leadT1ad

খসড়া জুলাই সনদের কোথাও নেই ‘আদিবাসী’ বা অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কথা

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১: ৩৯
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১: ৪৪
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি। ছবি: সংগৃহীত

২৭ পৃষ্ঠার ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়ায় একবারও ‘আদিবাসী’ বা অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কথা আসেনি। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সনদটি প্রণীত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি বা স্বীকৃতি এই দলিলে স্থান পায়নি।

কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করে আসছে। তাদের মূল দাবি, সংবিধানে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ভূমি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

গত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে আবারও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু জুলাই সনদে এই দাবির বিষয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি।

খসড়া জুলাই সনদের ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশকে একটি বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, “বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হইবে।’”

৯ আগস্টের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সংস্কার কার্যক্রমে আদিবাসীদের কোনো কার্যকর সংলাপ বা অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। আদিবাসীরা এখনো অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি হামলার শিকার হন আদিবাসী শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি অপসারণের প্রতিবাদে সেদিন ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’-এর ব্যানারে রাস্তায় নেমেছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেদিনের হামলায় আহত হন অন্তত ১০ জন। ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামের একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে এ হামলার অভিযোগ ওঠে।

উল্লেখ্য, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলার সময়েও ছাত্রলীগের (সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত) হামলারও শিকার হন রুপাইয়া।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবিগুলোর অন্যতম হলো ভূমির অধিকারের সুরক্ষা। এবারের আদিবাসী দিবসের অন্যতম দাবি ছিল, আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন। কিন্তু জুলাই সনদে এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাবনা বা আলোচনার উল্লেখ নেই।

একইভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও সনদে কোনো উল্লেখ নেই। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও একটি বড় রাজনৈতিক দাবি।

সন্তু লারমার লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হয়েছিল, তা ২৮ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি রাষ্ট্র। পাহাড়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নতুন নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। সমতলের পরিস্থিতি আরও নাজুক। ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নারী নিপীড়ন, বৈষম্য, বিচারহীনতা এসবের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক থেকে আরও প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছেন আদিবাসীরা।’

ভাষাগত অধিকারের ক্ষেত্রে সনদের ৪ নম্বর পৃষ্ঠার ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে “বাংলা”। সংবিধানে বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য সব ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’ তবে আদিবাসী ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা কতটা নিশ্চিত করা হবে, তা স্পষ্ট নয়।

আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ স্ট্রিমকে বলেন, যে সনদে আদিবাসীদের কথা থাকবে না, সে সনদ তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন।

অলিক জানান, জুলাই সনদের খসড়া প্রণয়নের সময় আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যদি জুলাই সনদে আদিবাসীদের কথা না থাকে, সে জায়গা থেকে আমরা আদিবাসীরা আন্দোলন করতে বাধ্য হব।’

অলিক জানান, সরকারি পর্যায়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা চলছে। যদি জুলাই সনদে আদিবাসীদের কথা না থাকে, তবে তাঁরা আন্দোলনে নামবেন।

এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে অলিক বলেন, ‘যেহেতু আমার জাতিসত্তার ব্যাপার-স্যাপার বা আমার আইডেন্টিটির ব্যাপার, সেই জায়গাতে আমি কাউকে ছাড় দেব না।’

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সাতটি দাবি উত্থাপন করে—

১. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি।

২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা।

৩. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন।

৪. আদিবাসীদের সম্পর্কে বিকৃত বা মিথ্যা তথ্য প্রচারকারী গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ।

৫. আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন–নির্যাতন বন্ধ ও সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।

৬. জাতিসংঘের ‘আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্র’ (২০০৭) ও আইএলও ১৬৯ কনভেনশন অনুসমর্থন এবং আইএলও ১০৭ বাস্তবায়ন।

৭. রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপন।

এর কোনোটির উল্লেখই জুলাই সনদের খসড়ায় নেই। সনদের ৪ নম্বর পৃষ্ঠায় ২ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকদের পরিচয় ‘বাঙালি’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। এটি জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে একটি সমন্বিত জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। তবে আদিবাসীদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলোর বিষয়ে সনদের খসড়ায় কোনো উল্লেখ নেই।

গত শনিবার (১৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত