ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত’ খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রাথমিকভাবে মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তন করে ডুমুরিয়া উপজেলা কমিটির হিন্দু শাখার সভাপতি কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সমীকরণ এবং নির্বাচনী বাস্তবতার কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জামায়াতের দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে খুলনা জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা এমরান হোসাইন গতকাল বুধবার (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জানান, গত ১ ডিসেম্বর খুলনায় ৮ দলের বিভাগীয় সমাবেশে এসে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এই সিদ্ধান্ত দেন। পরবর্তীতে গতকাল বুধবার বিকেলে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকে এটি আলোচিত হয় এবং সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষ্ণ নন্দীর নাম ঘোষণা করা হয়নি।
এর আগে খুলনা-১ আসনে বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির শেখ আবু ইউসুফকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তিনি সেখানে কয়েক মাস ধরে গণসংযোগও করছিলেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দফায় খুলনা-৪, খুলনা-৫ ও খুলনা-৬ আসনে প্রাথমিকভাবে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বাকি তিন আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি, যার মধ্যে খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে শেখ আবু ইউসুফের নাম ছিল।
প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবু ইউসুফ বলেন, ‘খুলনা-১ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করে সম্প্রতি ডুমুরিয়া উপজেলা কমিটির হিন্দু শাখার সভাপতি কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এটা জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান আমাকে জানিয়েছেন।’
মাওলানা ইউসুফ আরও বলেন, তিনি এখন কৃষ্ণ নন্দীর পক্ষে প্রচারণা শুরু করেছেন এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণ নন্দীর বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে এবং সেখানে তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কৃষ্ণ নন্দী ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামী হিন্দু শাখার নেতা হন এবং সেখানে দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে দেখা গেছে।
সম্প্রতি ডুমুরিয়া উপজেলার এক সভায় কৃষ্ণ নন্দী বলেন, ‘আমি ২০০৭ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ সময়ে সদস্যদের দুঃখ-কষ্টে পাশে থেকেছি। গেল আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের সময়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। দেড় বছর আগে ডুমুরিয়ায় দলের হিন্দু শাখার সভাপতির দায়িত্ব পাই।’
দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়ন পেতে হলে প্রার্থীকে ন্যূনতম ‘রুকন’ হতে হয়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের বাইরেও প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি দলের মধ্যে আলোচনায় আছে। সেক্ষেত্রে আসন্ন নির্বাচনে কিছু আসনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনোনয়ন দেওয়ার ‘বাস্তবতা’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য, খুলনা জেলার সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান মিজান। তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ রাজনৈতিক দল। যে আসনে যখন যাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বা হবে, তার বিজয়ের জন্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন এবং করবেন।’
প্রার্থী ঘোষণার পর কৃষ্ণ নন্দী জানিয়েছেন, ‘দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আগেই ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। এখন দল আমাকে মনোনীত করেছে, আমি আত্মবিশ্বাসী যে সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে জয় এনে দিতে পারব। দাকোপ-বটিয়াঘাটায় অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটার আছেন। তাদের আস্থা ও সমর্থনই হবে আমার শক্তি।’
জামায়াতের মতো ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত দলকে লক্ষ্য করে কৃষ্ণ নন্দী বলেন, হিন্দু প্রার্থী ঘোষণাকে তিনি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বহুত্ববাদী রাজনীতির নতুন সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
অন্য আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, খুলনা-১ আসনে নিজের বাড়ি না থাকলেও সেখানে তাঁর অনেক স্বজন রয়েছেন। আর খুলনা-৫ আসনে (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) তাঁর নেতা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার নিজে নির্বাচন করবেন। তিনি আগেও এ আসনের এমপি ছিলেন।
খুলনা-১ আসনটি হিন্দু অধ্যুষিত। জামায়াত নেতা শেখ আবু ইউসুফ ১৯৯৬ সালে এখান থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরের পাঁচটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী এখানে আর কোনো প্রার্থী দেয়নি। দীর্ঘ তিন দশক পর আবার সেখানে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের প্রচার চালাচ্ছে। খুলনা-৫ আসনও হিন্দু অধ্যুষিত। গত এক বছর ধরে ডুমুরিয়া ও ফুলতলায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে কৃষ্ণ নন্দীকে দেখা গেছে। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিটি সমাবেশেই সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষদের সরব উপস্থিতি ছিল।