leadT1ad

ড. ইউনূসের সফর ঘিরে গত সাত দিন নিউইয়র্কে কী কী ঘটল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম গ্রাফিক

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয় নেতাকে সঙ্গী করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা। ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন তিনি। তাঁর এই সফরকে ঘিরে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে গেছে নানান ঘটনা। বিশেষ করে নিউইয়র্কে পৌঁছানোর দিনে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের ওপর হামলা এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুষ্ঠান ঘিরে নানারকম তৎপরতা; এসব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। গত সাত দিনে ড. ইউনূসের সফর ঘিরে কী কী ঘটেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস উইংয়ের মিনিস্টার (প্রেস) সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে পোস্ট করা ভিডিওতে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘ডক্টর ইউনূসের নিউইয়র্ক সফর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানসহ অন্যান্য যেসব কার্যক্রম ছিল, সেগুলো আসলে কতটা সম্পন্ন হলো, কতটা ভালোভাবে হলো, নাকি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা করলেন, তারা বাধাগ্রস্ত করলেন।

প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতারা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতারা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক

সেসব বিষয় নিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার মনে করছি। আরও আগেই হয়তো কথাগুলো বলা দরকার ছিল। কিন্তু যেহেতু ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম এবং সেখানে প্রতিটি দিন এবং রাত খুবই কর্মব্যস্ত থাকার কারণে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়নি।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য যখন ঢাকা ছাড়লেন বা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন থেকেই খুব সুপরিকল্পিতভাবে একটা প্রোপাগান্ডা শুরু করা হয়েছিল উল্লেখ করে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘ড. ইউনূস যখন নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেন, দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে একটা জোর প্রোপাগান্ডা শুরু করা হলো যে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস দেশ থেকে পালিয়ে চলে যাচ্ছেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস আর ফিরবেন না। কেউ কেউ এরকম সুনির্দিষ্ট করে বললেন। কেউ কেউ আবার বললেন, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস কি আর ফিরবেন? কেউ কেউ আবার একধাপ বাড়িয়ে বললেন, হাসিনা আসছে, ডক্টর ইউনূস যাচ্ছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে ডক্টর ইউনূস নিউইয়র্কে আসবেন এবং আর তিনি দেশে ফিরবেন না।’

জাতিসংঘের উদ্বোধনী অধিবেশনে ড. ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ
জাতিসংঘের উদ্বোধনী অধিবেশনে ড. ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ

এই প্রোপাগান্ডার বিষয়ে আর ‘বাড়তি কোনো তথ্য’ দিয়ে বলার দরকার নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূসের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, তাদের অনেকে ইতিমধ্যেই ফিরে গেছেন। অনেকে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডক্টর ইউনূস ৩০ তারিখ পর্যন্ত ব্যস্ত থাকবেন। সেই ব্যস্ততা শেষ করে তিনি রওনা দেবেন এবং যথারীতি বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছাবেন। অর্থাৎ এই প্রোপাগান্ডার আসলে কোনো অর্থ নাই। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম করে রাখা হয়েছিল এই ডক্টর ইউনূস যাচ্ছেন আর ফিরবেন না। পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আসবেন।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আখতার-জারা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা বীরের মতো নিউইয়র্কে এসেছিলেন, বীরের মতো ফিরে যাচ্ছেন। মেইনস্ট্রিমের সঙ্গে কাজ করে ফিরে যাচ্ছেন। এখানে কোথাও কোনো আওয়ামী লীগ নেই। আওয়ামী লীগ আছে রাস্তায়, ফুটপাতে ডিম হাতে দুই-চারজন। দেশ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত। -গোলাম মোর্তোজা

প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্কে এই সফর ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে জেএফকে বিমানবন্দরে। সেখানে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া এনসিপির আরেক নেতা তাসনিম জারা ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছে বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস কর্মকর্তাদের গাফিলতিকে দায়ী করেছে বিএনপি। আর এ ঘটনায় ব্যর্থতার জন্য নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটের সব কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার দাবি তুলেছে এনসিপি।

ডিম হামলার পর আখতার হোসেনের নাজেহাল অবস্থা। ছবি: সংগৃহীত।
ডিম হামলার পর আখতার হোসেনের নাজেহাল অবস্থা। ছবি: সংগৃহীত।

এই প্রসঙ্গেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন গোলাম মোর্তোজা। তিনি বলেন, ‘ডক্টর ইউনূসের সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ-ঘোষিত রাজনৈতিক দলটির যে নেতাকর্মীরা ঘোষণা দিয়েছিল, তাঁরা তাঁদের ভয়ংকর চেহারা দেখাবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অমান্য করবে না, কিন্তু ভয়ংকর চেহারা দেখাবে। তো এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এখানে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সিক্রেট সার্ভিস, এফবিআই, পুলিশ, ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি সংস্থাসহ সবাইকে সুনির্দিষ্ট করে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী তাদের প্রস্তুতিও ছিল। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের যে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের যে আওয়াজ ছিল, যে প্রোপাগান্ডা ছিল; সে অনুযায়ী তারা কোনো কাজই করতে পারেনি। কোনো প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করতে পারেনি।’

‘জেএফকে বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল আসে, সেদিন কিছুটা ভিসা জটিলতায়, কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি, তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি, আর কিছুটা অসচেতনতার কারণে একটা সুযোগ এই সন্ত্রাসীরা পেয়ে যায়’, বলে জানান প্রেস মিনিস্টার। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ড. ইউনূসের সঙ্গে সবার বেরিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু কয়েকজনের ভিসা জটিলতার কারণে একসঙ্গে আসতে পারেননি। তাঁদের ভিন্ন পথে আসতে হয়েছে। যেদিন দিয়ে আসতে হয়েছে, ঠিক সেখানেই আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা করেন, তাদের ২০-২৫ জন ছিলেন। তারা ভয়ংকর চেহারা... আওয়ামী লীগের ভয়ংকর চেহারা কী? মানে ভয়ংকর গালিগালাজ। যে গালিগালাজ আপনি, আমি বা অন্য যে কেউ মুখে আনতে পারবে না, সেই গালিগালাজ তারা করেছে। আর আখতারের পিঠে একটি ডিম নিক্ষেপ করেছে।’

বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অংশে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অংশে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভুল বুঝাবুঝি আছে, আমাদের অসচেতনতা ছিল, পুরো সামগ্রিকভাবে সবার কথা বলছি। সেখানে বিএনপির দুই-তিনশো নেতাকর্মী ছিল। আমি আগের একটি ভিডিওতে বলেছিলাম যে সেখানে এনসিপির নেতাকর্মীরা ছিল না, তাঁরা হোটেলে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে আমি আরও জানলাম যে সেখানে এনসিপির নেতাকর্মীরাও ছিলেন। সংখ্যায় যে তারা আওয়ামী লীগের থেকে কম ছিলেন, তা নয়। বিএনপির সঙ্গে একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল, বিএনপি মনে করেছিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বহরের সঙ্গে তাদের নেতারাও বের হয়ে গেছেন। এই কারণে বিএনপি সেই জায়গাটি ছেড়ে দেয়। সেই সুযোগটা আওয়ামী লীগ নেয়।‘

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণের বাইরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানটি ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের একটি হোটেলে। সেখানে ড. ইউনূস যাতে অনুষ্ঠান করতে না পারেন, সেই বিষয়ে ‘ব্যাপক প্রস্তুতি’ নেওয়ার আওয়াজ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু সন্ত্রাসী নই, আমরা যেহেতু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে অভ্যস্ত নই, স্বাভাবিকভাবেই সিক্রেট সার্ভিসসহ এখানকার সবাইকে জানানো হয়েছিল। আর এই জায়গায় বিএনপি, জামাত এবং এনসিপির নেতাকর্মীরাও অসম্ভব তৎপর ছিল। এই তৎপরতার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় প্রোগ্রামটি... যে প্রোগ্রামটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা করতে দেবে না— এরকম একটি পণ করেছিল। তাদের কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী অন্যান্য দেশ থেকেও এসেছে। অন্যান্য রাজ্য থেকে তারা তাদের লোকজনদের এনে জড়ো করেছিল বলে আওয়াজ দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে যে হোটেলটিতে ড. ইউনূসের প্রোগ্রামটি হয়েছে, সেই হোটেলের আশপাশে কোথাও কোনো জায়গাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সন্ত্রাসী কারো কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় নাই। তাঁরা প্রচার করেছিল যে তারা অনুষ্ঠানের ভেতরে ঢুকবে অর্থাৎ হলরুমের ভেতরে ঢুকবে, গোপনে। ঢুকে সেখানে গিয়ে তারা স্লোগান দেবে, বিশৃঙ্খলা করবে। কিন্তু সেই সাহসটিও তারা করতে পারেনি।’

নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার যেসব কর্মসূচি ছিল, সব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান প্রেস মিনিস্টার। আর ডিম নিক্ষেপের যে ঘটনা ঘটেছে সেটির উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বলে রাখা দরকার যে ডিম নিক্ষেপ বা গালিগালাজ করা, উত্তর আমেরিকায় বড় কোনো অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। এটা খুব সাধারণ অপরাধ। এটার জন্য পুলিশ গ্রেফতারও করে না।’

কিন্তু এমন একটি ঘটনাকে আওয়ামী লীগ ‘বিশাল বিজয়’ হিসেবে দেখিয়েছে উল্লেখ করে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনা দিল্লিতে বসে যে আওয়ামী লীগের যে সন্ত্রাসী কর্মীটি ডিম নিক্ষেপ করেছিল আখতারকে, তাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই অসভ্য কর্মকাণ্ড করে দেশ থেকে যেরকম দেশ থেকে যেমন আওয়ামী লীগ বিতাড়িত হয়েছে, একই রকমভাবে বিদেশ থেকেও আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কার থেকে বিচ্ছিন্ন? সাধারণ জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আখতার হোসেন- তাসনিম জারা ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা বীরের মতো নিউইয়র্কে এসেছিলেন উল্লেখ করে প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘তাঁরা বীরের মতো এসেছিলেন, বীরের মতো ফিরে যাচ্ছেন। মেইনস্ট্রিমের সঙ্গে কাজ করে ফিরে যাচ্ছেন। এখানে কোথাও কোনো আওয়ামী লীগ নেই। আওয়ামী লীগ আছে রাস্তায়, ফুটপাতে ডিম হাতে দুই-চারজন। দেশ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত। এখন প্রবাস থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন এবং বিতাড়িত হবার পথে আছেন। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্ব কেউ ঠেকাতে পারবে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে তাদের বিলীন হয়ে যাওয়াটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত