leadT1ad

আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদন

৯ বছরে নির্মল শহর থেকে সব চেয়ে দূষিত বাতাস রাজশাহী

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার রাজশাহীর বাতাস ছিল দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। অথচ ৯ বছর আগে বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণা কমানোর জন্য বিশ্বসেরার খেতাব পেয়েছিল এই শহর।

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
রাজশাহী

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ৫৩
৯ বছরে নির্মল শহর থেকে সব চেয়ে দূষিত বাতাস রাজশাহী। স্ট্রিম ছবি

বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণা কমানোর জন্য ২০১৬ সালে বিশ্বসেরার খেতাব পেয়েছিল রাজশাহী শহর। কিন্তু গতকাল সোমবার (২০ অক্টোবর) রাজশাহীর বাতাস ছিল দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। যানবাহন থেকে নির্গত হওয়া কালো ধোঁয়া আর নির্মাণকাজের ধুলার কারণে দূষিত হয়ে উঠেছে এই শহরের বাতাস। ৯ বছরের ব্যবধানে এখন নিয়মিতই শহরটির বায়ুদূষণের কথা উঠে আসছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদনে।

আইকিউএয়ার বাতাসের মান নির্ধারণে একটি তাৎক্ষণিক সূচক তৈরি করে, যা কোনো নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সেই সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দিয়ে সতর্ক করে। সোমবার দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে বায়ুর মান সূচক সবচেয়ে বেশি ছিল ১৬৭। তারপরই ছিল খুলনা ১৫৭। এ ছাড়া রংপুরে বায়ুর মান সূচক ১৩৭, বরিশালে ১১৪, ময়মনসিংহে ১১৩, সিলেটে ৮২ এবং চট্টগ্রামে ৭৩ রেকর্ড করা হয়েছে।

পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের নানা নিয়ামকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ফাইন পার্টিকুলার ম্যাটার (পিএম), যা পিএম ২.৫ হিসেবেও চিহ্নিত। বাতাসে মিশে থাকা অতি সূক্ষ্ম ধুলিকণা, গাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়া; ইটভাটা ও নির্মাণকাজ থেকে এই কণার উৎপত্তি হয়। এদিকে রাজশাহীতে এখনও ইটভাটগুলো বন্ধ। কলকারখানাও তেমন নেই। তবে বায়ু দূষণ করছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও শহরজুড়ে চলমান নির্মাণকাজ থেকে তৈরি হওয়া ধূলিকণা।

এসব কারণে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শংকর কে রায়। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে এখন সর্দি, জ্বর, কাশি, ফ্লু, ডেঙ্গু রয়েছেই। এর সঙ্গে দূষিত বায়ু ফুসফুসে গেলে শিশু ও বয়স্ক এবং আগে থেকেই হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টে ভোগা লোকজনের নানা অসুখ দেখা দেবে। বাতাসে দীর্ঘ সময় ধরে ভারি পদার্থ থাকলে স্বাভাবিক মানুষেরও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিবে। অ্যাজমা, হাঁপানি, যক্ষ্মা এবং ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘শহরজুড়ে প্রচুর নির্মাণকাজ হচ্ছে। কিন্তু বালু রাখা হচ্ছে রাস্তার ওপর। গাড়ি সেদিক দিয়ে গেলে চাকা উঠছে বালুর ওপর। বাতাসে ধূলিকণা বাড়ছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পরিবেশবান্ধব হলেও সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে সেগুলোও চলাচলের কারণে ধুলোবালি ওড়াচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তো শোনা যায় না।’

ধোঁয়া চোখে দেখে সনদ

রাজশাহী নগরের ভেতর দিয়েই এখনও বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল করে। শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লক্করঝক্কড় বাস এক জেলা থেকে আরেক জেলায় চলাচল করছে। সোমবার দুপুরে নগরের ভদ্রা এলাকা থেকে একটি বাসকে কালো ধোঁয়া নির্গত করে আসতে দেখা যায়। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে রেলগেট এলাকায় এসে থামার আগপর্যন্ত বাসটি কালো ধোঁয়া বের করছিল। এমন গাড়ি রাজশাহী শহরের ভেতরেই চলছে।

সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী এসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয় না। ট্রাফিক সার্জেন্টদের আগ্রহ শুধু মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন ও হেলমেটের দিকে। মোটরসাইকেলও কালো ধোঁয়া নির্গত করে। তবে এর বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিয়মিত মোটরসাইকেলেরও ধোঁয়া পরীক্ষা করে তার সনদ চালকের সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক।

জানতে চাইলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের দেশে মোটরসাইকেল একবার কেনার পর আর কখনও ধোঁয়া পরীক্ষা হয় না। এ ব্যাপারে মামলা হয় না। আমাদের দেশে বিষয়টা ওই পর্যায়ে যায়নি। তবে বাস-ট্রাকের মতো অন্যান্য যানবাহন কালো ধোঁয়া নির্গত করলে আমরা ব্যবস্থা নিই। এটা অবশ্য দেখার মূল দায়িত্ব বিআরটিএর। আমরা বিআরটিএকেও বলি যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া নির্গত করে তাদের যেন ফিটনেস সার্টিফিকেট না দেওয়া হয়।’

রাজশাহীতে বিআরটিএর কাছে যানবাহনের কালো ধোঁয়ার মান পরীক্ষার জন্য কোনো ডিভাইস নেই, ধোঁয়া চোখে দেখেই ফিটনেস সনদ দেয় তারা। প্রতিষ্ঠানটির রাজশাহী কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা স্টিমকে জানান, গ্যাস, পেট্রোল বা অকটেনচালিত মোটরযানের ধোঁয়া পরীক্ষা করার জন্য গ্যাস অ্যানালাইজার ও ডিজেলচালিত গাড়ির জন্য স্মোক মিটার আছে। এ যন্ত্রই ধোঁয়ার মান পরীক্ষা করে ফলাফল দেয়। এ যন্ত্র শুধু বিআরটিএর ঢাকা কার্যালয়ে আছে। দেশের আর কোথাও নেই।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) ফয়সাল হাসান বলেন, প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য আগে একবার তাকে শোকজ করা হয়েছিল। তাই প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়া তিনি কথা বলবেন না।

রাসিকে জরুরি বৈঠক

রাজশাহীর বাতাসের মান দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়ে পড়ার খবর জানতে পেরে সোমবার দুপুরেই জরুরি বৈঠক করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) কর্মকর্তারা। সেখানে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্মাণাধীন বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উদ্যোগে নির্মাণাধীন বাসাবাড়ির বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এ বৈঠকে ধূলিকণা কমানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন ডলারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে রাসিকের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহমুদ-উল-হাসান বলেন, ‘আমাদের রাজশাহীর পরিবেশের সুনাম রয়েছে। কিন্তু বাতাসের মান নিয়ে যে খবর এসেছে, এটা দুঃখজনক। এখন শহরে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। সে কারণে মাটি খোড়াখুড়ি হয়েছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় সেখান থেকে ধুলোবালি উড়ছে। পানি ছিটিয়ে এটা কমানো যায় কি না, সে জন্য সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখাকে বলা হয়েছে। তারা যেন ঠিকাদারদের দিয়ে এটা করান। ফ্লাইওভারগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে এটা থাকবে না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত