leadT1ad

ঢাকায় প্রবেশে বাবুবাজার ব্রিজ যেন ‘পুলসিরাত’

আবদুল্লাহ কাফি
বাবুবাজার ব্রিজের ওপর যানজট। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথগুলোর মধ্যে অন্যতম বাবুবাজার সেতু। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ যাতায়াতে অনেকেই বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি ব্যবহার করেন। এ কারণে সারাক্ষণই গাড়ির চাপ থাকে এই সেতুতে। তবে, আইন ভেঙে সেতুর ওপর বাস স্টপেজ, দোকানপাট বসানো, উল্টোপথে যান চলাচলসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলায় এখানে দিন-রাত বেশিরভাগ সময়ই থাকে দীর্ঘ যানজট। চলাচলকারীদের ভাষ্য, সেতু পার হওয়া রীতিমত যুদ্ধ জয়ের সামিল।

স্থানীয়রা জানান, বাবুবাজার সেতুর একপাশে রয়েছে জনাকীর্ণ পুরান ঢাকা আর অন্যপাশে ব্যস্ততম শিল্প এলাকা কেরানীগঞ্জ। গত কয়েক দশকে কেরানীগঞ্জে গড়ে উঠেছে ডক ইয়ার্ড, পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানা। ফলে এই এলাকায় ২৪ ঘণ্টাই থাকে মানুষের যাতায়াত। এ ছাড়া পদ্মাসেতু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনের একটি অংশ এই সেতু দিয়ে রাজধানীতে ঢুকে। একদিকে গাড়ির চাপ বৃদ্ধি, অন্যদিকে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় সৃষ্ট যানজটের কারণে এই সেতু দিয়ে এখন যাতায়াত করাই দুরূহ। অনেক সময় গন্তব্যে যেতে যে সময় লাগে তার থেকে বেশি সময় লাগে শুধু সেতু পার হতেই।

এই সেতু হয়ে কর্মক্ষেত্র রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিয়মিত যাতায়াত করেন আবু তালহা। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি বাইকে (মোটরসাইকেল) যাতায়াত করি। বাবুবাজার সেতু পার হওয়ার পর পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড বা গুলিস্তান হয়ে কারওয়ান বাজার পৌঁছতে যতটুকু সময় লাগে, অনেক সময় সেতুর উপর তার চেয়ে বেশি সময় আটকে থাকতে হয়। সেতু পার হতে পারাই বিরাট পরীক্ষা। বাবু বাজার ব্রিজ যেন ঢাকা প্রবেশের পুলসিরাত।’

কেন আটকে থাকতে হয় প্রশ্ন করলে তালহা বলেন, ‘এখানে কোনো নিয়ম নেই। দুয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তাতে কারোরই কিছু যায় আসে না। সেতুর ওপর বসানো হয় দোকান, অধিকাংশ সময় উল্টো পথে চলে গাড়ি। আর ব্রিজের মাঝখানে দুইটা বাস স্টপেজ। এসব কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানেই চলে যায়। দেখার কেউ নাই।’

সেতুর ওপর বাস স্টপেজ

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটি পুরান ঢাকার বংশাল থেকে কেরানীগঞ্জের কদমতলী পর্যন্ত। এরমধ্যে মিডফোর্ড হাসপাতালের সামনে থেকে সেতুতে উঠতে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। এই স্থান দিয়ে অনেক মানুষ সেতুতে উঠেন। এরপর কেউ নিজস্ব গাড়িতে, কেউ অটোরিকশায় আবার কেউ বাসে উঠেন। যাত্রীবাহী সব গাড়িও এখানে থামে। এ ছাড়া অটোরিকশা, ভ্যান গাড়িও দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়। এতে স্থানটি কার্যত পরিণত হয়েছে গাড়ির স্টপেজে।

একই চিত্র দেখা যায় কদমতলীর দিকে। সেখানেও দুটি সিঁড়ি। যাত্রীরা ক্রমাগত ওঠা-নামা করছেন। সেতুর উপরই গাড়ি থামিয়ে উঠছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লালবাগ জোনের এক সহকারী পুলিশ কমিশনার স্ট্রিমকে বলেন, ‘বাবুবাজার ব্রিজের যানজটের বড় কারণ এই সিঁড়ি। দৈনিক হাজার হাজার মানুষ এই সিঁড়ি ব্যবহার করেন। সেটার চাপ পড়ে ব্রিজের যান চলাচলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিজের ওপর বাসস্ট্যান্ড হওয়ার কথা না। একজন সার্জেন্ট ও একজন কনস্টেবল সেতুর ওপর কাজ করেন। কিন্তু দুজন মিলে পুরো বিষয়টা কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে যায়। প্রচুর গাড়ির চাপ থাকে তো।’

বাবুবাজার ব্রিজের ওপর যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ছবি: স্ট্রিম
বাবুবাজার ব্রিজের ওপর যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ছবি: স্ট্রিম

ডিএমপি ট্রাফিক কোতোয়ালি এলাকার সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম আসিফুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘সিঁড়ি দিয়ে সেতু থেকে যেহেতু নামার ব্যবস্থা রাখছে, স্বাভাবিকভাবে মানুষ উঠবে ও নামবে। আমার কাছে এরকম ইন্সট্রাকশন এখনও আসে নাই যে, এখানে উঠতে বা নামতে পারবে না।’

বসে ফল ও সবজির ভ্রাম্যমাণ বাজার

সেতুর উপর ওঠার পরই দেখা যায়, পাশজুড়ে ভ্যান গাড়ির সারি। এসব ভ্যানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমড়া, পেয়ারা, কলা, লাউ, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি। সেতু ধরে হেঁটে আসা অনেকেই থেমে সেখান থেকে ফল ও সবজি কিনছেন। বাইক ও অটোরিকশা থামিয়েও কয়েকজনকে বাজার করতে দেখা যায়।

ভ্যান ছাড়াও কয়েকজনকে ফুটপাতে সবজি নিয়ে বসতে দেখা যায়। এখানকার কয়েকজন বিক্রেতা জানান, তাঁরা বাজার মূল্যের চেয়ে কম টাকায় সবজি বিক্রি করেন। কারণ, এখানে তাঁদের ভাড়া বা চাঁদা দিতে হয় না। যারা একটু কম টাকায় বাজার করতে চান, তাঁরাই মূলত এই বাজারের ক্রেতা।

আমান নামের এক ক্রেতা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি পুরান ঢাকায় একটা কারখানায় কাজ করি। রাতে ব্রিজে জ্যাম পড়ে, তাই হেঁটে বাসায় ফিরি। যাওয়ার পথে এখান থেকেই সবজি কিনি। এখানে কম টাকায় সবজি পাওয়া যায়, আবার বাজারেও যেতে হয় না।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে লালবাগ জোনের এক সহকারী পুলিশ কমিশনার স্ট্রিমকে বলেন, ‘ব্রিজ থেকে দোকান সরাতে অনেকগুলো অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু অভিযান যখন করি, তখন কিছুটা ইমপ্রুভ হয়। ২৪ ঘণ্টা তো অভিযান চালানো সম্ভব না। ওই পরিমাণ লোকবল আমাদের নেই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পুরাটা আমরা কাভার করতে পারি না সত্যি কথা।’

বাবুবাজার ব্রিজের ওপর বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ছবি: স্ট্রিম
বাবুবাজার ব্রিজের ওপর বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ছবি: স্ট্রিম

তবে ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তা এস এম আসিফুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘ব্রিজের ওপর তো বাজার বসার কথা না। যাই হোক, আপনি যদি দেখে থাকেন, আমার অবজারভেশনে আসলো। আমরা ব্যবস্থা নেব, যাতে বাজার বসতে না পারে।’

উল্টো পথেও চলে গাড়ি

টানা কয়েকদিন ঘুরে দেখা যায়, সেতুর কোনো একপাশে যানজট তৈরি হলে এবং অন্য পাশ ফাঁকা থাকলেই উল্টো পথে যান চলাচল শুরু হয়। উল্টো পথে যাওয়ার এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি অটোরিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেল চালকদের। এতে প্রায় সময় দু’পাশেই আটকে যান যাত্রীরা।

বংশাল এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আতিক। তিনি প্রতিদিন ব্যবসায়িক কাজে নবাবগঞ্জ যান। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘রাত নাই দিন নাই, ব্রিজটা আটকে থাকে। অটোরিকশাগুলা উল্টা পথে আসে। ব্রিজের ওপরে স্ট্যান্ড বানায়ে বসে থাকে, হাঁটার জায়গা পর্যন্ত থাকে না। বিরক্ত হয়ে এখন ব্রিজে উঠা ছেড়ে দিছি। ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করি।’

এসব বিষয়ে এস এম আসিফুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘আপাতত যানজট লেগে থাকার কারণ বংশাল মোড়ের একটা লেন কাটা। যার কারণে ওখানে রাস্তাটা প্রায় অর্ধেক বন্ধ। এই কারণেই জটটা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, অটোরিকশাগুলো আসে মূলত ওপার থেকে। এখানে অটোরিকশা চলাচল নিষেধ। আমরা যখনই ধরি, ডাম্পিং করতে পাঠাই দিই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত