leadT1ad

এবারের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে হেভিওয়েট ‌কারা, কেন

এবারের ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি বা ভিপি পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন। এদের মধ্যে কাদের দিকে নজর থাকবে সবার? কেন থাকবে? সংগঠন, সাংগঠনিক ক্ষমতা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণের আন্দোলনে সক্রিয়তা; এসব বিচারের জায়গা থেকে চলুন, এমন কয়েকজন প্রার্থীর ওপর নজর ফেরানো যাক।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ২৫
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১৪
ডাকসু নির্বাচনে আলোচিত ভিপি প্রার্থীরা (স্ট্রিম গ্রাফিক্স)

রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন সূচনার মুখ দেখেছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সেই প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতির নয়, পুরো ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণের লিটমাস টেস্ট হিসেবে। এ কেবল ভোটের লড়াই নয়; এটি রাজনৈতিক চেতনা, আদর্শ এবং ছাত্র নেতাদের নেতৃত্বদানের সামর্থ্য পরিমাপের মঞ্চ।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগের অনুপস্থিতি ক্যাম্পাসে একটি শূন্যস্থান তৈরি করেছে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেরই রয়েছে রাজনৈতিক হয়রানি, নিপীড়ন ভোগ করবার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কীভাবে ব্যক্তিগত সংগ্রাম, মূল্যবোধ ও সাহস গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে মিলিত হতে পারে, এবারের ডাকসু নির্বাচন তা প্রমাণের সুযোগ। এখান থেকেই বোঝা যাবে—কীভাবে অতীতের যন্ত্রণা, গণ-আন্দোলনের স্মৃতি এবং ব্যক্তিগত সংগ্রাম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে গঠন করে।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি বা ভিপি পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন। এদের মধ্যে কাদের দিকে নজর থাকবে সবার? কেন থাকবে? সংগঠন, সাংগঠনিক ক্ষমতা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণের আন্দোলনে সক্রিয়তা; এসব বিচারের জায়গা থেকে চলুন, এমন কয়েকজন প্রার্থীর ওপর নজর ফেরানো যাক।

আবিদুল ইসলাম খান, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

এবারের নির্বাচনের অন্যতম আলোচিত মুখ হলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। তার প্রার্থিতা ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে ছাত্রদল ছিল ক্যাম্পাসের সবচেয়ে নিপীড়িত সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে বারবার উঠে এসেছে ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলা, হল থেকে বের করে দেওয়া এবং পুলিশি হয়রানির খবর। অনেককে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমেও অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আবিদ ও তাঁর সহকর্মীরাও এই নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

ছাত্রদলের অনেকের মতে, আবিদের প্রার্থিতা কেবল দলীয় নয়। এটি সেই বঞ্চনার ইতিহাসের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি আদায়ের একটি প্রয়াস। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তার আবেগময় আহ্বান—‘প্লিজ, কেউ কাউকে ছেড়ে যাইয়েন না’—তাকে দলীয় পরিচয়ের বাইরে মানবিক নেতা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি পরে লিখেছেন ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’। জুলাই আন্দোলনের আগে ও পরে বিভিন্ন গণ-অভ্যুত্থান এবং সামাজিক আন্দোলনে তিনি সবসময় সম্মুখ সারিতে ছিলেন।

সম্প্রতি বিভিন্ন টিভি টক-শোতে তার প্রাসঙ্গিক ও প্রভাবশালী বক্তৃতা তাকে আলোচনায় এনেছে। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও তার পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় নেমেছেন। সব মিলিয়ে, দলীয় ভিত্তি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ আবিদুল ইসলাম খানকে এবারের নির্বাচনে এক প্রভাবশালী ভিপি প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখছে।

আব্দুল কাদের, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ

‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের। এই প্যানেল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী কাদের জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই তিনি সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচিত মুখ।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই কাদের ও তার সহযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। ২০২২ সালে শহীদ আবরার ফাহাদের স্মরণসভা আয়োজনের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়; জেলে থাকায় সে বছর চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাননি।

জুলাই অভ্যুত্থানে তিনি সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেন এবং ৯ দফা ঘোষণা করেন। অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক পদ পান। আন্দোলনের পর থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যান্য নেতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও তার পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ প্যানেলের ছবি শেয়ার করেছেন। একাধিক যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সদস্য সচিবও ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সমর্থন ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে।

তাসনিম আফরোজ ইমি, প্রতিরোধ পর্ষদ

বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’-এর ভিপি প্রার্থী তাসনিম আফরোজ ইমি। খুলনার মেয়ে ইমি ক্যাম্পাসে সাহসী ও প্রগতিশীল ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও শামসুন নাহার হল সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর প্রতিবেদন এটিকে ছাত্রলীগের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে দেখেছিল।

গত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বৃদ্ধি, আবাসন সংকট এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইস্যুতে বামপন্থী কর্মীরা সোচ্চার ছিলেন। ইমি’র প্রার্থিতা এই লড়াইয়েরই প্রতিফলন। ২০১৮-এর কোটা আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক যে কোনো আন্দোলনে ইমি ছিলেন পরিচিত মুখ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দেন এবং পরে পদত্যাগ করেন। ২০২৩ সালের মার্চে সারা দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণও তাঁর পরিচিতি আরও দৃঢ় করেছে।

উমামা ফাতেমা, স্বতন্ত্র প্যানেল

জুলাই অভ্যুত্থানের আরেক জনপ্রিয় মুখ উমামা ফাতেমা। তিনি স্বতন্ত্র প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। বিগত আমলে, বিশেষত চব্বিশের গণ-আন্দোলনের অন্যতম নারী মুখ হওয়ায় উমামাকে দুই দিক থেকে আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। একদিকে ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঝুঁকি, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ব্যক্তিগত ও লিঙ্গবাদী আক্রমণ। সে সময়ের বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও মানবাধিকারকর্মীদের পর্যবেক্ষণে বিষয়গুলো উঠে আসে।

নারীদের চরিত্র হনন করে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগের। তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল উমামা। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তিনি কবি সুফিয়া কামাল হলের সমন্বয়ক ছিলেন। পরে বিভিন্ন আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করেছেন। অভ্যুত্থানের পর তিনি ছাত্র ফেডারেশন থেকে অব্যাহতি নেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্বতন্ত্র প্রার্থিতা প্রচলিত প্যানেল রাজনীতির প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সাংগঠনিক ভিত্তিকে গ্রহণ না করে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি কতটা সফল হবেন, তা দেখার বিষয়।

সাদিক কায়েম, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট

ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর ভিপি প্রার্থী সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম। জুলাই আন্দোলন কিংবা শেখ হাসিনার আমলে রাজপথে আন্দোলনের ছবি, ভিডিও কিংবা নথিতে সাদিকের উপস্থিতি সেভাবে গণমাধ্যমে পাওয়া যায় না। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, স্বৈরাচারের শাসন আমলে ক্যাম্পাসে তাঁরা গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তিনি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন, বলে দাবি করেন তাঁর সমর্থকরা।

বিভিন্ন হলে ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক অবস্থান তাকে এগিয়ে রাখতে পারে। এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজের প্রচার-প্রচারণায়ও সাদিক এগিয়ে রয়েছেন। এটি ভোটের মাঠকে প্রভাবিত করতে পারে। ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের মূল শক্তি তাদের কর্মী বাহিনী (ক্যাডারভিত্তিক ভোট)। প্রতিটি হলে তাদের উপস্থিতি আছে। তবে, শিবিরের মূল সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস তাঁর ফলাফলে প্রভাব রাখবে মনে হয়। নিজেদের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকের বাইরে সমর্থন পাওয়া তাদের জন্য কঠিন।

বিন ইয়ামিন মোল্লা, ছাত্র অধিকার পরিষদ

নতুন মুখদের সঙ্গে আলোচনায় রয়েছেন ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ থেকে ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন মোল্লা। তিনি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পরিচিতি পান। বর্তমানে তিনি ছাত্র অধিকার পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। ২০২২ সালের আবরার ফাহাদের স্মরণসভা আয়োজনের কারণে তাকে মারধর করা হয়।

পরে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি দীর্ঘ সাত মাস কারাভোগ করেন। অভ্যুত্থানের পর পিএসসি সংস্কার আন্দোলন, ডাকসু আন্দোলনসহ একাধিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এইবারের ডাকসু নির্বাচনে হেভিওয়েট ভিপি প্রার্থীরা প্রত্যেকেই ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছেন। জুলাই অভ্যুত্থান, কোটা সংস্কার আন্দোলন, ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, ও স্বতন্ত্র নারী নেতৃত্ব—সবই তাদের পরিচয়কে সমৃদ্ধ করেছে। ভোটের মাঠে কে শেষ গোলটি করবেন, তা এখন দেখার বিষয়।

Ad 300x250

যে ছয় মাস আছি, প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইডের ব্যবস্থা করে যাব: আইন উপদেষ্টা

মুসলমানি-বাংলা থেকে বাংলাদেশি: ভাষার রাজনৈতিক বিভাজন

রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে প্রস্তুত: খলিলুর রহমান

ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পাটশিল্পে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা

‘রোহিঙ্গা সংকট স্থবির হয়ে আছে, সমাধানে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা জরুরি’

সম্পর্কিত