বাউলদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ‘বাউলের দ্রোহ’ শিরোনামে একটি বিচারগানের আসরের আয়োজন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। এই অনুষ্ঠানটি জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে উচ্চ শব্দে গান বাজানো, বেশি রাতে গান করা ও ঠিকভাবে অনুমতি না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আয়োজকদের বিরুদ্ধে।
গতকাল রবিবার (৩০ নভেম্বর), বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে (ট্রান্সপোর্ট) ‘বাউলের দ্রোহ’ গানের অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। রাত ৯টার পর অনুষ্ঠানের উচ্চ শব্দে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে, এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাত ১০টার দিকে পরিবহন চত্বরে যায় প্রক্টরিয়াল টিম। এ সময় প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম আয়োজকদের শব্দ কমিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি রাত ১১টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে বলেন।
এরপরেও শব্দ না কমানোয় পরবর্তীতে আরও কয়েক দফায় আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। এরপর রাত দুইটার দিকে আবারও পরিবহন চত্বরে যায় প্রক্টরিয়াল টিম। এ সময় মঞ্চে উঠে আয়োজকদের গান বন্ধ করতে বলেন প্রক্টর। এক পর্যায়ে তিনি উপস্থিত শিক্ষক এবং আগত অতিথি রিতা দেওয়ান, নয়ন দেওয়ানের সাথে ‘উগ্র’ আচরণ করেন এবং জোরপূর্বক গান বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ করেন কিছু প্রত্যক্ষদর্শী।
প্রত্যক্ষদর্শী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী শরণ এহসান স্ট্রিমকে বলেন, ‘উনি (প্রক্টর) সরাসরি স্টেজে উঠে বলছেন, গান বন্ধ। গান হবে না। মানে প্রোগ্রাম বন্ধ। স্টেজে তখন গান হচ্ছে। উনি খুব অ্যাগ্রেসিভলি মঞ্চে উঠে গান বন্ধ করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সময় হচ্ছে যে ওখানে হাসান নাঈম স্যার উপস্থিত ছিলেন। উনি গান শুনতে এসেছিলেন। অন্য অনেক শিক্ষক এসেছিলেন, ম্যাম এসেছিলেন। তো উনি (হাসান নাঈম) যখন সামনে গেছেন, স্যার খুব উত্তপ্ত ভাষায় বলেন যে, “আপনি এখানে কী করেন? আপনি স্টুডেন্টদের নিয়ে এত রাত কী করেন এখানে?” সেটা আসলে একজন শিক্ষক আরেকজন সহকর্মীর সাথে এরকম আচরণ করতে পারে না। কারণ, এখানে তাঁর শিক্ষার্থীরা ও তিনি বিব্রতবোধ করেছিলেন।’
এ বিষয়ে ‘বাউলের দ্রোহ’র অন্যতম আয়োজক নবীন কিশোর গোস্বামী বলেন, ‘আমরা খুবই সামান্য সাউন্ড ব্যবহার করছিলাম। সেটা হচ্ছে দুই পেয়ার সাউন্ড। অত বেশি সাউন্ডও না যে একটা মানুষের খুব স্বাভাবিক চলাফেরা কিংবা ঘুমে বা পড়াশোনায় খুব ডিস্টার্ব করতে পারে। তারপরও যেহেতু অভিযোগ আসছে, তো আমরা আমাদের মতো করে সাউন্ডটা একদম কমিয়ে রাখছি, সহনীয় মাত্রায় রাখছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরপর প্রক্টর স্যার এসে বলেন ১১টার মধ্যে শেষ করতে। তখন স্যারকে রিকোয়েস্ট করছি যে স্যার প্লিজ, এটাকে ১১ টায় শেষ করা সম্ভব না। যদি আরেকটু সময় দেন, আমরা ১টার মধ্যে ট্রাই করব স্যার এটাকে শেষ করার। পরে স্যার বলেছেন, তাহলে সাউন্ড এমনভাবে রাখো যাতে এই এরিয়ার মধ্যে যাতে শোনা যায়। এরপর স্পিকারের সাউন্ড একদম প্রায় জিরোর কাছাকাছি রাখা হয়েছে।’
এ বিষয়ে প্রক্টর রাশিদুল আলম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা সাউন্ড কমাতে বলেছি প্রথমে। এরপরেও তারা সেটা করেনি। তারপরে রাত ১১টায় বলেছি ১২টায় বলেছি—কন্টিনিউয়াসলি বলেই গেছি। তারপরে রাত দেড়টায় গিয়ে বলেছি। তখন আমরা তাদের একটু স্টপ রাখতে বলি। যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছে।’
উপস্থিত শিক্ষক ও অতিথিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রক্টর বলেন, ‘এটার সব ভিডিওতে রেকর্ড আছে। এগুলো দেখেন, তাহলে বুঝবেন।’
অন্যদিকে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, প্রক্টরের সামনে ‘গালিগালাজ’ করেন সজীব আহমেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) জাবি শাখার সংগঠক। এ বিষয়ে সজীব আহমেদ বলেন, ‘আমি গালি দিয়েছি এটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু সবার আগে জাকসুর সদস্য চিশতী আমাদের লেকের পানিতে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। এর প্রেক্ষিতে আমি গালি দেই। এরপর সেখানেই প্রক্টরের সামনে ও আমাকে বাস্টার্ড বলে গালি দেয়।’
অনুমতি ব্যতীত অনুষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ‘বাউলের দ্রোহ’ বিচারগানের আসরটি প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই পরিচালনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীভিত্তিক কিছু গ্রুপেও এ বিষয়ে সমালোচনা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় কোন প্রকার মাইকিং, ব্যান্ডপার্টিসহ শোভাযাত্রা করা নিষেধ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাইলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
এ নিয়ম না মেনেই অনুষ্ঠান আয়োজন করার অভিযোগ এসেছে। এ ব্যাপারে আয়োজক নবীন কিশোর গোস্বামী বলেন, ‘আবুল সরকারের মুক্তি এবং বাউলদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদে হচ্ছে বাউলের দ্রোহ। এই ট্রান্সপোর্টের প্রোগ্রামটা যুগ যুগ থেকে আসতেছে। এটা তো অফিসিয়ালি কোনো প্রোগ্রামের জন্য কোনো নির্ধারিত জায়গা না। সবসময় যেটা হয়, প্রক্টর স্যারকে কিংবা দায়িত্বরতদেরকে আমরা আমন্ত্রণ জানাই। এবারও সেটার ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রক্টর স্যারকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ফোন করা হয়েছিল, ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে ওই পোস্টারসহ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাঁকে অবগত করে রাখা হয়েছে। এখানে আসলে অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে নাই কখনোই। মানে এটা তো ওরকম মুক্তমঞ্চ কিংবা অডিটোরিয়াম, আমরা ঐরকম জায়গা না।’
এ বিষয়ে প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘ওরা একটা অনুষ্ঠান করবে বলে আমাদেরকে জানিয়েছিল। তখন বলেছিলাম কেন রাত রাত ১০টা বা ১১টার মধ্যে এটা যেন কমপ্লিট করে ও শব্দের মাত্রা যেন সহনীয় পর্যায়ে রাখে। কারণ অন্যের অধিকারকে খর্ব করে তো আর অনুষ্ঠান করা যায়না।’
শিক্ষার্থীদের পালটা প্রতিবাদ
রাত ১টার দিকেও উচ্চ শব্দে গান বন্ধ করতে প্রশাসন কোন উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ায়, প্রতিবাদ স্বরূপ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গান বাজানোর ঘোষণা দেন একদল শিক্ষার্থী। এরপর রাত সোয়া একটার দিকে উপাচার্যের বাসার সাউন্ডবক্সে গান বাজানো শুরু করেন তারা।
এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ হল সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) সিফাতউল্লাহ সিফাত বলেন, ‘রাত ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। গানের উচ্চ শব্দে তাঁরা পড়তে পারছেন না, তাঁদের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আয়োজকেরা সেসব মান্য করেননি এবং প্রশাসনেরও টনক নড়েনি। প্রশাসন যখন কোনো উদ্যোগ নেয়নি, আমরা ভিসির বাসভবনের সামনে গিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ গান বাজিয়েছি।’
এ বিষয়ে প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘পরিবহন চত্বরে উচ্চ শব্দের গানের প্রতিবাদস্বরূপ একদল শিক্ষার্থী ভিসির বাসার সামনে অবস্থান নিয়েছেন এবং তাঁরাও কিছুটা উচ্চ স্বরে কিছু অ্যাকটিভিটিস করেছেন। সেগুলোও আমরা তাঁদের কাছে আশা করি না।’