বাংলাদেশের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। ২০২৫ সালে এসেও কেন এত বৈষম্য রয়ে গেল? বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকেই ‘সবার জন্য শিক্ষা’ একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো? বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈষম্য এখনো প্রকট। সরকারি নীতিমালা থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—সবকিছুই শিশু শিক্ষার বিস্তৃত গুণগত মানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার বাস্তবায়নের কোনো নজির পাওয়া যাচ্ছে না।
শিক্ষায় বৈষম্য বাংলাদেশের সবচেয়ে গভীর সামাজিক সংকটগুলোর একটি। এই বৈষম্য কেবল আয়ের পার্থক্যে নয়। ভৌগোলিক, ডিজিটাল, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং এমনকি স্কুলভিত্তিক কাঠামোর মধ্যেও এই বৈষম্য বিদ্যমান।
বাংলাদেশে এখনো তিনটি প্রধান শিক্ষা ধারা চলছে—সরকারি জাতীয় ধারার স্কুল, বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম, মাদরাসা শিক্ষা। এই তিন ধারার মধ্যে পাঠদানের পরিবেশ, অবকাঠামো, পাঠ্যসূচি, শিক্ষকের মান, শিক্ষণ পদ্ধতি, মূল্যায়ন ব্যবস্থা—সবকিছুতেই ব্যবধান।
একই দেশে জন্ম নেওয়া একটি শিশু যদি কেবল পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন মান, কাঠামো, আর সুবিধার শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ে, তবে ভবিষ্যতের সামর্থ্য আর রাজনৈতিক-সামাজিক সুযোগ-সুবিধাও স্বাভাবিকভাবে ভিন্ন হবে।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যা
শিক্ষার্থীর সংখ্যায় ওঠানামা স্পষ্ট। ২০২০ সালে প্রাথমিকে ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ শিক্ষার্থী, যা ২০২৩ সালে নেমে যায় ২ কোটির নিচে। ২০২৪ সালে সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজারে। তবে এতে আশাবাদ কম। কারণ গুণগত মান ও ধারাবাহিকতার সংকট রয়ে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ২০২০–২০২৩ পর্যন্ত হার কমলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। ছেলেদের ক্ষেত্রে হার প্রায় ১৯ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের একজন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না। ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে ঝরে পড়া বেশি, বিশেষত নেত্রকোনায় হার ৪৪ শতাংশ—যা বহু শিশুর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিচ্ছে।
ছবি: ইউনিসেফ বাংলাদেশের সৌজন্যেগ্রাম ও শহরের শিক্ষার ফারাক
গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯০ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকলেও, অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে এই সংখ্যা ৬০–৭০-এর মধ্যে ওঠানামা করে।
ব্যবধানের মূল কারণগুলো—বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো দুর্বল, শিক্ষকের ঘাটতি, যাতায়াত সমস্যা, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম।
অনেক গ্রামীণ বিদ্যালয়ে গণিত ও ইংরেজি শেখাতে যোগ্য শিক্ষক না থাকায় শিশুরা শুরুতেই পিছিয়ে যায়।
ডিজিটাল বৈষম্য
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বড় গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু শহরের ছাত্ররা যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব, ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে শিখছে, গ্রামের শিশুদের বড় অংশ এখনো স্মার্টফোন বা স্থায়ী ইন্টারনেট সুবিধা পায় না। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়নি। এ কারণেও সেখানে অনেকেই প্রযুক্তির সাহায্যে কোনোকিছু শিখতে পারছে না।
২০২৫ সালেও ডিজিটাল শিক্ষামাধ্যম গ্রামীণ অঞ্চলে অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে দেখা হয়। কারণ ডিভাইস, নেটওয়ার্ক, ডেটা সবকিছুই ব্যয়বহুল।
শিক্ষায় জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের কাছাকাছি ব্যয়
শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছিলেন, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পিছিয়ে থাকার ফলে গুণগত শিক্ষার প্রসারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে পরিকল্পনা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে বরাদ্দ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশ শিক্ষায় কম বাজেট বরাদ্দ করে। এদিকে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকেও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। এই হার ৬ শতাংশ করার দাবি থাকলেও এর ধারেকাছেও যেতে পারছে না বাংলাদেশ। কম বিনিয়োগের প্রভাবে শ্রেণিকক্ষ ভিড়ে ভরা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ দুর্বল, শিক্ষাসামগ্রী ও ল্যাব সুবিধা সীমিত, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের শিশুরা। এরাই বাংলাদেশের দরিদ্রতম পরিবারগুলোর সন্তান। এরাই বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ভাষা ও পাঠ্যবই বৈষম্য
পাঠ্যবইয়ের ভাষা, শিক্ষাদানের ধরন, জটিলতার মাত্রা—সবকিছু কাঠামোগতভাবে শহর-মুখী। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা যেখানে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে প্রস্তুত হয়ে ওঠে, সরকারি স্কুলের শিশুরা—আন্তর্জাতিক পরীক্ষা, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন, বৈশ্বিক চাকরির বাজার—এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে।
ভাষাগত দক্ষতার বৈষম্য দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক বৈষম্যের রূপ নেয়।
ছবি: ফ্রিপিকঅর্থনৈতিক বৈষম্য
বাংলাদেশে শিশুরা জন্মের পর থেকেই শিক্ষাগত বিভাজনের শিকার হয়। শহরের ভালো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দরিদ্র শিশুদের ভর্তি করে না বললেই চলে। স্বচ্ছল পরিবারের শিশুরা ইংরেজি মাধ্যম বা ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলে যায়। শুরুতেই তৈরি হয় আলাদা সামাজিক বাস্তবতা। একদল শিশু ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, আস্থা, নেটওয়ার্ক ও দক্ষতা অর্জন করে। অন্যদল শিশু আটকে যায় বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার লড়াইয়ে।
এভাবে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নীতি কার্যত হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্ষমতাবানদের জন্য উন্নত শিক্ষা’। শ্রেণীবৈষম্যের একটা দেয়াল ছোটবেলা থেকেই তাদের মধ্যে বিরাজমান।
মানসম্পন্ন শিক্ষক সংকট
প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই রয়ে গেছে। শিক্ষকের সংকট ভয়াবহ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো ৩৪ হাজারের বেশি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য; সাড়ে ২৪ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদও খালি। অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককেই ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। শিক্ষক যদি ক্লান্ত, অপ্রস্তুত ও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিশুদের শেখার আগ্রহও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
এছাড়াও শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে আমরা আন্দোলন হতে দেখেছি। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এত নিম্নমানের যে কোনো মেধাবী লোক শিক্ষক হতে চায় না। এমনি তাঁদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটার খবরও গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি।
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে, যা কম্পিউটার অপারেটরের সমান—এমনকি উপজেলা হিসাবরক্ষকের (১২তম গ্রেড) চেয়েও নিচে। শিক্ষকদের সম্মান বাড়াতে মুখের কথায় নয়, বাস্তব উদ্যোগ প্রয়োজন।
নীতি ও বাস্তবায়নের ফাঁক
বাংলাদেশে নীতিমালা নিয়মিত তৈরি হয়, তবে বাস্তবায়ন দুর্বল। যেমন—শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, বিদ্যালয় পরিদর্শন দুর্বল, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ফলে নীতি যতই ভালো হোক, মাঠপর্যায়ে তার ফল দৃশ্যমান হয় না। কার্যত, শিক্ষা নয়, বৈষম্যই যেন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শিশুশিক্ষা হলো রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জায়গা। যেখানে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে দুই শিশুর ভবিষ্যৎ আলাদা হয়ে যায়—সেটি উন্নয়নের পথ নয়।
সমান শিক্ষা ছাড়া সমান নাগরিক তৈরি হয় না। আর সমান নাগরিক ছাড়া কোনো জাতি দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক বা ন্যায়ভিত্তিক হতে পারে না।