
বিশ্বনেতারা যখন ব্রাজিলে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (১০-২১ নভেম্বর ২০২৫) জড়ো হচ্ছেন, বাংলাদেশের এই লড়াই তাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। ছবি: রয়টার্স।

মেঘলা এক সকালে নূরুন নবি বাঁশ ও টিনবোঝাই একটি নৌকা প্রস্তুত করলেন। ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝের একটি দুর্বল চর দ্বীপে মাত্র এক বছর আগে তিনি ঘর তুলেছিলেন। এখন সেই ঘর নদীতে বিলীন হওয়ার মুখে। এক বছরের মধ্যে এটি তার দ্বিতীয়বার ঘর হারানো।

তিনি ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘নদী প্রতিদিন আরও কাছে আসছে। আমরা যেন কষ্টের জন্যই জন্মেছি। এই সংগ্রামের শেষ নেই। কতবার নদী আমার ঘর নিয়েছে, তা আর মনে নেই।’

পঞ্চাশ বছর বয়সী এই কৃষক ও চার সন্তানের পিতা বাধ্য হচ্ছেন আরেকটি চরে চলে যেতে। তার ধান ও ডালক্ষেত নদীর স্রোতে হারিয়ে গেছে। হিমালয় থেকে নেমে চীন ও ভারত অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে এসে প্রবেশ করে, আর তারই তীব্র স্রোত এখন সবকিছু গিলে নিচ্ছে।

নদীর দিকে তাকিয়ে নূরুন নবি বলেন, ‘নতুন জায়গায় কী অপেক্ষা করছে জানি না। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো কয়েক বছর, না হলে এক মাসও নয়। এটাই আমাদের জীবন।’

রাতারাতি হারিয়ে যাওয়া জমি

প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলার শত শত পরিবার এমন পরিণতির মুখে পড়ে। নদীতীর ভেঙে পড়ে, ঘরবাড়ি, জমি, ফসল, গবাদিপশু—সব হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা—যে নদীগুলো একসময় জীবিকার উৎস ছিল, আজ তারা ভয়ংকর ভাঙনের প্রতীক।

চরাঞ্চল বা বালুময় দ্বীপগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ভঙ্গুর এলাকা। সেখানে মানুষ বারবার ঘর তোলে, আবার নদী এসে সবকিছু কেড়ে নেয়। ৭০ বছরের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পানি কোনো সতর্কতা দেয় না। রাতে ঘুমাতে যান, সকালে দেখেন নদীতীর সরে গেছে। ঘর নেই, শান্তি নেই।’

বিশ্বনেতারা যখন ব্রাজিলে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (১০-২১ নভেম্বর ২০২৫) জড়ো হচ্ছেন, বাংলাদেশের এই লড়াই তাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। দেশটি প্রশংসিত তার স্থিতিস্থাপকতার জন্য—বাঁধ নির্মাণ, আগাম বন্যা পূর্বাভাস, ও স্থানীয় অভিযোজন কর্মসূচির মাধ্যমে। তবুও, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও জলবায়ু তহবিল ছাড়া এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়।

জলসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘এই মানুষগুলো এমন নিঃসরণে মূল্য দিচ্ছে, যার জন্য তারা দায়ী নয়। যদি কপ-৩০ সম্মেলন সত্যিকারের কিছু অর্থবহ হয়, তবে তা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রকৃত অর্থায়ন দিতে হবে এবং বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’

চোখে দেখা জলবায়ু পরিবর্তন

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কুড়িগ্রামে যা ঘটছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলন। হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুত গলছে, যা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তায় বাড়তি পানি যোগ করছে। নিশাত জানান, ‘১৯৯০-র দশকের তুলনায় এখন গলনের হার প্রায় দ্বিগুণ। অতিরিক্ত পানি নেমে এসে নদীগুলো ফুলে উঠছে।’

একই সঙ্গে বর্ষাকালের ধরনও বদলে গেছে—আগে আসে, বেশি স্থায়ী হয় এবং হঠাৎ তীব্র বৃষ্টিপাতে নদী উপচে পড়ে। নিশাত বলেন, ‘ঋতুর ছন্দ হারিয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি হয়, তখন অতিরিক্ত হয়; আবার থেমে গেলে খরা দেখা দেয়। এই অনিয়মিত আবহাওয়া ভাঙন ও বন্যাকে আরও মারাত্মক করছে।’

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কুড়িগ্রামে যা ঘটছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলন। ছবি: রয়টার্স।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কুড়িগ্রামে যা ঘটছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলন। ছবি: রয়টার্স।

তিনি আরও যোগ করেন, বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৫ শতাংশেরও কম পরিমাণের জন্য দায়ী। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের সবচেয়ে বড় শিকার। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ুজনিত দুর্যোগে প্রতি সাতজন বাংলাদেশির একজন বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

৫০ বছর বয়সী সাত সন্তানের পিতা কাসিম উদ্দিনের জীবন যেন ভাঙনের প্রতীক। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে নদী ৩০-৩৫ বার ঘর নিয়ে গেছে, হয়তো আরও বেশি। আমরা ঘর তুলি, নদী আবার আসে।’ পানির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘কোথায় যাব? চারপাশে তো শুধু পানি।’

নারীরা বহন করছে এই বাস্তুচ্যুত জীবনের সবচেয়ে ভারী বোঝা। ৩০ বছর বয়সী শাহিনা বেগম স্মরণ করেন, গত বছরের বন্যায় কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে তিনি রান্না করতেন। শাহিনা বলেন, ‘দশ বছরে ছয়বার জায়গা বদলেছি। প্রতি বার শুরু করি, আর নদী এসে তা নিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘মহিলাদের কষ্ট আরও বেশি। শুকনো জায়গা খুঁজতে হয়, রান্না করতে হয়, বাচ্চা সামলাতে হয়—আর কোথাও নিরাপত্তা বা গোপনীয়তা থাকে না।’

টিকে থাকার লড়াই

খেয়ার আলগা চরে প্রায় ৩০০ পরিবার টিকে আছে তিন বছর ধরে। স্থানীয় উদ্যোগে এখানে জিওব্যাগ স্থাপন করা হয়েছে—বালুভর্তি বড় ব্যাগ, যা নদীতীরকে শক্ত করে।

৩৯ বছর বয়সী জহুরুল ইসলাম জানান, ‘জিওব্যাগ অনেক পরিবর্তন এনেছে। গত তিন বছরে নদী আমাদের জমি নেয়নি। জীবনে প্রথমবার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা আশাবাদী বোধ করছি।’

স্থানীয় এনজিওগুলো উঁচু মাচার মতো বসতি গড়ে তুলছে, যাতে ঘরগুলো মৌসুমি বন্যার উপরে থাকে। দৃঢ় নদীতীরের পাশে দাঁড়িয়ে ইসলাম বলেন, ‘হয়তো একদিন নদী আবার আসবে।’

তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। চারপাশে শিশুরা খেলছে, হাওয়ায় ভেসে আসছে তাদের হাসির শব্দ। তিনি বলেন, ‘এবার আমরা প্রস্তুত থাকবো। এই মুহূর্তে জমি টিকে আছে, আমরাও আছি।’

(রয়টার্সে প্রকাশিত রুমা পাল ও মোহাম্মদ পনির হোসেনের প্রতিবেদন)

Ad 300x250

সম্পর্কিত