leadT1ad

সংগীত-শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ বাতিল: রুলের জবাব দেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ, শুনানির প্রস্তুতিতে রিটকারী

ইমরান নাফিস
ইমরান নাফিস
ঢাকা

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩: ১৮
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা বাতিল করেছে সরকার। সংগৃহীত ছবি

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছিলেন, তার জবাব দেয়নি সরকারপক্ষ। ১০ নভেম্বর দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হলেও ২৪ নভেম্বর সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাড়া না পাওয়ায় মামলাটি এখন চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রস্তুত করছেন রিটকারী আইনজীবী। আগামী ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির আগেই শুনানির দিন ধার্যের আবেদন করা হবে।

প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সংশোধিত বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারওয়াত সিরাজ শুক্লা স্ট্রিমকে জানান, আদালতের সময়সীমা শেষ হলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো উত্তর বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এই নীরবতাকে সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে আদালতে প্র্যাকটিস করছি। রাষ্ট্রপক্ষের এই কৌশল আমার জানা। তারা নিজেরা কোনো উদ্যোগ নেবে না। যেই মুহূর্তে আমরা শুনানির দিন ধার্য করার আবেদন করব, তখনই অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে আরও সময় চাওয়া হবে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ সময় চাইলেও আমরা আমাদের আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’

সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। আদালতের বিবিধ শাখার কাজ শেষে দ্রুত শুনানির আবেদন করা হবে। ১৮ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া ছুটির আগে বিষয়টি শুনানিতে তুলতে চান বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

রুলের জবাব না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির বলেন, আদালত ১০ নভেম্বর রুল জারি করেছিলেন। এখন নিয়ম অনুযায়ী রিটকারীকে মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রস্তুত করে দিন ধার্য করতে হবে। বিবাদী যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষ, তাই রিটকারী পক্ষ উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত তারা সাধারণত নীরব থাকে। রিটকারী দিন ধার্য করলেই পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া এগোবে এবং শুনানির পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানান তিনি।

এদিকে এই রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হতে চাইছে শারীরিক শিক্ষকদের একটি সংগঠন। সারওয়াত সিরাজ শুক্লা জানান, সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিষয়টি এখন শুধু জনস্বার্থ নয়, সরাসরি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও পরিণত হয়েছে। তারা মূল রিটে যুক্ত হবেন নাকি আলাদা আবেদন করবেন, তা শিগগিরই সিদ্ধান্ত হবে।

সরকারের সিদ্ধান্তের অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে আইনজীবী শুক্লা বলেন, অক্টোবরের শেষ দিকে মাউশি সপ্তাহে অন্তত দুই ঘণ্টা শরীরচর্চার নির্দেশনা দেয়। অথচ এর তিন দিন আগেই প্রাথমিকে শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করা হয়। ‘একদিকে শরীরচর্চার নির্দেশ, অন্যদিকে শিক্ষক বাতিল; এটি স্পষ্টতই সরকারের সিদ্ধান্তের স্ববিরোধিতা।’

তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে কথা বলতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনীহা দেখাচ্ছেন। সাংবাদিকেরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। ‘ভয় পাচ্ছেন, কথা বললে যদি কোনো তকমা লেগে যায়।’

সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার বদলে ধর্মীয় সংস্কৃতি চালুর প্রসঙ্গে সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, ‘ধর্ম শিক্ষায় কোনো বাধা নেই। প্রাথমিকে ধর্ম শিক্ষা আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু সংগীত বা শরীরচর্চা বাদ দিয়ে কেন? কারও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা থাকলে তিনি সংগীত না-ই শিখতে পারেন, এটি ঐচ্ছিক রাখা যেতে পারে। কিন্তু পুরো বিষয়টি বাদ দেওয়া কেন? আর শরীরচর্চা তো স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। আজানের সুরও তো সুললিত। তাই বলে গান বা শরীরচর্চাকে ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে বাতিল করা ঠিক নয়।’

এর আগে গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এতে প্রথমবার সহকারী শিক্ষক (সংগীত) ও সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা) পদ সৃষ্টির কথা বলা হয়।

বিধিমালা জারির পরপরই হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন এর বিরোধিতা শুরু করে। তারা সংগীত শিক্ষক নিয়োগকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলে এবং বাতিল না হলে আন্দোলনের হুমকি দেয়।

চাপের মুখে সরকার দুই মাসের মাথায় অবস্থান বদলায়। ২ নভেম্বর প্রকাশিত সংশোধিত গেজেটে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক পদ বাদ দেওয়া হয়। সেখানে কেবল প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদের কথা রাখা হয়।

পদ বাতিলের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ৪ নভেম্বর এক ব্যাখ্যায় জানায়, দেশে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আড়াই হাজার ক্লাস্টারে একজন করে সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ, এতে কার্যকর সুফল পাওয়া যাবে না এবং বৈষম্য তৈরি হবে। তবে ভবিষ্যতে অর্থের সাপেক্ষে এসব পদ বিবেচনা করা হতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠন আসক এই সিদ্ধান্তকে ‘অনভিপ্রেত ও পশ্চাদমুখী’ বলে মন্তব্য করেছে। তাদের মতে, সরকারের ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও এটি রাজনৈতিক চাপের ফল।

১৯ নভেম্বর জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলনও তীব্র প্রতিবাদ জানায়। দেশের ৮০ জন বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যৌথ বিবৃতিতে বলেন, সিদ্ধান্তটি শিশুর সার্বিক বিকাশের পরিপন্থি এবং শিক্ষাবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদদের গবেষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১০ নভেম্বর সংশোধিত বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সারওয়াত সিরাজ শুক্লা হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মো. আসিফ হাসানের বেঞ্চ রুল জারি করেন এবং শিক্ষাসচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত