leadT1ad

মাংকিস্ফিয়ার, মমতা ও মানুষ

ধর্ষণ বা খুনের খবর ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে অনেকেই ক্যাপশন দেন, ‘এগুলা ভাইরাল হবে না, ভিক্টিম ঢাবিয়ান হইলে হইতো’। কথা সত্য। মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের সাথে তার সঙ্গে ঘটা অপরাধের নিউজ ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা সমানুপাতিক। কিন্তু আমাদের মানবতা সিলেক্টিভ কেন এবং কীসের ভিত্তিতে? ক্লাস? ধর্ম? লিঙ্গ? আমরা কি শুধু গুটিকয়েক মানুষ নিয়েই কেয়ার করি? হোয়াট ইজ মাংকিস্ফিয়ার?

মাংকিস্ফিয়ার

হোলি আর্টিজান, ২০১৬। নিব্রাস, রোহানদের ছবি অনলাইনে ভাইরাল। অনেকে পোস্ট দিলেন ফেসবুকে, তারা দেখতে কত কিউট! দেখে মনেই হয় না ক্রিমিনাল হতে পারে। তেড়ে আসলো গ্রুপ দুই। বক্তব্য– বড়লোকি চেহারা দেখে কেন সিম্প্যাথি হচ্ছে জঙ্গীদের জন্য? তোরাও জঙ্গী।

পোস্ট কোন পক্ষে দিয়েছি সেই ভিত্তিতে আমি দ্বিতীয় গ্রুপ (নট সো এক্সট্রিম যদিও)। কিন্তু গোপনে প্রথম গ্রুপের সাথেও রিলেট করেছিলাম। নিব্রাস কেমন দেখতে, কেমন কাপড় পরে, নর্থসাউথে পড়ত– এগুলা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমার বন্ধু-কাজিনদের কথা।

জুলাই আন্দোলনে মুগ্ধ পুলিশের হাতে হত্যা হওয়ার পর আমরা (পড়ুন মধ্য থেকে উচ্চবিত্ত দুধ-মাখন খাওয়া বাঙালিরা) কি তাকে আমাদের পরিচিত কারোর সাথে এসোসিয়েট করি নাই? তাঁর জায়গায় আমিও হইতে পারতাম বা আমার পরিচিত তমুক হতে পারতো – এমন ফিল করা কি খুব লজ্জার বিষয় নাকি খুবই কমন ব্যপার?

আমরা কি আমাদের মত দেখতে, আমাদের ক্লাসের, আমাদের মত অ্যাক্সেন্টে কথা বলে এমন মানুষদের প্রতিই বেশি সহানুভূতিশীল? তাহলে এই সহানুভূতির পরিধি কত মানে ঠিক কতটা নিজেকে খুঁজে পেলে কারোর ভেতর আমরা আহা উহু করি? আমরা কি নির্দিষ্ট কিছু মানুষের প্রতি সংবেদনশীল? এই নির্দিষ্ট লোকের সংখ্যাটি কত?

মাংকিস্ফিয়ার: আমাদের সংবেদনশীলতার পরিধি

১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ টুকরা টুকরা হয়, কাম্যুর বিখ্যাত বই ‘প্লেগ’ রিলিজ পায় আর জন্ম নেন রবিন ডানবার। ডানবার বড় হয়ে নৃবিজ্ঞানী এবং ইভল্যুশনারী মনোবিজ্ঞানী হিসেবে বিশাল খ্যাতি পান। এখনো তিনি দাপটের সাথে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। যাই হোক এটা পাফ পিস না, ডানবারের প্রশংসা করা এই লেখার পয়েন্ট না। পয়েন্ট হল ডানবারের ১৯৯২ সালের উদ্ভাবন– ‘ডানবার’স নাম্বার’।

ডানবারের মূল আর্গুমেন্ট ছিল একজন মানুষ কতজন মানুষের সাথে সামাজিক মিনিংফুল সম্পর্ক রাখতে পারে তার একটা কগনেটিভ সীমা আছে। এই সীমা নির্ধারণ হয় ব্রেইন সাইজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। ব্রেইন সাইজের ওপর ব্রেইনের ক্যাপাসিটি নির্ধারণ হয় যে একজন একইসাথে কতগুলো সম্পর্ক মনিটর ও মেইনন্টেইন করতে পারে। প্রাইমেট, মানে এক জাতের বানরের ব্রেইনের সাথে মানুষের ব্রেইনের সাইজ এবং কার্যক্ষমতার তুলনা দিয়ে ডানবার এই সামাজিক পরিধির নাম্বার (কতজনের সাথে একজনের সামাজিক সম্পর্ক থাকতে পারে) প্রোপোজ করেন।

মানুষের জন্য ডানবারের নাম্বার হল ১৫০। অবশ্যই সব মানুষ একরকম না। কয়জনের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে একজন মানুষ– সেই সংখ্যা মানুষ টু মানুষ ভ্যারি করে ১০০ থেকে ২৩০ এর মধ্যে। তবে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে তা ১৫০। প্রাইমেট রিসার্চ থেকে আসা এই সংখ্যক মানুষ নিয়েই গড়ে উঠে প্রত্যেকের ‘মাংকিস্ফিয়ার’ বা বানরবলয়। ডানবারের মতে এই বলয়ের অর্থাৎ ১৫০ জনের বেশি মানুষ আপনার জীবনে থাকলে আপনি আসলে ঐ ‘এক্সট্রা’ মানুষদের নিয়ে খুব একটা কেয়ার করেন না, ঐ সম্পর্ক মিনিংফুল না।

বানর আর মানুষ কি এক হল?

ট্রিগারড হবেন না। যদিও ট্রিগারড হওয়ার মতই বিষয়। আপনার মনে হতেই পারে আপনি ১৫০ জন এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ, এমনকি সমস্ত মানবজাতি নিয়ে কেয়ার করেন, ডানবার নিজে অসংবেদনশীল, খালি লেখাপড়াটাই পারে।

হতেই পারে। কিন্তু আবারও, দ্যাটস নট দ্যা পয়েন্ট। বায়োলজিকাল এন্থ্রপলজি ও ইভল্যুশনারি সাইকোলজির রিসার্চকে পুরাপুরি অকাট্য হার্ড সায়েন্স বলা যায় না, বরং সামাজিক বা সাইকোলজিকাল ইস্যুতে বানর-টু-মানুষ রিসার্চে অনেক কিছুই ধারণা মাত্র। মানুষের সমাজ যেহেতু ল্যাবের ভেতর তৈরি করা যায় না, অবজারভও করা যায় না – এটা নিয়ে সায়েন্টিফিক প্রেডিকশন বা এনালাইসিস করা কঠিন। আবার পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন সমাজ এর উপরও সেই সমাজের রীতিনীতি-সাইকোলজি নির্ভর করে। এভাবে ইউনিভার্সালি সুইপিং কমেন্ট যা সাইকিক ইউনিটি অফ হিউম্যান্স-এর নির্দেশক তা অ্যাকুরেট হবে না সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তাহলে প্রাইমেট সাইকোলজি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এক. এতে বায়োলজিকাল বেসিস অফ কালচার নিয়ে আমরা আইডিয়া পাই।
দুই. অ্যাকুরেট না হলেও এইসব থিওরি মানুষের কিছু টেন্ডেন্সির কাছাকাছি যায়।
তিন. ইটস ফান।

৭ বিলিয়ন মানুষ নিয়ে কেয়ার করা কি সম্ভব?

ডানবারের নাম্বার কি এরচেয়ে কম বা বেশি হতে পারত কি না তা নিয়ে বিভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু এই নাম্বার ৭ বিলিয়ন হবে এমন দাবি করা মানুষের সংখ্যা কমই হবে বলে আমার ধারনা। পৃথিবীর পুরো ৭ বিলিয়ন মানুষ নিয়ে কেয়ার করলে কারোর মানসিকভাবে সুস্থ থাকার কোনো কারণ নাই। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে, এই কোনো প্লেন করলো ক্র্যাশ, রোড অ্যাক্সকিডেন্টে মারা যাচ্ছে মানুষ প্রতিদিন। সবার ব্যপারে যদি মাতৃশোক হয়, তাহলে এই গ্রিফের শুরু ও শেষ কই?

আপনার মাংকিলাইক ব্রেইন আপনাকে রক্ষা করার জন্যই তার সংবেদনশীলতা সীমিত রাখে, এটাই ডানবারের বক্তব্য। অর্থাৎ এটা আপনার জন্য উপকারি, তবে ‘বাকি’দের জন্য? যেকোনো বলয়ই বলয়ের বাইরের মানুষদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কীভাবে?

আপনার বাসার ময়লা সিটি করপোরেশনের যে কর্মীরা নিয়ে যায় আপনি কি তাদের চিনেন? তাদের সাথে তো আপনার প্রতিদিন দেখা হয়। কিন্তু তারা আপনার বলয়ের বাইরে। তারা মানুষ না আপনার ব্রেইনের কাছে, ময়লা নিষ্কাশন মেকানিজমের ইউনিট। তাদের সাথে কি হয় এই ব্যপারে আপনি কতটুকু কেয়ার করেন বা করার ক্যাপাসিটি রাখেন?

মানুষের এই সীমাবদ্ধতা ওয়েপনাইজ করে রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও রাষ্ট্র।

অসংবেদনশীলতার রাজনীতি বা রাজনীতির অসংবেদনশীলতা

ট্রলি প্রবলেম নিয়ে আপনি পরিচিত হলে, মানুষের জীবনের কোয়ালিটি বনাম কোয়ান্টিটির মোরাল ডিলেমার সাথে আপনি পরিচিত। ট্রলি প্রবলেমে আপনাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা ট্রেনের ট্র্যাকে ৫ জন মানুষ আটকা, ট্রেন ছুটে আসছে, তাতে ব্রেক নেই। এই ৫ জনকে বাঁচাতে আপনি ট্রেনকে পাশের ট্র্যাকে নিতে পারেন। পাশের ট্র্যাকে আটকা একজন মানুষ। ট্রেন পাশের ট্র্যাকে নিবেন কি না—এই হল আপনার সিদ্ধান্ত।

অনেকে মনে করে ট্রেন পাশের ট্র্যাকে নেওয়া উচিত কারণ একজনের জীবনের মূল্য পাঁচজন থেকে বেশি। অনেকে তা মনে করে না, তারা এই ধারণায় সাবস্ক্রাইব করে যে প্রতিটা জীবনই পবিত্র, সংখ্যায় এর তোলভাও করা সম্ভব না। বাস্তব জীবনে বেশির ভাগ মানুষ সংখ্যার ভিত্তিতে এম্প্যাথির মাত্রা নির্ধারণ করে না। আপনার বন্ধু মারা গেলে আপনাকে শোক যতটা আচ্ছন্ন করবে, সিরিয়াতে ড্রোন পড়ে কয়েকশো লোক মারা গেলে ততটা করবে না। ইউটিউবে যুদ্ধের বিধ্বস্ততা দেখিয়ে সাহায্য চাওয়ার স্পন্সরড অ্যাডে আপনি কখনো স্কিপ দিতে পারেন, তবে প্রিয়জনের মৃত্যুবার্ষিকী আপনি চাইলেও ভুলতে পারেন না।

আপনার রাষ্ট্র বা বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্র এই অসংবেদনশীলতাকে ব্যবহার করে আপনাকে ডিস্ট্র্যাক্টেড রাখে তার নানা নৃশংস অ্যাক্টিভিটি থেকে। কাউকে কাউকে বানিয়ে দেয় ‘অপর’।

আপনার স্ফিয়ারের বাইরে, আপনার থেকে ভিন্ন দেখতে, ভিন্ন ধর্ম পালন করে, ভিন্ন পোশাক পরে– তার সাথে ঘটা নিপীড়ন নিয়ে আপনি যাতে কেয়ার না করেন এজন্য সারাবছর আপনাকে ‘ভিন্ন’কে ‘অপর’ করে দেখার তালিম দেওয়া হয়। অমুক আমার চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, হাজার বছরের সংস্কৃতি নষ্ট করছে, আমার মূল্যবোধবিরোধী কিছু চর্চা করছে– কেন?

আমাকে বিপন্ন করতে।

এখন অমুকের সাথে পুলিশ দুর্ব্যবহার করেছে, কারণ ছাড়া থানায় আটকে রেখেছে তাতে আমার কী? আমি স্ক্রল করবো নিচে। আরো নিচে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার বলয়ের কাউকে আটকে রাখা হয়, অত্যাচার করা হয়। তারপর আমি দেখবো অমুক স্ক্রল করছে নিচে। আরো নিচে। কারণ তাকেও একই তালিম দেওয়া হয়েছে, জুজুর ভয় দেখানো হয়েছে সাংস্কৃতিক-সামাজিক ভোগদখলের।

এদিকে নিপীড়িতদের দলাদলির মধ্য দিয়ে নিপীড়ন চালিয়ে যেতে পারবে রাষ্ট্রের মেকানিজম ও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো। অতি পুরানো ডিভাইড অ্যান্ড রুল।

আমরা সবাই সবার মাংকিস্ফিয়ারের বাইরের মানুষদের দেখবো একটা সিলুয়েটের মত। শৈশবহীন, স্বপ্নহীন, বোধহীন ছায়ামানব। আমরা ভোট দিবো তাদের যারা আমাদের স্ফিয়ারের লোক অথবা আমাদের স্ফিয়ারের লোকদের যারা রিপ্রিজেন্ট করে। দ্য গ্রেট ডেমোক্রেসি।

কিন্তু মানুষ (কিছু) মানুষের জন্য। আমরা পরোপকারী প্রাণী। তবে সেই উপকার করি বলয়ের ভেতরে। ধার দিই, সাপোর্ট দিই, ভোট দিই। বলয় আরো শক্ত, নিশ্ছিদ্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। কেউ ঢুকতে পারে না ভেতরে।

কারণ একটু আগেই বললাম, মানুষ পরোপকারী প্রাণী; অপরোপকারী নয়।

কীভাবে মাংকিস্ফিয়ারের লক্ষণরেখা অতিক্রম করবেন?

অসংবেদনশীলতার রাজনীতির ট্র্যাপে পা দিতে না চাইলে নিজের মাংকিস্ফিয়ারের বাইরের মানুষদের নিয়ে সচেতন হতে হবে। এইক্ষেত্রে প্রথমে যেটা করা লাগবে সেটা হল, যাকে পছন্দ করেন না তার অধিকারের ব্যপারেও সোচ্চার হতে হবে। তারপর নিজেকে জিগ্যেস করবেন কেন তাকে অপছন্দ করেন। সে কি আপনার কোনো ক্ষতি করেছে নাকি আপনাকে কোনো গুরু বুঝিয়েছে যে তার কারণেই আপনার জীবনের সব অমঙ্গল। মূলত ক্রিটিকাল রিজনিং আর সংবেদনশীলতা—দুটারই চর্চা করতে হবে।

আপনার ব্রেইনের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে সে প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ব্রেইন। সে আদিম সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে, আপনিও পারেন। ইউ আর নট আ মাংকি, ইউ ক্যান সারপাস ইওর স্ফিয়ার।

Ad 300x250

সম্পর্কিত