leadT1ad

বিবিসির প্রতিবেদন

উৎসবের ছোঁয়া লাগলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় বাংলাদেশের জন্য এখনো কঠিন

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গত এক বছরে গণপিটুনি, প্রতিশোধের জন্য হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ধর্মীয় উগ্রবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসবই দেশের গণতন্ত্রের পথে শঙ্কার ছায়া ফেলছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩১
গেটে ইমেজ

এই সপ্তাহে ঢাকায় হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। তারা উদযাপন করছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পূর্তি। অনেকের চোখে এটা ছিল নতুন ভবিষ্যতের শুরু। বৃষ্টি ঝরছিল টুপটাপ। এর মাঝেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন দলের নেতারা দাঁড়িয়েছিলেন—একসঙ্গে, দৃঢ়ভাবে। সেখান থেকে আসে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা।

দেশের নানা প্রান্তে মানুষের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। কনসার্ট, সমাবেশ, দোয়া—সব জায়গায় উৎসবের আমেজ। কেউ কেউ হাসিনার পতনকে দেশের ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তবে এই আনন্দ-উদযাপন গত ১২ মাসের পুরো গল্পটি বলে না।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গত এক বছরে গণপিটুনি, প্রতিশোধের জন্য হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ধর্মীয় উগ্রবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসবই দেশের গণতন্ত্রের পথে শঙ্কার ছায়া ফেলছে।

এদিকে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা হারানো হাসিনা পাশের দেশ ভারতে নির্বাসনে আছেন। গত জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী দমনপীড়নের দায় তিনি অস্বীকার করেছেন। দেশে ফিরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার মুখোমুখি হতেও রাজি নন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

‘আমার মনে হয়, এটা ছিল সরকার বদল, বিপ্লব না। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, পুরুষের দাপট আগের মতোই আছে,’ বিবিসিকে বলেন নারী অধিকারকর্মী শিরীন হক।

শিরীন হক ছিলেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এই কমিশন গঠন করেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে ১০ সদস্যের এই কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে নারীর উত্তরাধিকার ও তালাকের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষার সুপারিশ করা হয়। যৌনকর্মীরা প্রায়ই পুলিশ ও অন্যদের দ্বারা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন।

এর পরের মাসে হাজারো ইসলামি কঠোরপন্থী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। তারা অভিযোগ করে, এসব প্রস্তাব ইসলামবিরোধী। তাদের দাবি, পুরুষ ও নারী কখনো সমান হতে পারে না।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে হওয়া এই বিক্ষোভে কমিশন ভেঙে দেওয়ার দাবি ওঠে। প্রস্তাব দেওয়ার জন্য কমিশনের সদস্যদের শাস্তি চাওয়া হয়। হেফাজতে ইসলামের একজন প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন।

এরপর থেকে জনপরিসরে কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আর কোনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।

‘আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। আমরা যখন হেফাজতের আক্রমণ ও অপমানের শিকার হয়েছিলাম, তখন অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের যথেষ্ট সহায়তা দেয়নি,’ বলেন শিরীন হক।

অধ্যাপক ইউনূসের কার্যালয় এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য জানায়নি।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব বিক্ষোভ কট্টরপন্থীদের বৃদ্ধি পাওয়া আত্মবিশ্বাসের একটি উদাহরণ। হাসিনার সময়ে যাঁদের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারা দেশের কিছু এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে আপত্তি তুলেছে, নারী তারকাদের বাণিজ্যিক প্রচারে অংশ নেওয়া নিয়ে আপত্তি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে নারীদের পোশাক নিয়ে প্রকাশ্যে হয়রানিও করেছে।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত শুধু নারীরাই নন। গত এক বছরে কট্টরপন্থীরা সুফি মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের বহু উপাসনালয় ভাঙচুর করেছে।

শিরীন হকের মতো অনেকেই যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, বাংলাদেশ তখনও অতীতের মোকাবিলা করছে।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দেশে এখনও ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বেআইনি হত্যা, গুম এবং বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করার অভিযোগ রয়েছে।

সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন যারা শুধু বিচারই চাননি, চেয়েছেন প্রতিশোধও।’

ডেভিড বার্গম্যানের মতে, ‘আওয়ামী লীগ আমলে যে অবিচার ছিল, তা এখন চলতে দেওয়া যাবে না। বর্তমান সময়েও সেই অন্যায় আবার করা ঠিক হবে না।’

কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবি, এখন ঠিক সেটাই ঘটছে। তাদের অভিযোগ, গত এক বছরে দলের শত শত সমর্থক গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন সমর্থক ও সাংবাদিককে খুনের মামলায় কয়েক মাস ধরে কারাগারে রাখা হয়েছে। তাদের জামিনের আবেদন বারবার আদালত খারিজ করেছে। সমালোচকদের বক্তব্য, এসব খুনের ঘটনায় কোনো সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগকে আগে সমর্থন করেছিলেন বলেই তাঁদের আটক রাখা হয়েছে।

‘বড় ধরনের গণ-আন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা ফিরতে সময় লাগে। আমরা এখন একটি পরিবর্তনশীল সময়ের মধ্যে আছি,’ স্বীকার করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা এবং কয়েক মাস আগ পর্যন্তও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন।

নাহিদ ইসলাম স্বীকার করেন, দেশে এখন নানা চ্যালেঞ্জ আছে। তবে তিনি ইসলামী প্রভাব বাড়ার আশঙ্কা নাকচ করেছেন। তাঁর মতে, এটি বহু বছর ধরে চলা ‘একটি বড় সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অংশ।’

তবে বাংলাদেশে কিছু অগ্রগতির লক্ষণও আছে। অনেকেই মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে পেরেছে। টিকে আছে ব্যাংক খাতও।

বাংলাদেশ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে। খাদ্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রাখা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও শক্ত অবস্থানে আছে—বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলার। এর পেছনে রেমিট্যান্স ও আন্তর্জাতিক ঋণের ভূমিকা আছে। রপ্তানিও স্থিতিশীল রয়েছে।

তবে এর বাইরে আরও কিছু বিষয় আছে, যা সংখ্যায় মাপা যায় না।

নাহিদ ইসলামের দাবি, ‘হাসিনার পতনের পর দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে।’ রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যাকাণ্ড, সামরিক অভ্যুত্থান, তিক্ত বৈরীতার ইতিহাস থাকা একটি দেশে এটি উদযাপনেরই বিষয়।

তবে সবাই তাতে একমত নন।

এখনও অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভায় দুজন ছাত্রনেতা আছেন। সমালোচকদের দাবি, আওয়ামী লীগকে সাময়িক নিষিদ্ধ করার মতো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছাত্রনেতাদের চাপে নেওয়া হয়েছে।

‘কিছু কিছু সময় সরকার জনতুষ্টিবাদী দাবিতে সাড়া দিয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। কারণ, আশঙ্কা ছিল বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। তবে এটা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম,’ বলেন ডেভিড বার্গম্যান।

এদিকে নির্বাসিত এক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেছেন, দলের সমর্থকদের আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। অধিকাংশ নেতা হয় নির্বাসনে, নয়তো কারাগারে।

‘আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না,’ বিবিসিকে বলেন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক বছরে মব সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুও অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিবেদনের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়েছি। কিন্তু যদি একনায়কতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ না হয়, তাহলে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা সম্ভব হবে না।’

বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যদি অর্থবহ পরিবর্তন না আসে, তাহলে আন্দোলনে শহীদদের ত্যাগ বৃথা যাবে।

প্রতিবেদন: আনবারাসন এথিরাজন, বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সম্পাদক; অনুবাদ: কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ

Ad 300x250

জুলাই হত্যার বিচারে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর পুনরাবৃত্তি হবে না: প্রেস সচিব

শিবির উপস্থিত থাকায় উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক থেকে ওয়াক আউট বামপন্থীদের একাংশের

এনসিপিসহ নতুন ১৬ দল নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক যাচাইয়ে উত্তীর্ণ

ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ কর্মী, পদে আছেন হত্যা মামলার আসামিও

উৎসবের ছোঁয়া লাগলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় বাংলাদেশের জন্য এখনো কঠিন

সম্পর্কিত