leadT1ad

বৈষম্যের মহাবিপদ: কেন এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের কথা মানতেই হবে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

সুইস কোটিপতিরা যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি সোনার বার আর রোলেক্স ঘড়ি উপহার দিলেন—আর তার পরপরই মার্কিন শুল্ক কমানো হলো, এই ঘটনাকে কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য ভাবা ভুল হবে। এটি আসলে একটি স্পষ্ট বার্তা। আর সেই বার্তা হলো, টাকাওয়ালাদের ক্ষমতা ব্যবহার করলে আমেরিকার মতো রাষ্ট্রের কঠোর নীতি সহজে বদলে যায়। নোবেলজয়ী জোসেফ স্টিগ্লিৎজ হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, যদি এই বিশ্বব্যাপী ‘বৈষম্যের মহাবিপদ’ চলতে থাকে, তাহলে এ রকম টাকাওয়ালাদের হাতে আটকে পড়াটা একটি রীতির মতো হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ধনী আর গরিবের মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে, এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তাকে মানুষের তৈরি একটি সংকট হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, এই বৈষম্য রাজনীতি, সমাজ এবং এমনকি আমাদের এই গ্রহকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাঁর এই সতর্কবাণী হালকাভাবে নেওয়ার কোনো উপায় নেই।

বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের দাপট

সমস্যাটা এখন আর কিছু দুর্বল বা দরিদ্র দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা একটা বিশ্বজোড়া সংকট। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘উচ্চ আয় বৈষম্য’–এর নিচে বাস করছে। জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি বৈষম্যপূর্ণ। আর তারপরেই আছে যুক্তরাজ্য।

অধ্যাপক স্টিগ্লিৎজের বক্তব্য হলো, এই ব্যবস্থা যাঁরা টিকিয়ে রাখছেন, তাঁরা আর এর অসংগতিগুলো ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। তাই তিনি এই পুরোনো কাঠামো ভেঙে একটি নতুন কাঠামো তৈরির প্রস্তাব করেছেন। জি-২০–এর ইতিহাসে এই প্রথমবার তৈরি হয়েছে বৈষম্যবিষয়ক প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনে স্টিগ্লিৎজ এই বৈষম্যের দুনিয়া পরিবর্তনের পরিকল্পনা হাজির করেছেন। ইউরোপীয়, আফ্রিকান এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলো তা সমর্থন করেছে।

টাকার পাহাড় ও ক্ষুধার্ত মানুষ

ওই প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে ২০০০ সাল থেকে তৈরি হওয়া মোট নতুন সম্পদের ৪১ শতাংশ গেছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের পকেটে। অথচ নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ পেয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। গড়ে বিশ্বের ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি যেখানে ১৩ লাখ (১.৩ মিলিয়ন) ডলার করে বেশি রোজগার করেছেন; সেই টাকার অনুপাতে দরিদ্রতম অর্ধেক মানুষের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ৫৮৫ ডলার।

এর ফল কী? বর্তমানে ২৩০ কোটি (২.৩ বিলিয়ন) মানুষ মাঝারি বা গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ (৩৩৫ মিলিয়ন) বেশি। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, বিলিওনিয়ারদের মোট সম্পদ এখন বিশ্ব জিডিপির ছয় ভাগের এক ভাগের সমান! সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, বিলিওনিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে বিশ্বজুড়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা প্রায় সমানতালে বাড়ছে।

বৈষম্য কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়

প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এই চরম বৈষম্য কোনো অনিবার্য পরিণতি নয়। অনেকে ‘বিশ্বায়ন’ বা ‘প্রযুক্তি’র ওপর দোষ চাপিয়ে এমন দাবি করে। এটি বরং নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আইনি সিদ্ধান্তের ফসল।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা, শ্রমিকের সুরক্ষা দুর্বল করা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেসরকারীকরণ—এই সবই বৈষম্য বাড়ায়। একই সঙ্গে করপোরেট কর এবং ধনীদের ওপর উচ্চ আয়ের কর কমানোর সিদ্ধান্তও এই বৈষম্যের জন্য দায়ী।

প্রতিবেদনে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে পরিণতির কথা বলা হয়েছে, তা হলো রাজনৈতিক প্রভাব। যে দেশগুলোতে বৈষম্য খুব বেশি, সেখানে গণতন্ত্রের পতন বা স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা সাত গুণ বেশি। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ আরও মনে করিয়ে দেন যে জলবায়ুসংকটের জন্যও সুপার-রিচ বা অতিধনীদের দায়ভার অনেক বেশি। আর এর চরম মূল্য দিতে হয় গরিবদের। অধ্যাপক স্টিগ্লিটজ তাই স্পষ্টভাবে সেই বাজার-সমর্থিত যুক্তিকে নাকচ করছেন, যেখানে বলা হয়—বৈষম্য আসলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো।

নতুন বৈশ্বিক অর্থনীতির ব্লুপ্রিন্ট

জি-২০–এর বৈষম্যবিষয়ক প্রতিবেদনটিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিচালনব্যবস্থা আগাগোড়া ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস চুক্তির পর প্রথমবার এত বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তখনও যে সমস্যা চিহ্নিত হয়েছিল, আজও ঠিক তাই। সেই সময়ের মতো এখনো বৈশ্বিক নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানগুলোই সংকট, অস্থিতিশীলতা ও বৈষম্য তৈরি করছে। অধ্যাপক স্টিগ্লিৎজ এই ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন চাইছেন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বা মেধাসম্পদের (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) নিয়ম থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি, বৈশ্বিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, করব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং সার্বভৌম ঋণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার করার কথা বলেছেন।

বৈষম্য মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক কমিটি চাই

একটি ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা শুরু হতে পারে ঠিক কোথায়? অবশ্যই যেখানে বড় পরিবর্তন শুরু হয়। মানে—জ্ঞান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সর্বজনীন সত্যের মাধ্যমে। এর উদাহরণও আছে। জলবায়ুসংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক মতামত মূল্যায়নের জন্য ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ সমর্থিত যে ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ তৈরি হয়েছিল, সেটিই জলবায়ু রাজনীতিকে বদলে দিয়েছিল।

অধ্যাপক স্টিগ্লিৎজ বলছেন, এবার সময় এসেছে বৈষম্যের জন্য একই ধরনের একটি আন্তর্জাতিক কমিটি তৈরি করার। শত শত বিশেষজ্ঞ এই ধারণার সঙ্গে একমত। এই সমর্থন কোনো চরমপন্থী পদক্ষেপ নয়। এটি হলো একটি সুস্থ বিশ্বের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। আর তা যদি করা না যায়, তাহলে ট্রাম্পের চারপাশে টাকা নিয়ে যে কূটনীতিকেরা ঘুরপাক খাচ্ছেন, তাঁরাই পুরো দুনিয়ায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেন।

গার্ডিয়ান অবলম্বনে

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত