leadT1ad

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল /এনসিসিতে আস্থা জামায়াত-এনসিপির, বিএনপির কাছে ‘একের ভেতর আরেক সরকার’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাকাঠামো আগের মতোই থাকবে নাকি পরিবর্তন আনা হবে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর অবস্থান এখন দুই মেরুতে।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫, ১৮: ১৭
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ২৩: ১৩
জাতীয় ঐকমত্য কমিটির বৈঠক শেষে বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের সাক্ষাৎ। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল- এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। গতকাল ১৮ জুন (বুধবার) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপিসহ কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করে। বিএনপি ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত রূপ ধরে রাখার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দেয়।

যা বলছে দলগুলো

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করেছে, এটি গঠিত হলে নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব হবে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় জবাবদিহিতা বিঘ্নিত হবে।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেখানে ক্ষমতা থাকবে, সেখানে জবাবদিহিতা না থাকলে সেটি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এই কাউন্সিলকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কারও কাছে তারা জবাবদিহি করবে না। এটি কার্যত “এক সরকারের ভেতর আরেক সরকার” তৈরি করবে।’

অন্যদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য এনসিসি জরুরি। তবে এনসিসির গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। আমরা চাই না রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি এর সদস্য হোন।’

যারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে চায় না, তারাই এনসিসি চায় না উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় এনসিসির বিকল্প নেই।’

আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণসংহতি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও একই মত দিয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিটির বৈঠক। সংগৃহীত ছবি
জাতীয় ঐকমত্য কমিটির বৈঠক। সংগৃহীত ছবি

প্রস্তাবিত এনসিসি কাঠামো নিয়ে বিরোধ

প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে মতবিরোধ আছে। এনসিসির আওতায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনের এখতিয়ারের ব্যাপারেও আপত্তি জানিয়েছে এই দুই দল।

অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই এ সব প্রক্রিয়া বলবৎ রেখে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।

গণভোটের আহ্বান

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এনসিসি গঠন নিয়ে যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য সম্ভব না হয়, তবে এ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে তারা মনে করে।

অন্যদিকে বিএনপি ও তার সহযোগী ১২ দলীয় জোট বলেছে, গণভোটের প্রয়োজন নেই, বরং নির্বাচন পরবর্তী সংসদে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। তারা মনে করে, বর্তমান নিয়োগব্যবস্থা সংশোধন এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়িয়ে একটি ভারসাম্যমূলক কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ

কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৬৪ জেলা ও ১২ সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ইলেকটোরাল কলেজ গঠন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া চালু করা হোক। প্রতিটি জেলা ও সিটির চেয়ারম্যান, মেয়র ও ভাইস চেয়ারম্যান মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার জনপ্রতিনিধি এতে ভোট দেবেন।

বিএনপি, এলডিপি, সিপিবি, বাসদ ও গণফোরাম এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ হয় না, ফলে এই ভোটারেরা কার্যত সরকারপন্থী হবেন। বিএনপি চায়, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করে তাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

জামায়াত কিছুটা নমনীয় অবস্থানে থেকে বলেছে, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের বাদ দিয়ে চেয়ারম্যানদের রাখা যেতে পারে, তবে এই পুরো পদ্ধতি বাস্তবায়নের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।

সিপিবি-গণফোরামের ওয়াকআউট

লন্ডনে বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত ১৮ জুনের আলোচনায় অনুপস্থিত ছিল। তবে পরে প্রধান উপদেষ্টার ফোনে আশ্বস্ত হয়ে তারা সংলাপে ফিরে আসে। এদিন জামায়াতের প্রতিনিধিদের বেশি সময় বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ওয়াকআউট করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জামায়াতের তিনজন বক্তব্য দিলেও আমাদের একজন নেতাকে বাধা দেওয়া হয়। এটি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ।’

তবে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও প্রধান উপদেষ্টার সহকারী মনির হায়দার পরে ওয়াকআউটকারী নেতাদের আবার আলোচনায় ফিরিয়ে আনেন।

গত ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত কমিশন ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ শুরু হয়, এরপর ৩ জুন থেকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হয়। প্রথম তিনটি ইস্যুতে আলোচনা হলেও এনসিসি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে আলোচনা একপর্যায়ে মুলতবি করা হয়, যা এখন পুনরায় শুরু হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত