leadT1ad

হুমায়ূন আহমেদ কি আসলেই সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে আত্মজৈবনিক রচনাগুলো লিখেছেন

হুমায়ূন শফিক
হুমায়ূন শফিক
ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ২৭
সম্প্রতি গুলতেকিন খান তাঁর সাবেক স্বামী হুমায়ূন আহমেদের লেখায় মিথ্যাচারের অভিযোগ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি গুলতেকিন খান তাঁর সাবেক স্বামী ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ‘মিথ্যাচার’-এর অভিযোগ করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে করা ওই পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের বসবাসের সময়কার একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন তিনি। হুমায়ূন তখন নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন। পোস্টে গুলতেকিন অভিযোগ করেন, এক শীতের রাতে হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেন।

এ নিয়ে এরই মধ্যে নেটিজেনদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। হুমায়ূন-ভক্তরা এই পোস্ট পড়ে হতাশ হয়েছেন। ক্ষুব্ধ অনেকে উল্টো গুলতেকিন খানকেই দোষারোপ করেছেন। এখন কথা হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ কি আসলেই সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে আত্মজৈবনিক রচনাগুলো লিখেছিলেন?

মনোবিজ্ঞানী ও লেখক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষের স্মৃতি সবসময় পুনর্গঠনমূলক বা রিকনস্ট্রাকটিভ। অর্থাৎ আমরা যেভাবে ঘটনা মনে রাখি, তা অনেক সময় বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মেলে না; অবচেতন ইচ্ছা, ভয় বা আকাঙ্ক্ষা সেই স্মৃতিকে পরিবর্তন করে।

মার্ক টোয়েন তাঁর আত্মজীবনীতে অনেক জায়গায় ঘটনাকে হাস্যরসাত্মক ও নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে বাস্তবতার সাথে রঙিন কল্পনার মিশ্রণ আছে।

আরেক মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ লফটাস দেখিয়েছেন যে মানুষের স্মৃতি সহজেই পরিবর্তনযোগ্য। অনেক সময় মানুষ সত্য-মিথ্যার মিশ্রণকেই ‘নিজস্ব সত্য’ মনে করে। তাই আত্মজীবনীতে লেখক যে ঘটনা বর্ণনা করেন, তা আংশিক বাস্তব, আংশিক কল্পনা।

অনেকের মতে, আত্মজীবনী কেবল তথ্যভিত্তিক ইতিহাস নয়; এটি এক ধরনের সাহিত্য। এজন্য অনেক লেখক কাহিনিকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কল্পনার সংযোজন করেন।

যেমন, জেমস জয়েস নিজের অভিজ্ঞতাকে ‘আ পোর্টেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ আ ইয়াং ম্যান’ বইয়ে সরাসরি কোনোকিছু না বলে শিল্পিত ও রূপক আকারে উপস্থাপন করেছেন।

মার্ক টোয়েন তাঁর আত্মজীবনীতে অনেক জায়গায় ঘটনাকে হাস্যরসাত্মক ও নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে বাস্তবতার সাথে রঙিন কল্পনার মিশ্রণ আছে।

সাহিত্যতত্ত্ববিদ ফিলিপ লেজঁন তাঁর ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফিক্যাল প্যাক্ট’ বইয়ে লিখেছেন, আত্মজীবনী সবসময় সত্য দাবি করলেও পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য সেখানে কল্পনা ও নির্বাচিত সত্যের সংমিশ্রণ ঘটে।

মার্ক টোয়েনের এই প্রবণতার সঙ্গে প্রায় মিলে যায় হুমায়ূনের লেখা। হুমায়ূনের লেখায় এমনিতেই হিউমারের উপস্থিতি প্রবল। তাঁর পাঠকমাত্রই জানেন, তাঁর বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই কোনো না কোনো হাসির উপাদান থাকবেই। কেউ যদি চায় হুমায়ূন পাঠ করবেন, কিন্তু হাসবেন না, তা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর লেখার একটা স্টাইলই হচ্ছে হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আত্মজীবনীতে লেখক প্রায়ই নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার চেষ্টা করেন। ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, বিতর্কিত কাজ বা অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়। ফরাসি লেখক জ্যঁ জাক রুশো তাঁর ‘কনফেশনস’-এ দাবি করেছিলেন যে তিনি নির্মল সত্য প্রকাশ করছেন। কিন্তু গবেষকেরা দেখিয়েছেন, রুশো বেশ কিছু জায়গায় নিজেকে নৈতিকভাবে নির্দোষ প্রমাণ করতে ঘটনাকে বিকৃত করেছেন। মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স তাঁর ‘সেল্ফ-কনসেপ্ট’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন, মানুষ সর্বদা নিজের একটি ইতিবাচক চিত্র রক্ষা করতে চায়। ফলে আত্মজীবনীতে মিথ্যা প্রায়শই আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে।

হোটেল গ্রেভার ইন বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ভূমিকা। ছবি: সংগৃহীত
হোটেল গ্রেভার ইন বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ভূমিকা। ছবি: সংগৃহীত

যদিও হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকার কথা না, তবে তাঁর পরিবারের লোকজন নিশ্চয় এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তাঁদের কথা সত্য বলে ধরে নিলে, হুমায়ূনের আত্মজীবনীর প্রায় ৬০ শতাংশই মিথ্যা হিসেবে অবিহিত হবে। তাঁর প্রথম স্ত্রী এর আগেও ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বলেছিলেন, হুমায়ূন চাইতেন না, তিনি পড়ালেখা ঠিক মতো করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়েছেন গুলতেকিন। গুলতেকিনের অভিযোগ করেন, ওই সময়ে হুমায়ূন তাঁকে নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গুলতেকিনের অদম্য ইচ্ছের কাছে পরাজিত হয়েছেন হুমায়ূন।

এক্ষেত্রে অনেক লেখক বিশ্বাস করেন যে আত্মজীবনীতে ‘মনস্তাত্ত্বিক সত্য’ প্রকাশ করা বাস্তব তথ্যের চেয়ে বেশি জরুরি।

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর লেখায় ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাগুলোকে প্রায়ই পুনর্গঠন করেছেন। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তিগত অনুভূতি ও চেতনার প্রবাহই প্রকৃত সত্য।

সাহিত্যতত্ত্ববিদ ফিলিপ লেজঁন তাঁর ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফিক্যাল প্যাক্ট’ বইয়ে লিখেছেন, আত্মজীবনী সবসময় সত্য দাবি করলেও পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য সেখানে কল্পনা ও নির্বাচিত সত্যের সংমিশ্রণ ঘটে।

সাহিত্যতত্ত্ববিদ ফিলিপ লেজঁন তাঁর ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফিক্যাল প্যাক্ট’ বইয়ে লিখেছেন, আত্মজীবনী সবসময় সত্য দাবি করলেও পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য সেখানে কল্পনা ও নির্বাচিত সত্যের সংমিশ্রণ ঘটে।

হুমায়ূন আহমেদও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর ফিকশনগুলো এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে মানুষ ওই লেখা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকত। অনেকের ধারণা, এই জনপ্রিয়তার কারণেও তিনি তাঁর আত্মজীবনীগুলোতে একই ধরনের কল্পনার আশ্রয় নিতেন। যেমন একবার তিনি ঠিক করলেন, মনে মনে সবাইকে সালাম দেবেন। টিএসসি বা যেকোনো জায়গায় হাঁটার সময়ে সামনে যাঁকে পেতেন তাঁকেই সালাম দিতেন মনে মনে। একদিন এক পাগল-গোছের লোককেও তিনি সেভাবে সালাম দিলেন। লোকটি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার তাঁর কাছে ফেরত আসলেন এবং তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ওয়ালাইকুমুস সালাম।

আবার একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখলেন তারই মতো একজন তাঁর সামনে বসে আছেন।

এইরকম উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। যেগুলো আসলে গল্প বা উপন্যাসেই সম্ভব। কিন্তু বাস্তবেই নাকি এই সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা, তা হয়তো লেখক নিজেই জানেন।

লেখক: সাংবাদিক; কথাসাহিত্যিক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত