আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে যদি প্রশ্ন করা যায়, বাংলাদেশে একজন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন কত? বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া আইটি খাতের একজন তরুণ পেশাজীবীর বেতনই প্রায়ই এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রভাষকের চেয়ে বেশি! এই চিত্র কি আমাদের সেই লাট সাহেবের কুকুরের তিন ঠ্যাং আর পণ্ডিতের গল্পকে মনে করায়?
সৈকত আমীন
অনেক দিন আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল বাংলা ক্লাসের এক পণ্ডিত শিক্ষককে নিয়ে। গল্পের নাম ‘পাদটীকা’।
ওই গল্পের শেষ পর্যায়ে পণ্ডিত শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করান এক তিক্ত বাস্তবতার। গল্পে দেখা যায়, লাটসাহেবের একটি কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় পঁচাত্তর টাকা। কিন্তু সেই কুকুরটির তিনটি মাত্র ঠ্যাং। একটি ঠ্যাং ট্রেনে কাটা পড়েছে। হিসাব করলে বোঝা যায়, কুকুরটির একেকটি ঠ্যাংয়ের পেছনে মাসে খরচ হয় পঁচিশ টাকা। আর ওই পণ্ডিতমশাই, যিনি পুরো পরিবার—বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী—সব মিলিয়ে আটজন মানুষ নিয়ে সংসার চালান, তাঁর মাসিক বেতনও মাত্র পঁচিশ টাকা। অর্থাৎ এক ইংরেজ শাসকের কুকুরের একটি ঠ্যাংয়ের সমান খরচ দিয়ে একজন শিক্ষককে চালাতে হতো একটি বৃহৎ পরিবারকে।
এই তুলনাটা নিছক বিদ্রূপ নয়; এটি ইতিহাসের এক নগ্ন সত্য। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশায় তেমন পারিশ্রমিক ছিল না। শিক্ষকের সম্মান নামমাত্র থাকলেও তাঁদের জীবনধারণের মতো ছিল না যথেষ্ট আয়। সেই উপনিবেশের আছর ছেড়ে দুই-দুইবার রাষ্ট্র গঠন করেছি আমরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতারও পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়। যদি ভেবে দেখি এবং প্রশ্ন করি, আমাদের শিক্ষকেরা কি এখনো সেই ব্রিটিশ আমলের লজ্জাজনক বাস্তবতা পার হয়ে আসতে পেরেছেন, তাহলে নিজেকেও দাঁড় করাতে হয় মুজতবা আলীর গল্পের সেই শ্রেণিকক্ষে, একজন বিব্রত ছাত্র হিসেবে।
আজকের বাংলাদেশে একজন স্কুলশিক্ষকের বেতন কত? সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আলাপে পরে আসছি। দেশের বিশাল অংশের শিক্ষক তো বেসরকারি স্কুল-কলেজে চাকরি করেন। তাঁদের প্রারম্ভিক বেতন প্রায়ই ১৫–২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আবার অনেকে ৫–৬ হাজার টাকায়ও কাজ করেন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। অথচ দেশের প্রধান শহরগুলোতে একেকটা পরিবারের গড় মাসিক ব্যয় এখন ন্যূনতম ৩০–৪০ হাজার টাকা।
কর্পোরেট খাতে একজন নতুন কর্মকর্তা সহজেই ৩০–৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। অন্যদিকে শিক্ষক—যিনি সমাজের মেরুদণ্ড, যিনি প্রাথমিক শিক্ষার বীজ বপন করেন—জীবনযুদ্ধে তাঁকে টিকে থাকতে হয় অতি সামান্য আয়ের ওপর ভর করে।
পুঁজিবাজারের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, সমাজে যাঁরা সবচেয়ে বেশি পয়সা মাইনে পান, সম্মানটাও তাঁদের একটু বেশিই। তবে আমাদের দেশে এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশে সাধারণত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত সব মানুষকে আমরা সম্মানিত হতেই দেখি। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি বা বিশ্ববিদ্যালয়—সব বিদ্যায়তনের শিক্ষকের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। এদেশে চায়ের দোকানদার থেকে চালের দোকানি—কেউই শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানাতে ভুল করেন না। আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখনো দেখা যায় এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। ধরুন, কোনো শিক্ষার্থী সাইকেল চালিয়ে নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। দূর থেকে পথে যদি শিক্ষক-স্থানীয় কাউকে দেখা যায়, তবে ওই শিক্ষার্থী সাধারণত সাইকেল থেকে নেমে যান। এরপর শিক্ষকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত হাত দিয়েই ঠেলে ঠেলে সাইকেল নিয়ে এগোন। শেষে শিক্ষককে কুর্নিশ জানিয়ে,কুশল বিনিময়ের পর বিনীতভাবে নেন বিদায়। শিক্ষককে অতিক্রম করার পরেই কেবল শিক্ষার্থী তাঁর সাইকেলটি চালান। রাত-দিন—যা-ই হোক, ঘটনা মোটামুটি একই থাকে।
তবে এটা কেবল মুদ্রার একটা পিঠ। চায়ের দোকানদার থেকে চালের দোকানি শিক্ষকদের যে মর্যাদা দেয়, সেই মর্যাদা দেয় না রাষ্ট্রের শিক্ষার দোকানদারেরা। আর সরকারে বসে যাঁরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালান, তাঁরাও কি শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেন?
শিক্ষক সমাজের বড় অংশ রাষ্ট্রের কাছে এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য সম্মান বা সম্মানী পান না। বোধ করি সে কারণেই সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ শিক্ষকদের একটু বেশি সম্মান দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে চান। কিন্তু বিজ্ঞান ও গার্হস্থবিজ্ঞান বড়ই নিষ্ঠুর। সম্মানের উষ্ণতায় যেহেতু চুলার আগুন জ্বলে না।
একটু আগে মুদ্রার একটা পিঠের কথা বলছিলাম। এবার আরেকটা পিঠের কথাও বলি। গত এক যুগে এদেশের মানুষ অনেকবার শিক্ষকদের দিনের পর দিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে। কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাসের পর মাস জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে শুয়ে থেকেছেন। লাগাতার অনশনও করেছেন। রোদে, বৃষ্টিতে, শীতে সামান্য কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে মুখগুলো কেবল মলিনই হতে দেখেছি আমরা। শুধু প্রাথমিকের শিক্ষকই নন, ইবতেদায়ী, এমনকি কারিগরি শিক্ষকদেরও দেখা গেছে একই অবস্থায়—কখনো বিদ্যাপীঠ জাতীয়করণের দাবিতে, কখনো বা তাঁদের ছিল স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত হওয়ার দাবি। বলা যায়, যে দাবিই হোক, এসব দাবি শেষপর্যন্ত রুটি-রুজির। সামান্য বেতন-ভাতা বাড়ানো আর পেনশনের কিঞ্চিৎ নিরাপত্তার জন্য।
কিন্তু সত্য হলো, গত এক যুগে শিক্ষকদের এসব দাবি যতটা পূরণ হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে তাঁদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লাঠিচার্জ। সেটি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলেও যেমন, একই রকম ঘটনা ঘটেছে অভ্যুত্থান পরবর্তী এই আমলেও। যেন শিক্ষক পেটানোর বেলায় পিছপা হতে রাজি না কেউই!
এখানে কেবল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার কথা বললে মনে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে হয় খুব ভালো আছেন। এতক্ষণ যে নিরন্ন-বিপন্ন শিক্ষকদের কথা বলা হলো, তাঁদের তুলনায় কিঞ্চিৎ ভালো তাঁরা আলবৎ আছেন। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ থাকার চেয়ে কিঞ্চিৎ ভালো থাকাকে আদৌ ‘ভালো থাকা’ বলা যায় কি না, তা-ও তো এক দার্শনিক বিড়ম্বনাই বটে।
পরিসংখ্যান বলছে, বাস্তব পরিস্থিতি বেশ কঠিন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন প্রভাষকের (নবম গ্রেড) মূল বেতন মাত্র ৩৫, হাজার পাঁচ শ টাকা। বিভিন্ন ভাতা-ভোগ্য সংযোজনের পর তাঁর হাতে পাওয়া মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজারে।
একজন সহকারী অধ্যাপক (অষ্টম গ্রেড) মাসে বেতন পান আনুমানিক ৫০ থেকে থেকে ৭০ হাজার টাকা। আর সহকারী অধ্যাপক (৬ষ্ঠ গ্রেড) পেতে পারেন ৮০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। এখন চোখ ফেরানো যাক অধ্যাপকের বেতনে। সাধারণত একজন অধ্যাপক (চতুর্থ গ্রেড) সাধারণত মোট বেতনসহ মাসে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা বেতন পান; কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র অ্যালাউন্স যোগ হলে তা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছায়।
এই অঙ্কগুলো অন্য খাতের সঙ্গে তুলনা করলে কী মনে হয়? স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৈষম্য। যেখানে ঢাকার কোনো বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাঝারি স্তরের একজন ব্যবস্থাপক সহজেই মাসে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা আয় করেন, সেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর এই হাল।
অবাক করার বিষয় হলো, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া আইটি খাতের একজন তরুণ পেশাজীবীর বেতনই প্রায়ই এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রভাষকের চেয়ে বেশি!
আর এই বিশাল ব্যবধানই ব্যাখ্যা করে দেয়, কেন এখন অনেক মেধাবী স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর শিক্ষকতা পেশায় আসতে অনাগ্রহী হন; এবং কেন বিদেশে পিএইচডি সম্পন্ন করা অনেক বাংলাদেশি গবেষক দেশে ফিরে আসতে চান না।
এক্ষণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সম্পর্কে জানা যাক। আমাদের দেশের শিক্ষকেরা আসলে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে বন্দি। সমাজে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বাগধারা প্রচুর। ‘জাতির মেরুদণ্ড’, ‘আলোকবর্তিকা’—এসব বিশেষণ আমরা নিয়মিত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁদের প্রতি যে রাষ্ট্রীয় অবমূল্যায়ন, তা একেবারে ঔপনিবেশিক যুগের সেই লাটসাহেবের কুকুরের ঠ্যাংয়ের গল্পই কি মনে করাই না?
বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেল এখনো ২০১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেলের ওপর ভিত্তি করে চলছে, যা ২০২৫ সালে কেবল আংশিকভাবে আপডেট হয়েছে। এই আপডেটের মধ্যেও বাড়ানো হয়নি মূল বেতন। শুধু ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ বা মূল্যস্ফীতি ভাতা সামান্য সমন্বয় করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকেরা গ্রেড–১৪ থেকে ১৩-তে এসেছেন বটে, তবে তাতেই বা কী হয়েছে। এই কিছুদিন আগেও তাঁদের মূল বেতন ছিল মাত্র ১০ হাজার ২ শ থেকে ২৪ হাজার ৬৮০ টাকা। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে প্রধান শিক্ষকেরা সম্প্রতি গ্রেড–১০-এ উন্নীত হয়েছেন। বলা ভালো, এই শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় ২২ হাজার টাকায়। আবার মাধ্যমিক স্তরে সহকারী শিক্ষকদের বেতন এখন শুরু হয় ৩২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে।
সব মিলিয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ে একজন শিক্ষকের মাসিক মূল বেতন গড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৭৫ থেকে ৩৬ হাজার ২৯২ টাকায়। নানান ভাতা যোগ হবার পর তা সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায় পৌঁছায়।
একই যোগ্যতায় অন্য সরকারি চাকরির সঙ্গে যদি শিক্ষকদের বেতনের তুলনা করা যায়, তবে কী দাঁড়ায়? বৈষম্যই প্রকট হয় শুধু। বিসিএস ক্যাডারের নবম গ্রেডের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, যা প্রাথমিকের শিক্ষকদের চেয়ে অন্তত ১০ হাজার টাকা বেশি।
গড়ে একজন শিক্ষক প্রতিমাসে পান ১৭ হাজার টাকা (প্রায় ১৭০ মার্কিন ডলার), যা দেশের গড় মাসিক পার ক্যাপিটাল আয়ের (২৩২ ডলার) চেয়ে ৬২ ডলার কম।
২০০৬ সালে জার্নাল অব এশিয়ান ইকনমিকসে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছিল নিদারুণ এক তথ্য, বাংলাদেশের শিক্ষকেরা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষকদের তুলনায় গড়ে ২০–৩০ শতাংশ কম বেতন পান। তাই তাঁদের অনেকেই সংসার চালাতে গিয়ে দ্বিতীয় কাজ—টিউশনি বা ছোটখাটো ব্যবসা—করতে বাধ্য হন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে। ২০০৬ সাল মানে তো অনেক আগের কথা। তখন যে শিশু জন্মেছিল, তার বয়স এখন ১৯ বছর। কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-বাস্তবতার এখনো তেমন হেরফের ঘটেনি।
‘শিশুদের যাঁরা শিক্ষা দেন, তাঁদের সম্মান পিতামাতার চেয়েও বেশি হওয়া উচিত। কারণ, পিতামাতা শুধু জীবন দিয়েছেন, আর শিক্ষকরা দিয়েছেন সুন্দরভাবে বাঁচার কৌশল।’ অ্যারিস্তাতলের এই কথা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা নয়, সভ্যতার বিবর্তনের মর্মকথাও এটি। শিক্ষক মানে শুধু জ্ঞানদাতা নন, তিনি সমাজের বোধ, নীতি, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার ধারক। তাই শিক্ষকদের সম্মান করা কোনো দয়ার কাজ নয়; রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। আমাদের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের জন্য একক ও সমজাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করবে।’ কিন্তু সেই শিক্ষানীতির মূল বাহক হলেন শিক্ষক। তিনি যদি উপেক্ষিত হন, তবে রাষ্ট্রের নিজস্ব শিক্ষা-দর্শনই ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়, তারা টেকসই উন্নয়ন তো দূরের কথা, নৈতিক দিক থেকেও ধ্বংসের মুখে পড়ে। প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকদের প্রতি সম্মান ছিল রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ। তাই তারা সভ্যতার দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু পাঠদানের জায়গা নয়, সামাজিক মূল্যবোধের পরীক্ষাগার। কিন্তু যখন সেই ল্যাবরেটরির ‘কেমিস্ট’ নিজেই হতাশ, নিঃস্ব, ও মানসিকভাবে বিপন্ন, তখন সেখানে কেবল টিকে থাকে যান্ত্রিক শিক্ষা, মানবিকতা নয়।
আমরা যদি সত্যিই শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি চাই, তবে আমাদের অবশ্যই শিক্ষকদের দিকে তাকাতে হবে। এখানে প্রশ্ন শুধু বেতনের নয়, মর্যাদারও। আমরা কি আরেকবারও সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই ‘পাদটীকা’ গল্পের ক্লাসরুমে ফিরে যেতে চাই, যেখানে এক শিক্ষকের জীবন লাটসাহেবের কুকুরের ঠ্যাংয়ের সমান দামে দাঁড়িয়ে থাকে?
লেখক: সাংবাদিক
অনেক দিন আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল বাংলা ক্লাসের এক পণ্ডিত শিক্ষককে নিয়ে। গল্পের নাম ‘পাদটীকা’।
ওই গল্পের শেষ পর্যায়ে পণ্ডিত শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করান এক তিক্ত বাস্তবতার। গল্পে দেখা যায়, লাটসাহেবের একটি কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় পঁচাত্তর টাকা। কিন্তু সেই কুকুরটির তিনটি মাত্র ঠ্যাং। একটি ঠ্যাং ট্রেনে কাটা পড়েছে। হিসাব করলে বোঝা যায়, কুকুরটির একেকটি ঠ্যাংয়ের পেছনে মাসে খরচ হয় পঁচিশ টাকা। আর ওই পণ্ডিতমশাই, যিনি পুরো পরিবার—বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী—সব মিলিয়ে আটজন মানুষ নিয়ে সংসার চালান, তাঁর মাসিক বেতনও মাত্র পঁচিশ টাকা। অর্থাৎ এক ইংরেজ শাসকের কুকুরের একটি ঠ্যাংয়ের সমান খরচ দিয়ে একজন শিক্ষককে চালাতে হতো একটি বৃহৎ পরিবারকে।
এই তুলনাটা নিছক বিদ্রূপ নয়; এটি ইতিহাসের এক নগ্ন সত্য। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশায় তেমন পারিশ্রমিক ছিল না। শিক্ষকের সম্মান নামমাত্র থাকলেও তাঁদের জীবনধারণের মতো ছিল না যথেষ্ট আয়। সেই উপনিবেশের আছর ছেড়ে দুই-দুইবার রাষ্ট্র গঠন করেছি আমরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতারও পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়। যদি ভেবে দেখি এবং প্রশ্ন করি, আমাদের শিক্ষকেরা কি এখনো সেই ব্রিটিশ আমলের লজ্জাজনক বাস্তবতা পার হয়ে আসতে পেরেছেন, তাহলে নিজেকেও দাঁড় করাতে হয় মুজতবা আলীর গল্পের সেই শ্রেণিকক্ষে, একজন বিব্রত ছাত্র হিসেবে।
আজকের বাংলাদেশে একজন স্কুলশিক্ষকের বেতন কত? সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আলাপে পরে আসছি। দেশের বিশাল অংশের শিক্ষক তো বেসরকারি স্কুল-কলেজে চাকরি করেন। তাঁদের প্রারম্ভিক বেতন প্রায়ই ১৫–২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আবার অনেকে ৫–৬ হাজার টাকায়ও কাজ করেন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। অথচ দেশের প্রধান শহরগুলোতে একেকটা পরিবারের গড় মাসিক ব্যয় এখন ন্যূনতম ৩০–৪০ হাজার টাকা।
কর্পোরেট খাতে একজন নতুন কর্মকর্তা সহজেই ৩০–৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। অন্যদিকে শিক্ষক—যিনি সমাজের মেরুদণ্ড, যিনি প্রাথমিক শিক্ষার বীজ বপন করেন—জীবনযুদ্ধে তাঁকে টিকে থাকতে হয় অতি সামান্য আয়ের ওপর ভর করে।
পুঁজিবাজারের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, সমাজে যাঁরা সবচেয়ে বেশি পয়সা মাইনে পান, সম্মানটাও তাঁদের একটু বেশিই। তবে আমাদের দেশে এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশে সাধারণত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত সব মানুষকে আমরা সম্মানিত হতেই দেখি। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি বা বিশ্ববিদ্যালয়—সব বিদ্যায়তনের শিক্ষকের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। এদেশে চায়ের দোকানদার থেকে চালের দোকানি—কেউই শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানাতে ভুল করেন না। আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখনো দেখা যায় এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। ধরুন, কোনো শিক্ষার্থী সাইকেল চালিয়ে নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। দূর থেকে পথে যদি শিক্ষক-স্থানীয় কাউকে দেখা যায়, তবে ওই শিক্ষার্থী সাধারণত সাইকেল থেকে নেমে যান। এরপর শিক্ষকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত হাত দিয়েই ঠেলে ঠেলে সাইকেল নিয়ে এগোন। শেষে শিক্ষককে কুর্নিশ জানিয়ে,কুশল বিনিময়ের পর বিনীতভাবে নেন বিদায়। শিক্ষককে অতিক্রম করার পরেই কেবল শিক্ষার্থী তাঁর সাইকেলটি চালান। রাত-দিন—যা-ই হোক, ঘটনা মোটামুটি একই থাকে।
তবে এটা কেবল মুদ্রার একটা পিঠ। চায়ের দোকানদার থেকে চালের দোকানি শিক্ষকদের যে মর্যাদা দেয়, সেই মর্যাদা দেয় না রাষ্ট্রের শিক্ষার দোকানদারেরা। আর সরকারে বসে যাঁরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালান, তাঁরাও কি শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেন?
শিক্ষক সমাজের বড় অংশ রাষ্ট্রের কাছে এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য সম্মান বা সম্মানী পান না। বোধ করি সে কারণেই সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ শিক্ষকদের একটু বেশি সম্মান দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে চান। কিন্তু বিজ্ঞান ও গার্হস্থবিজ্ঞান বড়ই নিষ্ঠুর। সম্মানের উষ্ণতায় যেহেতু চুলার আগুন জ্বলে না।
একটু আগে মুদ্রার একটা পিঠের কথা বলছিলাম। এবার আরেকটা পিঠের কথাও বলি। গত এক যুগে এদেশের মানুষ অনেকবার শিক্ষকদের দিনের পর দিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে। কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাসের পর মাস জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে শুয়ে থেকেছেন। লাগাতার অনশনও করেছেন। রোদে, বৃষ্টিতে, শীতে সামান্য কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে মুখগুলো কেবল মলিনই হতে দেখেছি আমরা। শুধু প্রাথমিকের শিক্ষকই নন, ইবতেদায়ী, এমনকি কারিগরি শিক্ষকদেরও দেখা গেছে একই অবস্থায়—কখনো বিদ্যাপীঠ জাতীয়করণের দাবিতে, কখনো বা তাঁদের ছিল স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত হওয়ার দাবি। বলা যায়, যে দাবিই হোক, এসব দাবি শেষপর্যন্ত রুটি-রুজির। সামান্য বেতন-ভাতা বাড়ানো আর পেনশনের কিঞ্চিৎ নিরাপত্তার জন্য।
কিন্তু সত্য হলো, গত এক যুগে শিক্ষকদের এসব দাবি যতটা পূরণ হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে তাঁদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লাঠিচার্জ। সেটি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলেও যেমন, একই রকম ঘটনা ঘটেছে অভ্যুত্থান পরবর্তী এই আমলেও। যেন শিক্ষক পেটানোর বেলায় পিছপা হতে রাজি না কেউই!
এখানে কেবল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার কথা বললে মনে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে হয় খুব ভালো আছেন। এতক্ষণ যে নিরন্ন-বিপন্ন শিক্ষকদের কথা বলা হলো, তাঁদের তুলনায় কিঞ্চিৎ ভালো তাঁরা আলবৎ আছেন। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ থাকার চেয়ে কিঞ্চিৎ ভালো থাকাকে আদৌ ‘ভালো থাকা’ বলা যায় কি না, তা-ও তো এক দার্শনিক বিড়ম্বনাই বটে।
পরিসংখ্যান বলছে, বাস্তব পরিস্থিতি বেশ কঠিন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন প্রভাষকের (নবম গ্রেড) মূল বেতন মাত্র ৩৫, হাজার পাঁচ শ টাকা। বিভিন্ন ভাতা-ভোগ্য সংযোজনের পর তাঁর হাতে পাওয়া মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজারে।
একজন সহকারী অধ্যাপক (অষ্টম গ্রেড) মাসে বেতন পান আনুমানিক ৫০ থেকে থেকে ৭০ হাজার টাকা। আর সহকারী অধ্যাপক (৬ষ্ঠ গ্রেড) পেতে পারেন ৮০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। এখন চোখ ফেরানো যাক অধ্যাপকের বেতনে। সাধারণত একজন অধ্যাপক (চতুর্থ গ্রেড) সাধারণত মোট বেতনসহ মাসে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা বেতন পান; কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র অ্যালাউন্স যোগ হলে তা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছায়।
এই অঙ্কগুলো অন্য খাতের সঙ্গে তুলনা করলে কী মনে হয়? স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৈষম্য। যেখানে ঢাকার কোনো বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাঝারি স্তরের একজন ব্যবস্থাপক সহজেই মাসে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা আয় করেন, সেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর এই হাল।
অবাক করার বিষয় হলো, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া আইটি খাতের একজন তরুণ পেশাজীবীর বেতনই প্রায়ই এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রভাষকের চেয়ে বেশি!
আর এই বিশাল ব্যবধানই ব্যাখ্যা করে দেয়, কেন এখন অনেক মেধাবী স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর শিক্ষকতা পেশায় আসতে অনাগ্রহী হন; এবং কেন বিদেশে পিএইচডি সম্পন্ন করা অনেক বাংলাদেশি গবেষক দেশে ফিরে আসতে চান না।
এক্ষণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সম্পর্কে জানা যাক। আমাদের দেশের শিক্ষকেরা আসলে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে বন্দি। সমাজে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বাগধারা প্রচুর। ‘জাতির মেরুদণ্ড’, ‘আলোকবর্তিকা’—এসব বিশেষণ আমরা নিয়মিত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁদের প্রতি যে রাষ্ট্রীয় অবমূল্যায়ন, তা একেবারে ঔপনিবেশিক যুগের সেই লাটসাহেবের কুকুরের ঠ্যাংয়ের গল্পই কি মনে করাই না?
বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেল এখনো ২০১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেলের ওপর ভিত্তি করে চলছে, যা ২০২৫ সালে কেবল আংশিকভাবে আপডেট হয়েছে। এই আপডেটের মধ্যেও বাড়ানো হয়নি মূল বেতন। শুধু ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ বা মূল্যস্ফীতি ভাতা সামান্য সমন্বয় করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকেরা গ্রেড–১৪ থেকে ১৩-তে এসেছেন বটে, তবে তাতেই বা কী হয়েছে। এই কিছুদিন আগেও তাঁদের মূল বেতন ছিল মাত্র ১০ হাজার ২ শ থেকে ২৪ হাজার ৬৮০ টাকা। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে প্রধান শিক্ষকেরা সম্প্রতি গ্রেড–১০-এ উন্নীত হয়েছেন। বলা ভালো, এই শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় ২২ হাজার টাকায়। আবার মাধ্যমিক স্তরে সহকারী শিক্ষকদের বেতন এখন শুরু হয় ৩২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে।
সব মিলিয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ে একজন শিক্ষকের মাসিক মূল বেতন গড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৭৫ থেকে ৩৬ হাজার ২৯২ টাকায়। নানান ভাতা যোগ হবার পর তা সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায় পৌঁছায়।
একই যোগ্যতায় অন্য সরকারি চাকরির সঙ্গে যদি শিক্ষকদের বেতনের তুলনা করা যায়, তবে কী দাঁড়ায়? বৈষম্যই প্রকট হয় শুধু। বিসিএস ক্যাডারের নবম গ্রেডের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, যা প্রাথমিকের শিক্ষকদের চেয়ে অন্তত ১০ হাজার টাকা বেশি।
গড়ে একজন শিক্ষক প্রতিমাসে পান ১৭ হাজার টাকা (প্রায় ১৭০ মার্কিন ডলার), যা দেশের গড় মাসিক পার ক্যাপিটাল আয়ের (২৩২ ডলার) চেয়ে ৬২ ডলার কম।
২০০৬ সালে জার্নাল অব এশিয়ান ইকনমিকসে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছিল নিদারুণ এক তথ্য, বাংলাদেশের শিক্ষকেরা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষকদের তুলনায় গড়ে ২০–৩০ শতাংশ কম বেতন পান। তাই তাঁদের অনেকেই সংসার চালাতে গিয়ে দ্বিতীয় কাজ—টিউশনি বা ছোটখাটো ব্যবসা—করতে বাধ্য হন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে। ২০০৬ সাল মানে তো অনেক আগের কথা। তখন যে শিশু জন্মেছিল, তার বয়স এখন ১৯ বছর। কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-বাস্তবতার এখনো তেমন হেরফের ঘটেনি।
‘শিশুদের যাঁরা শিক্ষা দেন, তাঁদের সম্মান পিতামাতার চেয়েও বেশি হওয়া উচিত। কারণ, পিতামাতা শুধু জীবন দিয়েছেন, আর শিক্ষকরা দিয়েছেন সুন্দরভাবে বাঁচার কৌশল।’ অ্যারিস্তাতলের এই কথা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা নয়, সভ্যতার বিবর্তনের মর্মকথাও এটি। শিক্ষক মানে শুধু জ্ঞানদাতা নন, তিনি সমাজের বোধ, নীতি, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার ধারক। তাই শিক্ষকদের সম্মান করা কোনো দয়ার কাজ নয়; রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। আমাদের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের জন্য একক ও সমজাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করবে।’ কিন্তু সেই শিক্ষানীতির মূল বাহক হলেন শিক্ষক। তিনি যদি উপেক্ষিত হন, তবে রাষ্ট্রের নিজস্ব শিক্ষা-দর্শনই ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়, তারা টেকসই উন্নয়ন তো দূরের কথা, নৈতিক দিক থেকেও ধ্বংসের মুখে পড়ে। প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকদের প্রতি সম্মান ছিল রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ। তাই তারা সভ্যতার দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু পাঠদানের জায়গা নয়, সামাজিক মূল্যবোধের পরীক্ষাগার। কিন্তু যখন সেই ল্যাবরেটরির ‘কেমিস্ট’ নিজেই হতাশ, নিঃস্ব, ও মানসিকভাবে বিপন্ন, তখন সেখানে কেবল টিকে থাকে যান্ত্রিক শিক্ষা, মানবিকতা নয়।
আমরা যদি সত্যিই শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি চাই, তবে আমাদের অবশ্যই শিক্ষকদের দিকে তাকাতে হবে। এখানে প্রশ্ন শুধু বেতনের নয়, মর্যাদারও। আমরা কি আরেকবারও সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই ‘পাদটীকা’ গল্পের ক্লাসরুমে ফিরে যেতে চাই, যেখানে এক শিক্ষকের জীবন লাটসাহেবের কুকুরের ঠ্যাংয়ের সমান দামে দাঁড়িয়ে থাকে?
লেখক: সাংবাদিক
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কিন্তু কেন?
৩ ঘণ্টা আগেউত্তর প্রজন্মের নারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান প্রায় চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের একটি গার্হস্থ্য নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে দারুণ হইচই।
৫ ঘণ্টা আগেইতিহাসের পুনর্লিখন যখন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে ঘটতে শুরু করে, তখন তা কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও বন্দি করে ফেলে। তাই ভারত এক সংকটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন মূল প্রশ্ন, দেশ কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতির পথে চলবে, নাকি আরএসএসকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরি করবে?
৫ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্রকে পণ্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। এই পণ্যায়ন শাসনব্যবস্থাকে ঠেলে দিয়েছে তোষামোদী নেটওয়ার্কের হাতে। এর ফলে ভেঙে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও মানুষের বিশ্বাস। বাংলাদেশে রাজনৈতিক তোষামোদ নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্রের সম্পদ, পদায়ন ও চুক্তি সবই যাবে অনুগতদের হাতে।
৬ ঘণ্টা আগে