leadT1ad

ডিপ্লোমা বনাম বিএসসি: প্রমোশন ও পদমর্যাদা নিয়ে উত্তাল প্রকৌশল খাত

মো. ইসতিয়াকঢাকা
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ২১: ১৯
তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন বিএসসি প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি

বাংলাদেশের প্রকৌশল খাতে দীর্ঘদিনের পুরোনো দ্বন্দ্ব—ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বনাম বিএসসি গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার—আবার নতুন করে উত্তপ্ত রূপ নিয়েছে। প্রমোশন, পদমর্যাদা ও ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহারের প্রশ্নে দুই পক্ষের বিরোধ এখন দেশজুড়ে আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

মূল বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে প্রমোশন নীতি ও গ্রেডিং কাঠামোর উপর। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা চাইছেন, তাঁদের চাকরির এন্ট্রি পদ দশম গ্রেডে বহাল রাখতে এবং প্রমোশনে ৩৩ শতাংশ কোটার সংরক্ষণ বজায় রাখতে। অন্যদিকে বিএসসি ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, সহকারী প্রকৌশলীর মতো নবম গ্রেডের পদে প্রবেশের একমাত্র যোগ্যতা হতে হবে বিএসসি ডিগ্রি, আর ডিপ্লোমাধারীরা ‘প্রকৌশলী’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না।

দুই পক্ষের অবস্থান

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি

রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারস বাংলাদেশের যুগ্ম আহ্বায়ক প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ বলেন, ‘ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়াররা মূলত ডেস্কে কাজ করার জন্য। তাঁরা করবে মূলত ডিজাইন, প্ল্যানিং, গবেষণা। আর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা মাঠে বাস্তবায়নের জন্য। পৃথিবীর সব দেশেই এই বিভাজন আছে। কিন্তু এখন ডিগ্রিধারীরা চায় ডিপ্লোমাদের কাজও তারা দখল করুক।’

তিন দফা দাবিতে বিএসসি প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। স্ট্রিম ছবি
তিন দফা দাবিতে বিএসসি প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। স্ট্রিম ছবি

গোলাম মোহাম্মদ মনে করিয়ে দেন, ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ডিপ্লোমাদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে স্বীকৃতি দেন এবং ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার সময় তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা নির্ধারণ হয়। ‘এখন যদি প্রমোশন বা পদমর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়, হাজার হাজার তরুণের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হবে,’ বলেন তিনি।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সদ্য উত্তীর্ণ ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী আবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাস্তব দক্ষতাকে খাটো করা হচ্ছে। আমরা মাঠে মেট্রোরেল, ব্রিজ, এক্সপ্রেসওয়ে হাতে-কলমে বাস্তবায়ন করি। অথচ ডিগ্রিধারীরা শুধু কাগজে-কলমে পরিকল্পনা করে। চাকরির ক্ষেত্রে আমাদের ৩৩ শতাংশ কোটা কেটে দিলে হাজার হাজার ডিপ্লোমা ছাত্র বেকার হয়ে যাবে। এটি অন্যায়।’

গোলাম মোহাম্মদ আরও অভিযোগ করেন, ‘বিএসসি ডিগ্রিধারীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বা গবেষণায় নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেও দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপ্লোমারাই হাতে-কলমে কাজ করছেন। শুধু চেয়ারে বসে থাকা মানেই ইঞ্জিনিয়ার নয়।’

বিএসসি গ্র্যাজুয়েটদের দাবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রমোশন সমস্যা নতুন নয়। কিন্তু ২০১৩ সালের পর নীতি পরিবর্তনের কারণে তাঁরা নবম গ্রেডে পৌঁছাতে শুরু করেন, যা মূলধারার গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সম্ভব হয়নি। এতে প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।’

দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন।

ইফতেখারুল ইসলাম ব্যাখ্যা করেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর ল্যাব সুবিধা বা প্রশিক্ষণ বুয়েট, চুয়েট, কুয়েটের সমমান নয়। তাই প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতার অজুহাতে ডিপ্লোমাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া যৌক্তিক নয়।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সায়েম আহমেদ বলেন, ‘আমরা চার বছর ধরে কষ্ট করে বিএসসি করছি, অথচ চাকরিতে ঢুকেই দেখি ডিপ্লোমাধারীরা দ্রুত নবম গ্রেডে চলে যাচ্ছে। এতে আমাদের প্রতিযোগিতার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। প্রমোশন অবশ্যই স্বচ্ছ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।’

একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহজাবীন হাসান বলেন, ‘যারা বিএসসি করেননি, তারাও প্রকৌশলী উপাধি ব্যবহার করছেন। এটি শুধু বিভ্রান্তিই তৈরি করছে না, বরং আমাদের পরিশ্রম ও মর্যাদাকেও খাটো করছে। এ জন্য আমরা স্পষ্ট নীতি চাই।’

আন্দোলন ও সংঘর্ষ

এই দ্বন্দ্ব এখন রাস্তায়। গতকাল বুধবার (২৭ আগস্ট) রাজধানীর শাহবাগে ‘প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। পরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে গেলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এ সময় কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান ও লাঠিপেটায় অন্তত ৩৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন।

ডিপ্লোমা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি
ডিপ্লোমা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি

বিক্ষোভে বুয়েট ছাড়াও আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক, এমআইএসটি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এআইইউবি, নর্থ সাউথ, এশিয়া প্যাসিফিকসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। ঢাকার বাইরে কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, শাবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরাও সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন।

শাহবাগে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে। বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) দেশের সব প্রকৌশল ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলছে।

সরকারের পদক্ষেপ ও ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন

প্রমোশন ও পদমর্যাদা নিয়ে এই সংঘাতের প্রেক্ষিতে, সরকার গতকাল (২৭ আগস্ট) বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে সভাপতি করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।

এরপর আজ বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ও ডিপ্লোমাধারীদের দাবিগুলো পর্যালোচনার জন্য ১৪ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। গ্রুপের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত আছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম।

কমিটির সভাপতি ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। আমাদের দায়িত্ব হলো সেতুবন্ধন তৈরি করা এবং দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। যেকোনো সময় আন্দোলনকারীরা ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করতে পারবেন। আমরা দুই পক্ষের দাবি শুনব, বুঝব এবং নিরপেক্ষভাবে সমাধানের চেষ্টা করব।’

আন্দোলন ও কমপ্লিট শাটডাউন

দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন।

আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সে (আইইবি) সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানান প্ল্যাটফর্মের সভাপতি মো. ওয়ালি উল্লাহ। সেখানে ভিডিও চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ডিপ্লোমা ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য তুলে ধরা হয়।

ওয়ালি উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের তিন দফার ওপর আন্দোলন চলছিল। গতকালের ম্যাসিভ ইনসিডেন্ট সুরাহা পায়নি, তাই আমাদের কর্মসূচি—নেক্সট অ্যানাউন্সমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের ক্যাম্পাসে কমপ্লিট শাটডাউন বলবৎ থাকবে।’ এ ছাড়া আন্দোলনকারীরা চলতি সপ্তাহে বিভাগীয় সম্মেলন এবং পরবর্তী সপ্তাহে জাতীয় সম্মেলন করারও ঘোষণা দেন।

Ad 300x250

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কি দীর্ঘ হওয়ার পথে

দেশের সব ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’

সিজারের সময় পেটে এক ফুট গজ রেখেই সেলাই, সাত মাস পর অপসারণ

ডিপ্লোমা বনাম বিএসসি: প্রমোশন ও পদমর্যাদা নিয়ে উত্তাল প্রকৌশল খাত

ইসির ঘোষিত নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়া

সম্পর্কিত