leadT1ad

গবেষকদের বিশ্লেষণ

ভয়ংকর ভূমিক্ষয়ের মুখে বাংলাদেশ

সেফ অপারেটিং স্পেসের (এসওএস) সীমা অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। ফলে গত তিন দশক ধরে শীতকাল ছাড়াও বছরের বাকি সময়ে এখানকার নদীগুলোর পানিপ্রবাহ গেছে কমে। এ বাস্তবতায় যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সারওয়ার হোসেন তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে এ দেশের নদ-নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। সেখানে উঠে এসেছে ভয়ংকর এক সত্য।

সারওয়ার হোসেনগ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫২
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৪৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ নদী ও বন্যার দেশ হিসেবে পরিচিত। যদিও দেশটির পানির উৎসের প্রায় পুরোটাই দেশের বাইরে। এ দেশের মোট নদীর ৮০ শতাংশের উৎসমুখ প্রতিবেশী দেশগুলোতে। ফলে মিঠাপানির প্রাপ্যতার সংকট নিত্যদিনের ঘটনা। আর নগরায়ণ, কৃষি খাতের আধুনিকায়ন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এ সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সম্প্রতি আমি এবং আমার সহকর্মীরা মিলে বিশ্লেষণ করে দেখেছি, বাংলাদেশের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ১০টি বড় নদীর মধ্যে চারটি ‘সেফ অপারেটিং স্পেস’ (এসওএস) বা নিরাপদ কার্যপরিসরের শর্ত পূরণ করে না। মানে হলো—এই চার নদীর পানিপ্রবাহ পর্যাপ্ত নয়। ফলে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সামাজিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গঙ্গা বা পদ্মা, পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, গড়াই ও হালদা হলো এই চার নদী। ফলে এসব নদীকে কেন্দ্র করে মৎস্যজীবীসহ নদীনির্ভর অন্যান্য পেশার মানুষদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

আমাদের বিশ্লেষণ বলছে, বাকি ছয়টি নদীর পানিপ্রবাহও বিপজ্জনক স্তরের কাছাকাছি। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৃষ্ট বাঁধ, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং বাড়তে থাকা সেচনির্ভর কৃষি—এ বিপদের প্রধান কারণ।

এসওএস ধারণাটি ২০০৯ সালে উদ্ভাবন করেন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এটি এক ধরনের পরিমাপক, যার মাধ্যমে পৃথিবীর সার্বিক স্বাস্থ্য পরিমাপ করা হয়। এসওএস এমন এক বাস্তুতন্ত্র, যেখানে নয়টি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সীমারেখা নির্দেশ করা হয়। যেমন তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমা, প্রাকৃতিক পানি ব্যবহারের সীমা ও জীববৈচিত্র্যের উপাদানকে মানুষের কাজে ব্যবহারের নির্দিষ্ট সীমা ইত্যাদি। বলা ভালো, এই সীমারেখা অতিক্রম করলে মানবসভ্যতা ঝুঁকিতে পড়ে। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মানুষ এ নয়টি সীমার মধ্যে ছয়টি ইতিমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও ঘনবসতিপূর্ণ বদ্বীপ বাংলাদেশ। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাস এখানে। এই বদ্বীপে এসওএস ধারণা প্রয়োগ করে দেশটির নদীগুলোর স্বাস্থ্য পরিমাপ করে দেখতে চেয়েছি আমরা। গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে খাদ্য ও মাছের চাহিদাও। আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাদাবন সুন্দরবন তো আগে থেকেই হুমকির মুখে।

বাংলাদেশ বদ্বীপের কোনো নদীই এখন আর তার এসওএসের মধ্যে নেই। সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশ বদ্বীপের কোনো নদীই এখন আর তার এসওএসের মধ্যে নেই। সংগৃহীত ছবি

ফলাফল কী

আগেই বলা হয়েছে, সেফ অপারেটিং স্পেসের (এসওএস) সীমা অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। ফলে গত তিন দশক ধরে শীতকাল ছাড়াও বছরের বাকি সময়ে এখানকার নদীগুলোর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। আমাদের বিশ্লেষণ বলছে, ভারত ও বাংলাদেশে নদী নিয়ে যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে বা যে ধরনের সমাধানের কথা বলা হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। ফলে গঙ্গা বা পদ্মার যে জীববৈচিত্র্য, তাকে প্রয়োজনীয় আবাসন ও খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না নদীটি। যদিও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি চালু আছে।

২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মানুষ নয়টি সেফ অপারেটিং স্পেস বা এসওএস (পৃথিবীর সার্বিক স্বাস্থ্য পরিমাপক) সীমার মধ্যে ছয়টি ইতিমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে। এই সীমারেখা অতিক্রম করলে মানবসভ্যতা ঝুঁকিতে পড়ে।

সভ্যতার শুরু থেকে নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসওএস সীমা অতিক্রমের ফলে শুধু মানুষ নয়, বরং যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা অন্যান্য প্রজাতিও এখন ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখানে ইলিশ মাছের কথা বলা যায়। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পদ্মার ওপরের অংশে এই মাছ এখন আর দেখা যায় না। অথচ বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট মৎসসম্পদের ১২ শতাংশই ইলিশ।

এদিকে সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। এর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশ অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করছে। সংগত কারণেই বাংলাদেশে পদ্মার শাখা নদী গড়াইয়ে লবণাক্ততা বাড়ছে।

কোনো নদী যখন প্রকৃতিগতভাবেই বয়ে যায়, তখন সেখানে মিঠা ও নোনাপানির ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলে এখন বাড়ছে লবণাক্ততা। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলাফল এর সঙ্গে যোগ করছে বাড়তি মাত্রা। ফলে বাংলাদেশের মিঠাপানির মাছ, কৃষিপণ্য ও পদ্মার ডলফিন এখন হুমকির মুখে।

এ দেশের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ধ্বংসের মুখে পড়েছে সুন্দরবন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের বিশ্লেষণ বলছে, এই বন যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের জলবায়ু বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আর এর ফলে এখানে যে কার্বন জমে আছে, বাতাসে মিশে তা উষ্ণতা বাড়াবে। ত্বরান্বিত করবে হিমালয়ের বরফ গলার প্রক্রিয়া।

তীব্র গরমের সময় বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে প্রবাহ হারাচ্ছে প্রমত্তা গঙ্গা। লেখকের তোলা ছবি
তীব্র গরমের সময় বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে প্রবাহ হারাচ্ছে প্রমত্তা গঙ্গা। লেখকের তোলা ছবি

সমাধান কী

সমস্যার সমাধান খুব সহজ নয়। এজন্য প্রথমে যা প্রয়োজন, তা হলো আন্তসীমান্ত সমঝোতা। পাশাপাশি দরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ন্যায্য চুক্তির মাধ্যমে নদীগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। পুনরুদ্ধার করতে হবে নদীর প্রতিবেশ। এছাড়া নদীর প্রবাহ নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখতে হবে।

কিন্তু এই পদ্ধতি বাংলাদেশ বদ্বীপে খাটবে না। কারণ, এ দেশের নদীর পানিপ্রবাহ আসে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চীনসহ প্রতিবেশী দেশ থেকে । এসব দেশের রাজনৈতিক অবস্থান আন্তসীমান্ত আলোচনার জন্য সবসময় অনুকূল নয়। যদিও উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রায় ৭০ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও বিরোধ নিরসন সম্ভব।

এক্ষেত্রে সফল উদাহরণও আছে। কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মধ্যে মেকং নদী কমিশন একটি কার্যকর মডেল, যা গঙ্গার জন্য ভারত ও নেপাল এবং যমুনার জন্য চীন আর ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহু-পক্ষীয় চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।

তা ছাড়া করভিত্তিক পানিবণ্টন কৌশলও বিরোধ নিরসনে সহায়তা করতে পারে। এক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি পানি ব্যবহার করবে, সে তত বেশি কর দেবে। আর এই করের অর্থ বাকি অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে। বর্তমান অবকাঠামো বা ভবিষ্যতের পরিবর্তন বিবেচনায় না নিয়ে ঐতিহাসিক নদীপ্রবাহের ভিত্তিতে পানিবন্টন চুক্তি হতে পারে।

বন উজাড় বন্ধ করা, জমির ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনা এবং জলাভূমি পুনরুদ্ধার—তিনটি উপায় বন্যা ও খরার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। আর এভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে বাংলাদেশের পানির নিরাপত্তা। সবশেষে যে আসল কথাটি বলার তা হলো, বাংলাদেশের নদীগুলোর নিরাপদ কার্যপরিসর রক্ষার মাধ্যমেই সমাজের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

দ্য কনভারসেশন অবলম্বনে বাংলায় অনূদিত।

Ad 300x250

সম্পর্কিত