একসময় দেখা যেত কনটেন্টগুলো মূলধারার মিডিয়া থেকে যেত সোশ্যাল মিডিয়ায়, আর এখন ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মূলধারার গণমাধ্যমে আসছে ‘ভাইরাল কনটেন্ট’। আর এই ভাইরাল হওয়ার প্রবণতার ফলে মানুষ পুরো সংবাদ না পড়ে সংবাদ শিরোনাম বা ফটোকার্ড দেখে একটি বিষয় সম্পর্কে চটজলদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
খোরশেদ আলম
বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে ‘ফটোকার্ড সাংবাদিকতা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশনায় এটি এখন জনপ্রিয় ধারা। ফটোকার্ড সাংবাদিকতা মূলত অনেকটা ইনফোগ্রাফিকের মতো ভিজ্যুয়ালনির্ভর সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ছবি, গ্রাফিক বা ভিজ্যুয়াল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুক্ত করা হয়। এটি সংবাদের শিরোনাম, বিবরণী ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যমগুলো সাধারণত পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটোকার্ড আপলোড করে।
মুদ্রিত সংবাদপত্রে সংবাদ শিরোনাম বা সংবাদ-সূচনা যেভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তথা সোশ্যাল মিডিয়ার ফটোকার্ড অনেকটা সে কাজই করে। পাঠক যেমন পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম কিংবা সংবাদ-সূচনা দেখে সংবাদটি সম্পর্কে ধারণা পায়, ফটোকার্ড সাংবাদিকতার মৌলিক উদ্দেশ্যও তাই। ভারতীয় উপমহাদেশের শুরুর দিকের সংবাদপত্রে সংবাদ শিরোনাম বা সংবাদ-সূচনা বলতে কিছু ছিল না। ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘হিকির গেজেট’ থেকে শুরু করে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’ মতান্তরে ‘বেঙ্গল গেজেট’—পত্রিকাগুলোতে সংবাদ শিরোনামের অস্তিত্ব ছিল না। টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সংবাদ শিরোনাম ও সংবাদ-সূচনার প্রচলন ঘটে। যেকোনো সময় টেলিগ্রাফব্যবস্থা বিকল বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি সবার আগে জানিয়ে দেওয়ার তাগিদে ‘উল্টো পিরামিড’ কাঠামোয় সংবাদ সূচনার সূত্রপাত করে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো।
দুনিয়াজুড়ে ফটোকার্ড সাংবাদিকতার সূচনা ঘটে তথ্যবিপ্লবের ফলে। ডিজিটাল মিডিয়া ও স্মার্টফোননির্ভর জীবনব্যবস্থা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে এর বিস্তার মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে। সংবাদ পরিবেশন, উৎপাদন, প্রচার ও প্রচার-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া—এর সবই এখন নির্ভর করে ফেসবুকের ওপর।
বাংলাদেশে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১০ সালের পর থেকে। ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণকারী ওয়েবসাইট ডেটা রিপোর্টাল প্রদত্ত ‘গ্লোবাল ডিজিটাল স্ট্যাটশটের’ এক হিসেব অনুসারে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিচারে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান। বর্তমানে এ সংখ্যা যে আরও বহু গুণে বেড়েছে তা একপ্রকার নিশ্চিত। বাংলাদেশে স্মার্টফোন ও ফেসবুকের ব্যাপক প্রসারের প্রেক্ষাপটে পাঠকের মনোযোগ টেক্সটভিত্তিক সংবাদ থেকে ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের দিকে ঝুঁকেছে। এ বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমগুলো বুঝতে পেরেছে যে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বড় টেক্সট বা সংবাদবিবরণী নয়; বরং ইনফোগ্রাফের মাধ্যমে সংবাদ শিরোনামকে তুলে ধরা প্রয়োজন। গোড়ার দিকে কেবল কিছু অনলাইন পোর্টাল ফটোকার্ডের প্রয়োগ ঘটালেও পরবর্তীকালে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও সে পথে হাঁটতে থাকে।
ফেসবুকনির্ভর সাংবাদিকতায় পাঠক যেমন নিজেই কনটেন্ট তৈরি করে, আবার অন্যের কনটেন্ট উপভোগও করে। ফলে পাঠক-দর্শক একই সঙ্গে উৎপাদক বা ‘প্রডিউসার’, ভোক্তা বা ‘কনজিউমার’ হওয়ার পাশাপাশি হয়ে ওঠেন ‘প্রজিউমার’ও, যেখানে তিনি কাটছাঁট করে নিজের সুবিধামাফিক কন্টেন্ট তৈরি করে নিতে পারেন।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মূলত মোবাইল, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করে থাকে। তাঁরা আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে অভ্যস্ত; এবং এক্ষেত্রে স্টোরিটেলিং, শর্ট ফর্ম ভিডিও ও স্ক্রলনির্ভর কনটেন্ট দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো কোনো সময় ‘রাজনৈতিক পক্ষপাত’ বা ‘নির্লিপ্ত ভূমিকা’ নেওয়ার অভিযোগ করেন অনেকে। তাই বিকল্প সংবাদমাধ্যমের খোঁজে নাগরিকদের বেশির ভাগই এখন ফেসবুকের ওপর নির্ভর করে থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে ফেসবুক হয়ে উঠেছে এক ধরনের ডিজিটাল জনপরিসর, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ আর তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ পায়।
১৭–১৮ শতকে জার্মান দার্শনিক ইয়ুর্গেন হেবারমাস জনপরিসর বা ‘পাবলিক স্ফেয়ার’-এর ধারণা তুলে ধরেন, যেখানে মানুষ সেলুন, কফিশপ, চায়ের দোকান, পুকুরঘাট, ক্লাব বা মাঠে বসে রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে আলোচনা করত। তখন সেগুলো ছিল অফলাইন জনপরিসর। তবে এখনকার প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া—বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূলত ফেসবুক বিকল্প জনপরিসর তৈরি করে একটি ডিজিটাল জনপরিসর গড়ে তুলছে। আর ফটোকার্ড নির্ভর সংবাদ পরিবেশনা এই ডিজিটাল জনপরিসরে ‘পাবলিক ডিসকোর্স’ উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করছে।
বাংলাদেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সবগুলোরই এখন ডিজিটাল সংস্করণ রয়েছে। তারা ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলও পরিচালনা করছে। একসময় দেখা যেত মূলধারার গণমাধ্যম থেকে খবরগুলো যেত সোশ্যাল মিডিয়ায়। বর্তমানে ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মূলধারার গণমাধ্যমে আসছে ‘ভাইরাল কনটেন্ট’। আর এই ভাইরাল হওয়ার প্রবণতার ফলে মানুষ পুরো সংবাদ না পড়ে সংবাদ শিরোনাম বা ফটোকার্ড দেখে একটি বিষয় সম্পর্কে চটজলদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
আগেই বলেছি, ফটোকার্ডে অল্প কিছু শব্দে পুরো সংবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। ফলে খবরের বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট প্রায়শই হারিয়ে যায়। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হন পাঠক। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ফটোকার্ডকে চটকদার বানানোর চেষ্টা করেন কেউ কেউ।
ফটোকার্ডের কনটেন্ট হয় উচ্চমাত্রায় ভিজ্যুয়াল ও ইন্টারঅ্যাকটিভ, যাতে করে দর্শক-শ্রোতাকে তাঁদের ‘সংক্ষিপ্ত মনোযোগ সময়’-এর ভেতরেই আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। এতে তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতার তুলনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘কমেন্টে’ই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখন ফটোকার্ড তৈরি করে ক্লিকবেইট শিরোনাম দিয়ে কৃত্রিম সেনসেশন তৈরি করে তা ভাইরাল করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা বা জার্নালিজম পরিণত হচ্ছে ‘ভাইরালিজম’-এ। ফলে ফটোকার্ড সাংবাদিকতার নামে ছড়িয়ে পড়ছে বিভ্রান্তি ও ভুল তথ্য। আর এ প্রক্রিয়ায় যে মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফটোকার্ডনির্ভর সাংবাদিকতা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দ্রুত সংবাদ প্রচারের প্রতিযোগিতায় অনেক সময় যাচাই না করেই প্রকাশিত হচ্ছে কনটেন্ট। এ ধরনের সাংবাদিকতায় ঠিকভাবে ‘গেটকিপিং’ বা লাগাম টানাও সম্ভব হচ্ছে না। মূলধারার গণমাধ্যমে গেটকিপিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু তা যখন কেবল ‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’-এর জন্য ফটোকার্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করার উদ্দেশে ছড়ানো হয়, তখন তা সমাজে মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য এবং অপতথ্য ছড়ায়। এদিকে এ ব্যবস্থা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় মূলধারার সাংবাদমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থাও হ্রাস পাচ্ছে।
ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা হবে ডিজিটাল মিডিয়াকেন্দ্রিক। ফলে বাংলাদেশে প্রচলিত ও ডিজিটাল মাধ্যম মিলিয়ে একটি হাইব্রিড সাংবাদিকতা মডেল গড়ে উঠছে। বাংলাদেশে ডেটা জার্নালিজম, ইনফোগ্রাফিক্স, অ্যালগরিদম লিটারেসি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সংবাদ উৎপাদনের প্রবণতা বাড়ছে। সে প্রেক্ষাপটে ফটোকার্ড সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি নতুন ধারণা। এটি যেমন পাঠককে দ্রুত তথ্য দেয়, তেমনই বিভ্রান্তি ও অপতথ্যও ছড়ায়। ফটোকার্ড সাংবাদিকতাকে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের একটি ধরন হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তথ্য যাচাই, নৈতিক সাংবাদিকতার মানদণ্ড রক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: খোরশেদ আলম, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে ‘ফটোকার্ড সাংবাদিকতা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশনায় এটি এখন জনপ্রিয় ধারা। ফটোকার্ড সাংবাদিকতা মূলত অনেকটা ইনফোগ্রাফিকের মতো ভিজ্যুয়ালনির্ভর সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ছবি, গ্রাফিক বা ভিজ্যুয়াল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুক্ত করা হয়। এটি সংবাদের শিরোনাম, বিবরণী ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যমগুলো সাধারণত পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটোকার্ড আপলোড করে।
মুদ্রিত সংবাদপত্রে সংবাদ শিরোনাম বা সংবাদ-সূচনা যেভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তথা সোশ্যাল মিডিয়ার ফটোকার্ড অনেকটা সে কাজই করে। পাঠক যেমন পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম কিংবা সংবাদ-সূচনা দেখে সংবাদটি সম্পর্কে ধারণা পায়, ফটোকার্ড সাংবাদিকতার মৌলিক উদ্দেশ্যও তাই। ভারতীয় উপমহাদেশের শুরুর দিকের সংবাদপত্রে সংবাদ শিরোনাম বা সংবাদ-সূচনা বলতে কিছু ছিল না। ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘হিকির গেজেট’ থেকে শুরু করে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’ মতান্তরে ‘বেঙ্গল গেজেট’—পত্রিকাগুলোতে সংবাদ শিরোনামের অস্তিত্ব ছিল না। টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সংবাদ শিরোনাম ও সংবাদ-সূচনার প্রচলন ঘটে। যেকোনো সময় টেলিগ্রাফব্যবস্থা বিকল বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি সবার আগে জানিয়ে দেওয়ার তাগিদে ‘উল্টো পিরামিড’ কাঠামোয় সংবাদ সূচনার সূত্রপাত করে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো।
দুনিয়াজুড়ে ফটোকার্ড সাংবাদিকতার সূচনা ঘটে তথ্যবিপ্লবের ফলে। ডিজিটাল মিডিয়া ও স্মার্টফোননির্ভর জীবনব্যবস্থা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে এর বিস্তার মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে। সংবাদ পরিবেশন, উৎপাদন, প্রচার ও প্রচার-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া—এর সবই এখন নির্ভর করে ফেসবুকের ওপর।
বাংলাদেশে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১০ সালের পর থেকে। ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণকারী ওয়েবসাইট ডেটা রিপোর্টাল প্রদত্ত ‘গ্লোবাল ডিজিটাল স্ট্যাটশটের’ এক হিসেব অনুসারে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিচারে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান। বর্তমানে এ সংখ্যা যে আরও বহু গুণে বেড়েছে তা একপ্রকার নিশ্চিত। বাংলাদেশে স্মার্টফোন ও ফেসবুকের ব্যাপক প্রসারের প্রেক্ষাপটে পাঠকের মনোযোগ টেক্সটভিত্তিক সংবাদ থেকে ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের দিকে ঝুঁকেছে। এ বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমগুলো বুঝতে পেরেছে যে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বড় টেক্সট বা সংবাদবিবরণী নয়; বরং ইনফোগ্রাফের মাধ্যমে সংবাদ শিরোনামকে তুলে ধরা প্রয়োজন। গোড়ার দিকে কেবল কিছু অনলাইন পোর্টাল ফটোকার্ডের প্রয়োগ ঘটালেও পরবর্তীকালে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও সে পথে হাঁটতে থাকে।
ফেসবুকনির্ভর সাংবাদিকতায় পাঠক যেমন নিজেই কনটেন্ট তৈরি করে, আবার অন্যের কনটেন্ট উপভোগও করে। ফলে পাঠক-দর্শক একই সঙ্গে উৎপাদক বা ‘প্রডিউসার’, ভোক্তা বা ‘কনজিউমার’ হওয়ার পাশাপাশি হয়ে ওঠেন ‘প্রজিউমার’ও, যেখানে তিনি কাটছাঁট করে নিজের সুবিধামাফিক কন্টেন্ট তৈরি করে নিতে পারেন।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মূলত মোবাইল, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করে থাকে। তাঁরা আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে অভ্যস্ত; এবং এক্ষেত্রে স্টোরিটেলিং, শর্ট ফর্ম ভিডিও ও স্ক্রলনির্ভর কনটেন্ট দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো কোনো সময় ‘রাজনৈতিক পক্ষপাত’ বা ‘নির্লিপ্ত ভূমিকা’ নেওয়ার অভিযোগ করেন অনেকে। তাই বিকল্প সংবাদমাধ্যমের খোঁজে নাগরিকদের বেশির ভাগই এখন ফেসবুকের ওপর নির্ভর করে থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে ফেসবুক হয়ে উঠেছে এক ধরনের ডিজিটাল জনপরিসর, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ আর তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ পায়।
১৭–১৮ শতকে জার্মান দার্শনিক ইয়ুর্গেন হেবারমাস জনপরিসর বা ‘পাবলিক স্ফেয়ার’-এর ধারণা তুলে ধরেন, যেখানে মানুষ সেলুন, কফিশপ, চায়ের দোকান, পুকুরঘাট, ক্লাব বা মাঠে বসে রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে আলোচনা করত। তখন সেগুলো ছিল অফলাইন জনপরিসর। তবে এখনকার প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া—বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূলত ফেসবুক বিকল্প জনপরিসর তৈরি করে একটি ডিজিটাল জনপরিসর গড়ে তুলছে। আর ফটোকার্ড নির্ভর সংবাদ পরিবেশনা এই ডিজিটাল জনপরিসরে ‘পাবলিক ডিসকোর্স’ উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করছে।
বাংলাদেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সবগুলোরই এখন ডিজিটাল সংস্করণ রয়েছে। তারা ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলও পরিচালনা করছে। একসময় দেখা যেত মূলধারার গণমাধ্যম থেকে খবরগুলো যেত সোশ্যাল মিডিয়ায়। বর্তমানে ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মূলধারার গণমাধ্যমে আসছে ‘ভাইরাল কনটেন্ট’। আর এই ভাইরাল হওয়ার প্রবণতার ফলে মানুষ পুরো সংবাদ না পড়ে সংবাদ শিরোনাম বা ফটোকার্ড দেখে একটি বিষয় সম্পর্কে চটজলদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
আগেই বলেছি, ফটোকার্ডে অল্প কিছু শব্দে পুরো সংবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। ফলে খবরের বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট প্রায়শই হারিয়ে যায়। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হন পাঠক। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ফটোকার্ডকে চটকদার বানানোর চেষ্টা করেন কেউ কেউ।
ফটোকার্ডের কনটেন্ট হয় উচ্চমাত্রায় ভিজ্যুয়াল ও ইন্টারঅ্যাকটিভ, যাতে করে দর্শক-শ্রোতাকে তাঁদের ‘সংক্ষিপ্ত মনোযোগ সময়’-এর ভেতরেই আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। এতে তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতার তুলনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘কমেন্টে’ই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখন ফটোকার্ড তৈরি করে ক্লিকবেইট শিরোনাম দিয়ে কৃত্রিম সেনসেশন তৈরি করে তা ভাইরাল করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা বা জার্নালিজম পরিণত হচ্ছে ‘ভাইরালিজম’-এ। ফলে ফটোকার্ড সাংবাদিকতার নামে ছড়িয়ে পড়ছে বিভ্রান্তি ও ভুল তথ্য। আর এ প্রক্রিয়ায় যে মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফটোকার্ডনির্ভর সাংবাদিকতা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দ্রুত সংবাদ প্রচারের প্রতিযোগিতায় অনেক সময় যাচাই না করেই প্রকাশিত হচ্ছে কনটেন্ট। এ ধরনের সাংবাদিকতায় ঠিকভাবে ‘গেটকিপিং’ বা লাগাম টানাও সম্ভব হচ্ছে না। মূলধারার গণমাধ্যমে গেটকিপিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু তা যখন কেবল ‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’-এর জন্য ফটোকার্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করার উদ্দেশে ছড়ানো হয়, তখন তা সমাজে মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য এবং অপতথ্য ছড়ায়। এদিকে এ ব্যবস্থা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় মূলধারার সাংবাদমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থাও হ্রাস পাচ্ছে।
ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা হবে ডিজিটাল মিডিয়াকেন্দ্রিক। ফলে বাংলাদেশে প্রচলিত ও ডিজিটাল মাধ্যম মিলিয়ে একটি হাইব্রিড সাংবাদিকতা মডেল গড়ে উঠছে। বাংলাদেশে ডেটা জার্নালিজম, ইনফোগ্রাফিক্স, অ্যালগরিদম লিটারেসি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সংবাদ উৎপাদনের প্রবণতা বাড়ছে। সে প্রেক্ষাপটে ফটোকার্ড সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি নতুন ধারণা। এটি যেমন পাঠককে দ্রুত তথ্য দেয়, তেমনই বিভ্রান্তি ও অপতথ্যও ছড়ায়। ফটোকার্ড সাংবাদিকতাকে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের একটি ধরন হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তথ্য যাচাই, নৈতিক সাংবাদিকতার মানদণ্ড রক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: খোরশেদ আলম, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ প্লাস যারা পেয়েছে, তাদের স্ট্যাটাস আর যাঁরা পরীক্ষা দিয়েছেন বহু যুগ আগে, তাঁদেরও স্ট্যাটাস। এমনকি, যাদের পরীক্ষা দেয়ার বয়স হয়নি, তারাও লিখছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, জিপিএ-৫’। এই যে এক সম্মিলিত জুনুন বা গণ-উন্মাদনা—এর মনস্তত্ত্বটা কী?
১৩ ঘণ্টা আগেআমার এখনও মনে পড়ে, আমাদের স্কুলের মাঠে লুৎফর রহমান স্যার চিৎকার করে রোল নাম্বার ডাকছিলেন, সঙ্গে লেটার সংখ্যা আর রেজাল্ট বলছিলেন। গলায় কাতর স্বর তুলে আমার বেলায় স্যার বললেন, ‘আহা, ছেলেটা স্টার পায় নাই, ধর্মে লেটার…।’
১৬ ঘণ্টা আগেগত এক দশক ধরে সার্ক কার্যত অচল। ২০১৬ সালে ভারতের বয়কটের পর এ প্ল্যাটফর্ম থমকে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রগতির জন্য সার্কের পুনর্জাগরণ প্রয়োজন, যেখানে সংলাপ ও সহযোগিতাই হতে পারে একমাত্র পথ।
৩ দিন আগেসে সময় সিপিবির একাংশ শীতনিদ্রায় চলে গিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, পুলিশের তাড়া খেয়ে খোদ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ কর্মীরাও মুক্তি ভবনে ঢুকতে বাধার মুখোমুখী হন—এমন ঘটনাও তখন ঘটেছে।
৭ দিন আগে