আজ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৬তম জন্মদিন
আজ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৬তম জন্মদিন। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মূলত তিনি একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করেন। সমাজে একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের আবহ তৈরি করতে চান।
কুদরত-ই-হুদা
বাংলাদেশে বড় মানুষদের কাছে খুব একটা যাওয়া হয়নি আমার। শিল্পসাহিত্য ও চিন্তাজগতের বড় মানুষদের কথা বলছি। দুই-চারজনের কিছুটা কাছে যাইনি তা না। দরকারি মনে করে যে গেছি ওটাই কাল হয়েছে। দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাধ মোটামুটি মিটে গেছে।
অধিকাংশ বড় মানুষ আমাকে টানতে পারেননি। বড় মানুষদের মধ্যে আমি যে উচ্চতা, সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা, ধীমানতা, সৃজনপ্রমত্ততা, পাণ্ডিত্য, প্রশ্রয়ক্ষমতা, উদারতা খুঁজি, তা অধিকাংশের মধ্যে দেখি না। লাভালাভের ঊর্ধ্বে উঠে চারপাশকে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতার কথা বাদই দিলাম। অধিকাংশের কাছে কোনো চিন্তাবৃত্তিক সমস্যা নিয়ে যাওয়ার ভরসা পাই না। মনে হয় আরও ভজঘট লাগবে। বড় মানুষদের একটা বড় অংশকে আমার দুঃখী মনে হয়। গরিব মনে হয়। ঐশ্বর্যটা চোখে পড়ে কম। প্রায়শই মনে হয় লোকটা নিজেই কী যেন চায়। কী যেন পাওয়ার ফিকিরে মশগুল আছেন। কাঙাল হৃদয় নিয়ে আরেক কাঙালের কাছে যাওয়ার কোনো মানে দেখি না। ইদানীং তাই আর বড় মানুষদের কাছে যাওয়া হয় না; আগ্রহ পাই না।
কিন্তু আজকাল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে যাই। খুব না হলেও মাঝেমধ্যে যাই। নিবিড়ভাবে দেখা-কথা হয়। আরও আগেও হতে পারত এ রকম অন্তরঙ্গ আলাপ-আড্ডা। কারণ, অনেক আগেই তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন মঞ্চে বক্তৃতা করতে গেছি। বিভিন্ন সাহিত্যিকমহলের দাওয়াত-টাওয়াতে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কথাবার্তাও হয়েছে। এক টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়াও করেছি। কিন্তু প্রত্যেকবার খেয়াল করেছি, তিনি আমাকে চেনেন না। চেনেন যে না সে বিষয়ে তিনি আমাকে নিশ্চিত হতে দেন না। দেখা হলে সালাম দিলেই একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘কী... ভালো?’ ভাববাচ্যে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘আর কথা নয়। যিনি আমাকে চিনতে চান না তাঁর সঙ্গে কীসের আলাপ!’
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আছি। দেখা হলে কথা বলতে যাই না আগের মতো। মনে মনে বলি দরকারটা কী! তাঁর বই তো আছেই তাঁকে জানার জন্য। এর মধ্যে তাঁর পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে চলমান ‘বাঙালির চিন্তা প্রকল্প’-এর ২১০ খণ্ডের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ‘বাঙালির শিক্ষাচিন্তা’ দশ খণ্ড ও ‘বাঙালির সমাজচিন্তা’ এগারো খণ্ড দেখে দিতে বললেন। কয়েক খণ্ড সম্পাদনাও করতে বললেন। দিলাম। স্যারের সম্ভবত পছন্দ হলো। মুগ্ধও হয়ে থাকতে পারেন। পরের দিন আবার কাজ নিয়ে বসলাম। কাজ শেষে বললাম, ‘স্যার! আসি।’ হাত মিলিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে।’
হঠাৎ মনে হলো, দুই দিন বসলাম, কথা হলো। দেখি তো আমার নামটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেছেন কি না! নাকি আগের মতোই আছেন। তো, সেদিন বের হওয়ার সময় বললাম, ‘স্যার! আমার নাম কী বলেন তো!’ স্যার অবাক হলেন। অপ্রস্তুত মুখভঙ্গি করে চুরাশি বছর বয়সের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হুদা’। ভাবলাম, ব্যাপার কী! আগে কেন এতবার বলার পরেও চিনতে পারতেন না! বুঝলাম, তাঁর কাছে সম্পর্কের বড় ভিত্তি কাজ। কাজের ভেতর দিয়েই তিনি সম্পর্কিত হন। যেখানে চারপাশে দেখি কাজের চেয়ে অকাজের সম্পর্ককেই অধিকাংশ লোক প্রধান মনে করে, সেখানে এটা একটু ব্যতিক্রম ঠেকল বটে।
এর কারণ কি এই যে তিনি একটা কর্মমুখর জীবনযাপন করেছেন! ছোট জীবনকে নিংড়ে ব্যবহার করেছেন বিচিত্র সব কাজের পেছনে! আমি ছিয়াশি বছর বয়সী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সামনে যখন আজকাল বসি, তখন তাঁর কোকড়ানো ঈষৎ বিস্রস্ত চুল, সামনের দিকে ঝোকপ্রবণ দীর্ঘ শরীর, হাতের বড় বড় সুঠাম আঙুল, অনুসন্ধানী চোখ, অসীমের দিকে ছুটে চলে যাওয়ার ঝোকপ্রবণ কথাবার্তার পেছনে দেখতে পাই রক্তিম ধুলোওড়া একটা দীর্ঘ ও প্রশস্ত রাস্তা। সেই রাস্তা রক্তিম কারণ দিনান্তের সূর্যের রক্তিম আভা জড়িয়ে আছে। আমি দেখি, লালাভ ধুলোর ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার অদূরে সারি সারি বাড়িঘর অট্টালিকা। শিশু-কিশোরদের কোলাহল। অসংখ্য বয়সী মানুষের অট্টহাসি। বইভর্তি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়ি এখানে-ওখানে ছড়ানো ছিটানো। আরও দেখি, চিলের মতো বিশ্রামী ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উড়ছে যেন ‘ভালোবাসার সাম্পান’, ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’, ‘সংগঠন ও বাঙালি’, ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’, ‘প্রাণ থেকে প্রাণে’, ‘বিস্রস্ত জার্নাল’সহ ৪০টি বই, ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা; আরও কত কী!
স্যারের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন প্রায়শই তিনি তাঁর তরুণ বয়সের নানা তৎপরতার কথা বলেন। কিছু করার জন্য দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটের বেড়ানোর প্রদীপ্ত বর্ণনা দেন। এখনো মূলত কাজই করেন। কখনো কখনো সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। কথাসর্বস্ব ব্যক্তিপূজক একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চরিত্রের কাছে গেলে লজ্জা লজ্জা লাগে। নিজের অপচয়ের প্রাসাদের জানালা-দরজা স্যারের কর্মমুখর জীবনের আলেখ্যের দমকা বাতাসে ঠাস ঠাস খুলে যায়। সব দেখা যায়। নিজের পাশাপাশি চারপাশের মানুষদেরও দেখি। হায়! শূন্যতা! বাংলাদেশের ‘মলিন বদন’ ভেতরে হাহাকার তোলে।
আমি জানি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে সারস্বত সমাজের অভিযোগও কম নয়। তিনি কেন আমাদের মতো রাজনীতির মাঠ গরম করেন না; কেন আমাদের মতো বুভুক্ষু হয়ে দ্বারে দ্বারে অন্নবস্ত্রের জন্য কাঙালের মতো হাত পেতে বেড়ান না; আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম করেন না কেন, একে ওঠাও, ওকে নামাও কেন করেন না; তিনি কেন ধ্যানীর নিমগ্নতায় নিজের ভুবনে নিজে পড়ে থাকেন!
কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তো আর পাঁচজনের মতো নয়। তিনি মূলত একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করেন। সমাজে একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের আবহ তৈরি করতে চান তিনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই জীবনটিই সচেতনভাবে বেছে নিয়েছেন জীবনের প্রায় শুরু থেকে। এবং অদ্যাবধি এই ছিয়াশি বছর বয়সেও এই জীবনের পক্ষে সক্রিয় আছেন।
বাঙালি একটি নৃতাত্ত্বিক বর্গ—এ কথা যেমন সত্য, তারচেয়েও বেশি সত্য এটি একটি সাংস্কৃতিক বর্গও। এই বর্গটির নির্মাণ ও বিকাশের ইতিহাস অন্তত তাই বলে। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক চর্চা-তৎপরতা দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ভালো-মন্দ বিচারের দিকে না গিয়ে বলা যায় যে এই চর্চা-তৎপরতা নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে উবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই পঠন-পাঠনমগ্ন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডভিত্তিক একটি জীবনযাপন করেন ও সেইমতো সমাজ বিনির্মাণের চেষ্টা করেন। এই সংস্কৃতির কতটুকু বাংলাদেশি আর কতটুকু কলকাতার বা ইউরোপের, তা সাংস্কৃতিক রাজনীতিকদের আলোচনার বিষয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নয়। তাঁর প্রধান কাজ লেখা, সংগঠন করা, একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করা,উদ্যাপন করা ও উদ্যাপনের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কী করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে করেছেন তা বোধ করি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কাজটি তিনি করেছেন একটি জীবনের সবটুকু ব্যয় করে। কী করেছেন তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। কিন্তু কীভাবে করেছেন, সেটা অনেকটা প্রায় আলোচনার ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অনুসরণীয় চরিত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন চরিত্র বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা পৃথিবীতেই কম থাকে।
আজ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছিয়াশিতম জন্মদিন। তিনি সুন্দরভাবে বৃদ্ধ হচ্ছেন। আরও সুন্দরভাবে দীর্ঘায়ু হোন। এই প্রজন্ম তাঁর কাছে গিয়ে লাভ করুক তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর প্রজ্ঞা ও মনীষা উদ্ভাসিত করুক বর্তমান প্রজন্মকে। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বর্তমান প্রজন্ম কথায় বড় না হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো কাজে বড় হোক।
লেখক: গবেষক; প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশে বড় মানুষদের কাছে খুব একটা যাওয়া হয়নি আমার। শিল্পসাহিত্য ও চিন্তাজগতের বড় মানুষদের কথা বলছি। দুই-চারজনের কিছুটা কাছে যাইনি তা না। দরকারি মনে করে যে গেছি ওটাই কাল হয়েছে। দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাধ মোটামুটি মিটে গেছে।
অধিকাংশ বড় মানুষ আমাকে টানতে পারেননি। বড় মানুষদের মধ্যে আমি যে উচ্চতা, সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা, ধীমানতা, সৃজনপ্রমত্ততা, পাণ্ডিত্য, প্রশ্রয়ক্ষমতা, উদারতা খুঁজি, তা অধিকাংশের মধ্যে দেখি না। লাভালাভের ঊর্ধ্বে উঠে চারপাশকে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতার কথা বাদই দিলাম। অধিকাংশের কাছে কোনো চিন্তাবৃত্তিক সমস্যা নিয়ে যাওয়ার ভরসা পাই না। মনে হয় আরও ভজঘট লাগবে। বড় মানুষদের একটা বড় অংশকে আমার দুঃখী মনে হয়। গরিব মনে হয়। ঐশ্বর্যটা চোখে পড়ে কম। প্রায়শই মনে হয় লোকটা নিজেই কী যেন চায়। কী যেন পাওয়ার ফিকিরে মশগুল আছেন। কাঙাল হৃদয় নিয়ে আরেক কাঙালের কাছে যাওয়ার কোনো মানে দেখি না। ইদানীং তাই আর বড় মানুষদের কাছে যাওয়া হয় না; আগ্রহ পাই না।
কিন্তু আজকাল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে যাই। খুব না হলেও মাঝেমধ্যে যাই। নিবিড়ভাবে দেখা-কথা হয়। আরও আগেও হতে পারত এ রকম অন্তরঙ্গ আলাপ-আড্ডা। কারণ, অনেক আগেই তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন মঞ্চে বক্তৃতা করতে গেছি। বিভিন্ন সাহিত্যিকমহলের দাওয়াত-টাওয়াতে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কথাবার্তাও হয়েছে। এক টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়াও করেছি। কিন্তু প্রত্যেকবার খেয়াল করেছি, তিনি আমাকে চেনেন না। চেনেন যে না সে বিষয়ে তিনি আমাকে নিশ্চিত হতে দেন না। দেখা হলে সালাম দিলেই একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘কী... ভালো?’ ভাববাচ্যে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘আর কথা নয়। যিনি আমাকে চিনতে চান না তাঁর সঙ্গে কীসের আলাপ!’
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আছি। দেখা হলে কথা বলতে যাই না আগের মতো। মনে মনে বলি দরকারটা কী! তাঁর বই তো আছেই তাঁকে জানার জন্য। এর মধ্যে তাঁর পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে চলমান ‘বাঙালির চিন্তা প্রকল্প’-এর ২১০ খণ্ডের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ‘বাঙালির শিক্ষাচিন্তা’ দশ খণ্ড ও ‘বাঙালির সমাজচিন্তা’ এগারো খণ্ড দেখে দিতে বললেন। কয়েক খণ্ড সম্পাদনাও করতে বললেন। দিলাম। স্যারের সম্ভবত পছন্দ হলো। মুগ্ধও হয়ে থাকতে পারেন। পরের দিন আবার কাজ নিয়ে বসলাম। কাজ শেষে বললাম, ‘স্যার! আসি।’ হাত মিলিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে।’
হঠাৎ মনে হলো, দুই দিন বসলাম, কথা হলো। দেখি তো আমার নামটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেছেন কি না! নাকি আগের মতোই আছেন। তো, সেদিন বের হওয়ার সময় বললাম, ‘স্যার! আমার নাম কী বলেন তো!’ স্যার অবাক হলেন। অপ্রস্তুত মুখভঙ্গি করে চুরাশি বছর বয়সের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হুদা’। ভাবলাম, ব্যাপার কী! আগে কেন এতবার বলার পরেও চিনতে পারতেন না! বুঝলাম, তাঁর কাছে সম্পর্কের বড় ভিত্তি কাজ। কাজের ভেতর দিয়েই তিনি সম্পর্কিত হন। যেখানে চারপাশে দেখি কাজের চেয়ে অকাজের সম্পর্ককেই অধিকাংশ লোক প্রধান মনে করে, সেখানে এটা একটু ব্যতিক্রম ঠেকল বটে।
এর কারণ কি এই যে তিনি একটা কর্মমুখর জীবনযাপন করেছেন! ছোট জীবনকে নিংড়ে ব্যবহার করেছেন বিচিত্র সব কাজের পেছনে! আমি ছিয়াশি বছর বয়সী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সামনে যখন আজকাল বসি, তখন তাঁর কোকড়ানো ঈষৎ বিস্রস্ত চুল, সামনের দিকে ঝোকপ্রবণ দীর্ঘ শরীর, হাতের বড় বড় সুঠাম আঙুল, অনুসন্ধানী চোখ, অসীমের দিকে ছুটে চলে যাওয়ার ঝোকপ্রবণ কথাবার্তার পেছনে দেখতে পাই রক্তিম ধুলোওড়া একটা দীর্ঘ ও প্রশস্ত রাস্তা। সেই রাস্তা রক্তিম কারণ দিনান্তের সূর্যের রক্তিম আভা জড়িয়ে আছে। আমি দেখি, লালাভ ধুলোর ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার অদূরে সারি সারি বাড়িঘর অট্টালিকা। শিশু-কিশোরদের কোলাহল। অসংখ্য বয়সী মানুষের অট্টহাসি। বইভর্তি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়ি এখানে-ওখানে ছড়ানো ছিটানো। আরও দেখি, চিলের মতো বিশ্রামী ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উড়ছে যেন ‘ভালোবাসার সাম্পান’, ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’, ‘সংগঠন ও বাঙালি’, ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’, ‘প্রাণ থেকে প্রাণে’, ‘বিস্রস্ত জার্নাল’সহ ৪০টি বই, ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা; আরও কত কী!
স্যারের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন প্রায়শই তিনি তাঁর তরুণ বয়সের নানা তৎপরতার কথা বলেন। কিছু করার জন্য দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটের বেড়ানোর প্রদীপ্ত বর্ণনা দেন। এখনো মূলত কাজই করেন। কখনো কখনো সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। কথাসর্বস্ব ব্যক্তিপূজক একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চরিত্রের কাছে গেলে লজ্জা লজ্জা লাগে। নিজের অপচয়ের প্রাসাদের জানালা-দরজা স্যারের কর্মমুখর জীবনের আলেখ্যের দমকা বাতাসে ঠাস ঠাস খুলে যায়। সব দেখা যায়। নিজের পাশাপাশি চারপাশের মানুষদেরও দেখি। হায়! শূন্যতা! বাংলাদেশের ‘মলিন বদন’ ভেতরে হাহাকার তোলে।
আমি জানি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে সারস্বত সমাজের অভিযোগও কম নয়। তিনি কেন আমাদের মতো রাজনীতির মাঠ গরম করেন না; কেন আমাদের মতো বুভুক্ষু হয়ে দ্বারে দ্বারে অন্নবস্ত্রের জন্য কাঙালের মতো হাত পেতে বেড়ান না; আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম করেন না কেন, একে ওঠাও, ওকে নামাও কেন করেন না; তিনি কেন ধ্যানীর নিমগ্নতায় নিজের ভুবনে নিজে পড়ে থাকেন!
কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তো আর পাঁচজনের মতো নয়। তিনি মূলত একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করেন। সমাজে একটি সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের আবহ তৈরি করতে চান তিনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই জীবনটিই সচেতনভাবে বেছে নিয়েছেন জীবনের প্রায় শুরু থেকে। এবং অদ্যাবধি এই ছিয়াশি বছর বয়সেও এই জীবনের পক্ষে সক্রিয় আছেন।
বাঙালি একটি নৃতাত্ত্বিক বর্গ—এ কথা যেমন সত্য, তারচেয়েও বেশি সত্য এটি একটি সাংস্কৃতিক বর্গও। এই বর্গটির নির্মাণ ও বিকাশের ইতিহাস অন্তত তাই বলে। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক চর্চা-তৎপরতা দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ভালো-মন্দ বিচারের দিকে না গিয়ে বলা যায় যে এই চর্চা-তৎপরতা নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে উবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই পঠন-পাঠনমগ্ন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডভিত্তিক একটি জীবনযাপন করেন ও সেইমতো সমাজ বিনির্মাণের চেষ্টা করেন। এই সংস্কৃতির কতটুকু বাংলাদেশি আর কতটুকু কলকাতার বা ইউরোপের, তা সাংস্কৃতিক রাজনীতিকদের আলোচনার বিষয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নয়। তাঁর প্রধান কাজ লেখা, সংগঠন করা, একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করা,উদ্যাপন করা ও উদ্যাপনের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কী করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে করেছেন তা বোধ করি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কাজটি তিনি করেছেন একটি জীবনের সবটুকু ব্যয় করে। কী করেছেন তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। কিন্তু কীভাবে করেছেন, সেটা অনেকটা প্রায় আলোচনার ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অনুসরণীয় চরিত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন চরিত্র বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা পৃথিবীতেই কম থাকে।
আজ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছিয়াশিতম জন্মদিন। তিনি সুন্দরভাবে বৃদ্ধ হচ্ছেন। আরও সুন্দরভাবে দীর্ঘায়ু হোন। এই প্রজন্ম তাঁর কাছে গিয়ে লাভ করুক তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর প্রজ্ঞা ও মনীষা উদ্ভাসিত করুক বর্তমান প্রজন্মকে। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বর্তমান প্রজন্ম কথায় বড় না হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো কাজে বড় হোক।
লেখক: গবেষক; প্রাবন্ধিক
আমার জ্ঞাতি ভাইবোনরা তাঁকে লাল কাকা বা মামা বলে ডাকত। তাঁর লাল ফেজ টুপির কারণেই সম্ভবত। নাকি তাঁর লালচে ত্বকের কারণে? এ ব্যাপারে আমি কখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
১ দিন আগেরাজপথে আন্দোলন থেকে শুরু করে বিমান বিধ্বস্তের মতো ঘটনায় ক্রমাগত আমাদের শিশু-কিশোরেরা ট্রমায় আক্রান্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তারাই হবে এ দেশের মূল নাগরিক অংশ। ব্যক্তিক ও জাতীয় প্রয়োজনেই এই শিশু-কিশোরদের ট্রমামুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২ দিন আগেএ ধরনের গণ-ট্র্যাজেডি, সামষ্টিক আবেগ থেকে যা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, তা কভার করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের এমন অবস্থান অবশ্য নতুন নয়। দুর্দশাকে উপজীব্য করে সস্তা সাহিত্য রচনার চল রয়েছে বহু আগে থেকেই। মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দেশের সংবাদমাধ্যমে সেই ঐতিহ্যই প্রবাহিত হয়েছে।
৩ দিন আগে২১ জুলাই সোমবার আমাদের জীবনে দুর্যোগ নেমে এল। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান হলো বিধ্বস্ত। বেলা একটার খানিক পরে অবতরণের আগমুহূর্তে স্কুলের হায়দার আলী ভবনের সামনে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ ফাইটার বিমানটি।
৩ দিন আগে