বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়। সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হয় বলে এই অঞ্চল ক্রমেই খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। কিন্তু শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতের অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। এতে মাটির বাড়ি ধসে পড়েছে, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
রোববার সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার দরগাপাড়া গ্রামে নিজের জমির পাশে দাঁড়িয়ে কৃষক জহিরুল ইসলাম (৩৫) বলেন, ‘মাঠের ৮০ ভাগ ধান শুয়ে পড়েছে। এই ধান তোলার লোকও পাওয়া যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে তুলতে হবে। আমরা এবার এখানেই ধান মাড়াই করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এত বর্ষণ জীবনে দেখিনি। ধানখেতের ভেতর দিয়েই পানির স্রোত বইছে। সব জমির ধান শুয়ে গেছে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।’
সরেজমিনে গোদাগাড়ী ও তানোরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠ সাধারণত উঁচুনিচু সিঁড়ির মতো—দুই দিক উঁচু, মাঝখান নিচু। স্থানীয়ভাবে এই নিচু অংশকে বলা হয় ‘কান্দর’। এবার সেই কান্দরগুলোই বিলের মতো তলিয়ে গেছে। এসব জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছিল। সাধারণত বিলের ধান ডুবলেও কান্দর ডোবে না; কিন্তু শুক্রবার রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সবই।
শুক্রবার রাতে রাজশাহী শহরে তেমন বৃষ্টি হয়নি। তবে বিভিন্ন উপজেলায় গ্রামের বিল ও খাড়ি পানিতে ভরে গেছে। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শুনছি গ্রামের দিকে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। শহরে যেখানে আমাদের অফিস, সেখানে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছি।’
বিলের মধ্যে খনন করা পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেনএদিকে মাঠে মাঠে বিল ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দল বেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেন। শনিবার থেকেই চলছে মাছ ধরার মহোৎসব। রোববারও বিভিন্ন এলাকায় বিল ও খাড়িতে মানুষকে মাছ ধরতে দেখা গেছে।
পবা উপজেলার শুলিতলা ভিমারডাইং এলাকার জোয়াখালি নদীতে অর্ধশতাধিক মানুষ মাছ ধরছিলেন। আলোকছত্র গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান (৬৫) বলেন, ‘জাল ফেললেই বড় বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আমি জীবনে এবার দ্বিতীয়বার উত্তরা পেলি দেখছি। সাধারণত এই নদীর স্রোত উত্তর দিকে যায়। কিন্তু এবার উত্তরে এত বৃষ্টি হয়েছে যে পানি দক্ষিণে যাচ্ছে। একেই বলে উত্তরা পেলি।’
বিলের মধ্যে খনন করা পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুরে মাছচাষ করতেন মারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে, ক্ষতি কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকার।
রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয়রা সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুপাশে শত শত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। খালের পাশে ১০-১২টি বাড়ির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে। মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেন জানান, তাঁর বাড়ির দুটি ঘর ধসে পড়েছে।
মাঠ, বিল ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দল বেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেনরিশিকুল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম (৫৫) বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বৃষ্টির পর এমন বন্যা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর আর এমন হয়নি। এতদিন পর এবার প্রথম।’
পাকড়ি ও রিশিকুল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে যাওয়ায় বসতবাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ। স্বেচ্ছাসেবীরা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ি বাড়ি দিচ্ছেন। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোরের সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকায় মাঠের পর মাঠ ধান শুয়ে পড়েছে।
কালীগঞ্জের কৃষক সাবিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার ১২ বিঘা জমির ধান শেষ। আধাপাকা ধান ঘরে তুলতেও লোক পাওয়া যাবে না।’
এবার মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় আলু ও শীতকালীন সবজি চাষে বিলম্ব হবে। পার্শ্ববর্তী মোহনপুর ও বাগমারায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় পানবরজও ক্ষতিগ্রস্ত। শনিবার বাগমারার বাসুপাড়ায় পানচাষি নুর মোহম্মাদ (৬০) মারা গেছেন। স্থানীয়দের ধারণা, বরজে পানি ঢুকে যাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘৫০০ হেক্টর ধানের ক্ষতির প্রতিবেদন আমরা দিচ্ছি। শুয়ে পড়লেই কিন্তু ক্ষতি হয় না। মাঠে যাচ্ছি, দেখছি।’
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কয়েকটি উপজেলা থেকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়েছি। মাছ বেরিয়ে গেছে। এটি অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’