সালেহ ফুয়াদ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এ কারণে চলতি অক্টোবর মাসেই আমির নির্বাচন করে নতুন নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে দলটি। স্ট্রিমকে জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে সংগঠন নতুন নেতৃত্বে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এ মাস থেকেই।
জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিকবার আমির হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে বর্তমান আমিরেরও আবার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডা. শফিকুর রহমান বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, এবারের নির্বাচনে কারামুক্ত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহেরসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে তাঁর। জামায়াতের সাম্প্রতিক কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমান আমিরকে নিয়ে মিশ্র মনোভাব রয়েছে দলের ভেতর। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৬৬ বছর বয়সী ডা. শফিকুর রহমান নিজেও আর দলপ্রধান থাকতে চান না বলে শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি তিনি বাইপাস সার্জারি করিয়েছেন।
জামায়াত যে চলতি অক্টোবরেই আমির নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা সংগঠনটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম নির্বাহী পরিষদের একাধিক সদস্য স্ট্রিমকে নিশ্চিত করেছেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারাক হোসাইন স্ট্রিমকে বলেন, ‘জামায়াতের জন্ম থেকে একই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় অরগানাইজেশনে তিন বছরের জন্য আর জেলা অরগানাইজেশনে দুই বছরের জন্য আমির নির্বাচন করা হয়। কখনোই এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কোনো পরিস্থিতিই এটাকে স্টপ করায়নি। এটাই আমাদের গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই হিসেবে অক্টোবরেই আমরা নতুন আমির, নতুন সেটাপ শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথমেই আমির নির্বাচন করা হবে।’
আগামী জানুয়ারিতে নতুন আমির দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন মোবারাক হোসাইন। অন্যদিকে নতুন আমিরের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরেই ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধান নির্বাচন করতে গিয়ে দলটি কোনো রকম সমস্যায় পড়বে না বলে জানিয়েছেন জামায়াতের একাধিক নেতা। তাঁদের মতে, আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি জামায়াত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মেনে প্রায় নিঃশব্দে শেষ করে আনবে।
অক্টোবরে আমির নির্বাচনের প্রসঙ্গটি বিদেশি কূটনীতিকদেরও ইতিমধ্যে জানিয়েছে জামায়াত। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজারভেশন মিশনের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াত নেতারা। সেখানে দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে জামায়াতের আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলাপ ওঠে। বৈঠকে উপস্থিত দুজন নেতা স্ট্রিমকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গত জুলাইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় পড়ে যাওয়া, পড়ে গিয়েও না থেমে আবারও বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জামায়াতের প্রান্তিক সমর্থক-কর্মীদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। ডাকসুতে শিবিরের জয়ের পর এই জনপ্রিয়তা আরও একধাপ ওপরে উঠেছে। -অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের সবগুলো জেলার রুকন বা শপথধারী সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে আমির নির্বাচন করে থাকে জামায়াত। ফলে প্রক্রিয়াটি শেষ করে আনতে সময় লাগে। এ কারণে দলের ভেতর মাসাধিককাল নির্বাচনী কার্যক্রম চলতে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটি নিবিড়ভাবে সম্পন্ন করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন কমিশন।
জামায়াতের আমির নির্বাচনের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দলটির নির্বাচনী বিভাগ। এই বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথমে দলের মজলিসে শূরার সদস্যরা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তিন সদস্যের একটি প্যানেলকে নির্বাচিত করেন। পরে সেই তিন সদস্যের যেকোনো একজনকে সরাসরি ভোট দেন সারা দেশের রুকন সদস্যরা। যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান তিনিই পরবর্তী তিন বছরের জন্য আমির নির্বাচিত হন।
অর্থাৎ আমির নির্বাচনের আগে দুই ধাপে ভোট হবে। প্রথমবার ভোট দেবেন জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্যরা। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তাদের মাধ্যমে তিনজনকে আমির নির্বাচনের জন্য প্রাথমিকভাবে সামনে আনা হবে। মূলত এই তিনজনই দলীয়ভাবে আমির হওয়ার জন্য বিবেচ্য হবেন। চিঠি দিয়ে মজলিসে শূরার এই ‘প্রস্তাবনা’ রুকনদের জানানো হবে। সেখানে এ কথাও উল্লেখ থাকবে যে, যোগ্য বিবেচনায় কোনো রুকন চাইলে প্রস্তাবিত তিনজনের বাইরে অন্য কাউকে ভোট দিতে পারবেন। রুকনদের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তিকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমির হিসেবে শপথ পাঠ করাবেন।
বর্তমানে জামায়াতের মজলিসে শূরায় ৩২০ থেকে ৩২৫ জন সদস্য রয়েছেন। আর সারা দেশে রুকন রয়েছেন আরও ১ লাখের বেশি। প্রতি তিন মাস অন্তর এই সংখ্যার হালনাগাদ প্রতিবেদন পায় দলটি। এ তথ্য জানিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ২০২৬-২০২৮ মেয়াদের আমির নির্বাচন এই অক্টোবরেই অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনী কাজ শেষ করে আনতে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।
জামায়াত কীভাবে দলের আমির নির্বাচন করতে যাচ্ছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারাক হোসাইন স্ট্রিমকে জানান, অতীতে বৈরী পরিবেশেও মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমির নির্বাচন করা হয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। তিনি বলেন, ‘এটা একটা লং টাইম প্রসেস। এই প্রক্রিয়ায় এক-দেড় মাস সময় চলে যায়।’
২০২৬-২০২৮ মেয়াদের আমির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুমকে। স্ট্রিমের পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুধে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জামায়াতে আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন এর নির্বাহী পরিষদ সদস্যরা। জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আমির নির্বাচনের জন্য মজলিসে শূরা যে তিনজনের নাম রুকনদের সামনে প্রস্তাব করে সচরাচর তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্যই হয়ে থাকেন। জামায়াতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদই দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক ফোরাম।
কুড়ি জনের নির্বাহী পরিষদে রয়েছেন দলটির বর্তমান আমির ডা. মো. শফিকুর রহমান, তিনজন নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সাত জন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল—মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মুয়াযযম হোসাইন হেলাল, মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের দুই আমিরসহ আরও ৯ জন আছেন এই পরিষদে।
সম্ভাবনা রয়েছে এটিএম আজহারের: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে গত বছরের ৫ আগস্টের পরে খালাস পাওয়া এটিএম আজহারুল ইসলামও নির্বাহী পরিষদের সদস্য।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি ১৯ জন নেতাকে জামায়াত ২০২৩-২০২৫ মেয়াদে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে। সেখানে এটিএম আজহারের নাম ছিল না। তবে খালাস পাওয়ার পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ (মজলিসে আমেলা) ও মজলিসে শূরায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই তিনটি ফোরামই মূলত জামায়াতের প্রধান চালিকাশক্তি।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত এটিএম আজহার জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১২ সালে ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছরের ২৭ মে অভিযোগ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় উচ্চ আদালতে আপিলের ভিত্তিতে খালাস পান তিনি। এর আগে তাঁর মুক্তির জন্য জামায়াত রাজপথে একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেগুলোতে দলটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলে পদে দায়িত্ব সামলেছেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ২০০১-২০০৬ সময়কালে চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার স্থলাভিষিক্ত হওয়া দলে আজহারের গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কারাবন্দী থেকেও গত ১৩ বছর ধরে মজলিসের শূরার সদস্যদের গোপন ভোটে শূরার সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন এটিএম আজহার। যোগ্যতা ও দলের প্রতি ত্যাগের কারণে তাঁকে আমির বানানোর গুঞ্জন শুরু হয়েছিল কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই। সাংগঠনিক নিয়মের কারণে নির্বাচন ছাড়া আমির হওয়ার উপায় নেই জামায়াতে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই নেতাকে মুক্তি পাওয়ার পরেই মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলাদা কক্ষ দেওয়া হয়। সেখানে নিয়মিত বসছেন তিনি। অংশ নিচ্ছেন দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারের আমির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এই অধ্যাপক স্ট্রিমকে বলেন, জামায়াত যে প্রক্রিয়ায় আমির নির্বাচন করে তাতে আগে থেকে নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলা কঠিন। নির্বাচিত যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন নিঃসন্দেহে তাঁরা দলের পরীক্ষিত নেতা। দলীয় অবদান, অন্যান্য কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ, আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখেই হয়তো তারা তাদের আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচন করবে।
ডা. শফিকুর রহমানের তৃতীয়বারের সম্ভাবনা: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের গ্রেফতারের পরে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব যায় ডা. শফিকুর রহমানের হাতে। পরে ২০১৬ সালে ৩ বছরের জন্য তিনি সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রথমবার আমির নির্বাচিত হন ডা. শফিকুর রহমান। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই বছরের ২৭ অক্টোবর ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো তিনি আরও একবার আমির নির্বাচিত হন। এই অক্টোবরে আবারও আমির নির্বাচিত হলে এটি হবে তাঁর তৃতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণ।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বৈরী পরিস্থিতিতে দলকে ভেতর থেকে মজবুত রাখা, চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা পালন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে-বাইরে দলকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, পাঁচ আগস্টের পরে নোয়াখালীর বন্যায় ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা, জুলাইয়ে হতাহতদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শিবিরের নেতৃত্বাধীন প্যানেলগুলোর জয়ের পেছনে ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কয়েকজন রুকন স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, এসব কারণে বর্তমান আমিরের আবারও নির্বাচিত হওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ক্ষমতার অংশ হতে পারে বলেও মনে করেন তাঁরা।
তবে গত মার্চে ইফতার মাহফিলে এতিম শিশুদের চুমু দিয়ে বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান। এ বছর পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে আরেক দফা দলীয় কর্মীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে গিয়ে জামায়াতের অনেক নেতাকে এবার সশরীরে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গেছে। অনেকের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণেও ফেসবুকে তাঁর সমালোচনা হচ্ছে।
এসবের পরেও গত জুলাইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় পড়ে যাওয়া, পড়ে গিয়েও না থেমে আবারও বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জামায়াতের প্রান্তিক সমর্থক-কর্মীদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তবে ডাকসুতে শিবিরের জয়ের পর তাঁর এই জনপ্রিয়তা আরও একধাপ ওপরে উঠেছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইআইইআর) পরিচালক, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন। তাঁর মতে, ‘বর্তমান আমির জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল স্ট্রিমকে বলেন, ‘এটিএম আজহার দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে বর্তমান আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে এখনও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। এ কারণে আন্দোলনের সামনে তাঁকে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া নির্বাচনের আগে নতুন আমির হলে সংগঠন গোছাতে সময় লেগে যাবে। এ কারণেও বর্তমান আমিরেরই নেতৃত্বে থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির চর্চা করে আসা সংগঠন। এ কারণে আনুগত্য বেশি, নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক কম। ছোটখাটো বিতর্ক নীতিনির্ধারণে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে না।’
এর বাইরে জামায়াতের তিনজন নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নামও মজলিসে শূরার গোপন ভোটে নির্বাচিত হয়ে রুকনদের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতায় এটিএম আজহার ও বর্তমান আমিরই এগিয়ে আছেন বলে মনে করেন আইআইইআর-এর পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন। তাঁর মতে, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের জনপ্রিয়তা ও দক্ষতা থাকলেও বয়স ও পরহেজগারিতা বিবেচনায় বর্তমান আমির এগিয়ে আছেন, তাছাড়া ডা. তাহেরের হাতে আমির হওয়ার জন্য এখনও সময় আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে জামায়াতের নানারকম নীতিকৌশলে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আসন্ন আমির নির্বাচনে এর প্রভাবও পড়তে পারে। আমির যিনিই হোন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলের নেতৃত্ব বেছে নেওয়া জামায়াতের জন্য যে এই মুহূর্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাতে কারো সন্দেহ নেই।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এ কারণে চলতি অক্টোবর মাসেই আমির নির্বাচন করে নতুন নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে দলটি। স্ট্রিমকে জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে সংগঠন নতুন নেতৃত্বে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এ মাস থেকেই।
জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিকবার আমির হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে বর্তমান আমিরেরও আবার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডা. শফিকুর রহমান বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, এবারের নির্বাচনে কারামুক্ত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহেরসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে তাঁর। জামায়াতের সাম্প্রতিক কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমান আমিরকে নিয়ে মিশ্র মনোভাব রয়েছে দলের ভেতর। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৬৬ বছর বয়সী ডা. শফিকুর রহমান নিজেও আর দলপ্রধান থাকতে চান না বলে শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি তিনি বাইপাস সার্জারি করিয়েছেন।
জামায়াত যে চলতি অক্টোবরেই আমির নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা সংগঠনটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম নির্বাহী পরিষদের একাধিক সদস্য স্ট্রিমকে নিশ্চিত করেছেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারাক হোসাইন স্ট্রিমকে বলেন, ‘জামায়াতের জন্ম থেকে একই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় অরগানাইজেশনে তিন বছরের জন্য আর জেলা অরগানাইজেশনে দুই বছরের জন্য আমির নির্বাচন করা হয়। কখনোই এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কোনো পরিস্থিতিই এটাকে স্টপ করায়নি। এটাই আমাদের গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই হিসেবে অক্টোবরেই আমরা নতুন আমির, নতুন সেটাপ শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথমেই আমির নির্বাচন করা হবে।’
আগামী জানুয়ারিতে নতুন আমির দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন মোবারাক হোসাইন। অন্যদিকে নতুন আমিরের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরেই ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধান নির্বাচন করতে গিয়ে দলটি কোনো রকম সমস্যায় পড়বে না বলে জানিয়েছেন জামায়াতের একাধিক নেতা। তাঁদের মতে, আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি জামায়াত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মেনে প্রায় নিঃশব্দে শেষ করে আনবে।
অক্টোবরে আমির নির্বাচনের প্রসঙ্গটি বিদেশি কূটনীতিকদেরও ইতিমধ্যে জানিয়েছে জামায়াত। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজারভেশন মিশনের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াত নেতারা। সেখানে দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে জামায়াতের আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলাপ ওঠে। বৈঠকে উপস্থিত দুজন নেতা স্ট্রিমকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গত জুলাইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় পড়ে যাওয়া, পড়ে গিয়েও না থেমে আবারও বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জামায়াতের প্রান্তিক সমর্থক-কর্মীদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। ডাকসুতে শিবিরের জয়ের পর এই জনপ্রিয়তা আরও একধাপ ওপরে উঠেছে। -অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের সবগুলো জেলার রুকন বা শপথধারী সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে আমির নির্বাচন করে থাকে জামায়াত। ফলে প্রক্রিয়াটি শেষ করে আনতে সময় লাগে। এ কারণে দলের ভেতর মাসাধিককাল নির্বাচনী কার্যক্রম চলতে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটি নিবিড়ভাবে সম্পন্ন করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন কমিশন।
জামায়াতের আমির নির্বাচনের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দলটির নির্বাচনী বিভাগ। এই বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথমে দলের মজলিসে শূরার সদস্যরা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তিন সদস্যের একটি প্যানেলকে নির্বাচিত করেন। পরে সেই তিন সদস্যের যেকোনো একজনকে সরাসরি ভোট দেন সারা দেশের রুকন সদস্যরা। যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান তিনিই পরবর্তী তিন বছরের জন্য আমির নির্বাচিত হন।
অর্থাৎ আমির নির্বাচনের আগে দুই ধাপে ভোট হবে। প্রথমবার ভোট দেবেন জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্যরা। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তাদের মাধ্যমে তিনজনকে আমির নির্বাচনের জন্য প্রাথমিকভাবে সামনে আনা হবে। মূলত এই তিনজনই দলীয়ভাবে আমির হওয়ার জন্য বিবেচ্য হবেন। চিঠি দিয়ে মজলিসে শূরার এই ‘প্রস্তাবনা’ রুকনদের জানানো হবে। সেখানে এ কথাও উল্লেখ থাকবে যে, যোগ্য বিবেচনায় কোনো রুকন চাইলে প্রস্তাবিত তিনজনের বাইরে অন্য কাউকে ভোট দিতে পারবেন। রুকনদের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তিকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমির হিসেবে শপথ পাঠ করাবেন।
বর্তমানে জামায়াতের মজলিসে শূরায় ৩২০ থেকে ৩২৫ জন সদস্য রয়েছেন। আর সারা দেশে রুকন রয়েছেন আরও ১ লাখের বেশি। প্রতি তিন মাস অন্তর এই সংখ্যার হালনাগাদ প্রতিবেদন পায় দলটি। এ তথ্য জানিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ২০২৬-২০২৮ মেয়াদের আমির নির্বাচন এই অক্টোবরেই অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনী কাজ শেষ করে আনতে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।
জামায়াত কীভাবে দলের আমির নির্বাচন করতে যাচ্ছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারাক হোসাইন স্ট্রিমকে জানান, অতীতে বৈরী পরিবেশেও মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমির নির্বাচন করা হয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। তিনি বলেন, ‘এটা একটা লং টাইম প্রসেস। এই প্রক্রিয়ায় এক-দেড় মাস সময় চলে যায়।’
২০২৬-২০২৮ মেয়াদের আমির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুমকে। স্ট্রিমের পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুধে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জামায়াতে আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন এর নির্বাহী পরিষদ সদস্যরা। জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আমির নির্বাচনের জন্য মজলিসে শূরা যে তিনজনের নাম রুকনদের সামনে প্রস্তাব করে সচরাচর তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্যই হয়ে থাকেন। জামায়াতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদই দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক ফোরাম।
কুড়ি জনের নির্বাহী পরিষদে রয়েছেন দলটির বর্তমান আমির ডা. মো. শফিকুর রহমান, তিনজন নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সাত জন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল—মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মুয়াযযম হোসাইন হেলাল, মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের দুই আমিরসহ আরও ৯ জন আছেন এই পরিষদে।
সম্ভাবনা রয়েছে এটিএম আজহারের: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে গত বছরের ৫ আগস্টের পরে খালাস পাওয়া এটিএম আজহারুল ইসলামও নির্বাহী পরিষদের সদস্য।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি ১৯ জন নেতাকে জামায়াত ২০২৩-২০২৫ মেয়াদে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে। সেখানে এটিএম আজহারের নাম ছিল না। তবে খালাস পাওয়ার পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ (মজলিসে আমেলা) ও মজলিসে শূরায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই তিনটি ফোরামই মূলত জামায়াতের প্রধান চালিকাশক্তি।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত এটিএম আজহার জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১২ সালে ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছরের ২৭ মে অভিযোগ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় উচ্চ আদালতে আপিলের ভিত্তিতে খালাস পান তিনি। এর আগে তাঁর মুক্তির জন্য জামায়াত রাজপথে একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেগুলোতে দলটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলে পদে দায়িত্ব সামলেছেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ২০০১-২০০৬ সময়কালে চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার স্থলাভিষিক্ত হওয়া দলে আজহারের গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কারাবন্দী থেকেও গত ১৩ বছর ধরে মজলিসের শূরার সদস্যদের গোপন ভোটে শূরার সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন এটিএম আজহার। যোগ্যতা ও দলের প্রতি ত্যাগের কারণে তাঁকে আমির বানানোর গুঞ্জন শুরু হয়েছিল কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই। সাংগঠনিক নিয়মের কারণে নির্বাচন ছাড়া আমির হওয়ার উপায় নেই জামায়াতে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই নেতাকে মুক্তি পাওয়ার পরেই মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলাদা কক্ষ দেওয়া হয়। সেখানে নিয়মিত বসছেন তিনি। অংশ নিচ্ছেন দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারের আমির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এই অধ্যাপক স্ট্রিমকে বলেন, জামায়াত যে প্রক্রিয়ায় আমির নির্বাচন করে তাতে আগে থেকে নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলা কঠিন। নির্বাচিত যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন নিঃসন্দেহে তাঁরা দলের পরীক্ষিত নেতা। দলীয় অবদান, অন্যান্য কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ, আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখেই হয়তো তারা তাদের আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচন করবে।
ডা. শফিকুর রহমানের তৃতীয়বারের সম্ভাবনা: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের গ্রেফতারের পরে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব যায় ডা. শফিকুর রহমানের হাতে। পরে ২০১৬ সালে ৩ বছরের জন্য তিনি সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রথমবার আমির নির্বাচিত হন ডা. শফিকুর রহমান। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই বছরের ২৭ অক্টোবর ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো তিনি আরও একবার আমির নির্বাচিত হন। এই অক্টোবরে আবারও আমির নির্বাচিত হলে এটি হবে তাঁর তৃতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণ।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বৈরী পরিস্থিতিতে দলকে ভেতর থেকে মজবুত রাখা, চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা পালন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে-বাইরে দলকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, পাঁচ আগস্টের পরে নোয়াখালীর বন্যায় ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা, জুলাইয়ে হতাহতদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শিবিরের নেতৃত্বাধীন প্যানেলগুলোর জয়ের পেছনে ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কয়েকজন রুকন স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, এসব কারণে বর্তমান আমিরের আবারও নির্বাচিত হওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ক্ষমতার অংশ হতে পারে বলেও মনে করেন তাঁরা।
তবে গত মার্চে ইফতার মাহফিলে এতিম শিশুদের চুমু দিয়ে বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান। এ বছর পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে আরেক দফা দলীয় কর্মীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে গিয়ে জামায়াতের অনেক নেতাকে এবার সশরীরে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গেছে। অনেকের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণেও ফেসবুকে তাঁর সমালোচনা হচ্ছে।
এসবের পরেও গত জুলাইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় পড়ে যাওয়া, পড়ে গিয়েও না থেমে আবারও বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জামায়াতের প্রান্তিক সমর্থক-কর্মীদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তবে ডাকসুতে শিবিরের জয়ের পর তাঁর এই জনপ্রিয়তা আরও একধাপ ওপরে উঠেছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইআইইআর) পরিচালক, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন। তাঁর মতে, ‘বর্তমান আমির জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল স্ট্রিমকে বলেন, ‘এটিএম আজহার দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে বর্তমান আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে এখনও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। এ কারণে আন্দোলনের সামনে তাঁকে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া নির্বাচনের আগে নতুন আমির হলে সংগঠন গোছাতে সময় লেগে যাবে। এ কারণেও বর্তমান আমিরেরই নেতৃত্বে থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির চর্চা করে আসা সংগঠন। এ কারণে আনুগত্য বেশি, নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক কম। ছোটখাটো বিতর্ক নীতিনির্ধারণে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে না।’
এর বাইরে জামায়াতের তিনজন নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নামও মজলিসে শূরার গোপন ভোটে নির্বাচিত হয়ে রুকনদের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতায় এটিএম আজহার ও বর্তমান আমিরই এগিয়ে আছেন বলে মনে করেন আইআইইআর-এর পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন। তাঁর মতে, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের জনপ্রিয়তা ও দক্ষতা থাকলেও বয়স ও পরহেজগারিতা বিবেচনায় বর্তমান আমির এগিয়ে আছেন, তাছাড়া ডা. তাহেরের হাতে আমির হওয়ার জন্য এখনও সময় আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে জামায়াতের নানারকম নীতিকৌশলে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আসন্ন আমির নির্বাচনে এর প্রভাবও পড়তে পারে। আমির যিনিই হোন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলের নেতৃত্ব বেছে নেওয়া জামায়াতের জন্য যে এই মুহূর্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাতে কারো সন্দেহ নেই।
জামায়াত আমির বলেন, ‘সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯০.৮ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বাকিরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। কিন্তু আমরা ধর্মের ভিত্তিতে জাতিকে বিভাজিত করার পক্ষে নই। আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি দেখতে চাই।’
৩ ঘণ্টা আগেইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গাজাগামী ত্রাণবাহী নৌযান আটকের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল এত দিন ধরে গণহত্যা চালাতে পারত না। মুসলিম উম্মাহসহ বিশ্ববাসীকে এই বর্বরতা বন্ধে সোচ্চার হতে হবে।’
৯ ঘণ্টা আগেচরমোনাই পীর বলেন, ‘স্বাধীনতার পর যারা দেশ শাসন করেছে তারা দেশকে বারবার দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নে পরিণত করেছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেগমপাড়া বানিয়েছে। দেশকে গুম-খুনের রাজ্যে পরিণত করেছে। এসব অনাচারের মূল কারণ আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানুষের বানানো আইন বাস্তবায়ন করা।’
৯ ঘণ্টা আগেত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। এ লক্ষ্যে শিগগিরই প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
৯ ঘণ্টা আগে