leadT1ad

অধ্যাপক কুশল বরণকে নিয়ে কেন বিতর্ক, এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৫: ১৭
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৪৩
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইয়াহিয়া আক্তারের কার্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সাক্ষাৎকার দিতে এসে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী। গত বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সাক্ষাৎকার দিতে গেলে তাঁকে ঘিরে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের একাংশের প্রতিবাদ ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিদেশে বসবাসরত কিছু সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে দিয়েছেন। এমনকি শেখ হাসিনা পালানোর পর সনাতনী জোটের বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে ‘ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘উগ্রবাদী’ স্লোগান দিয়েছেন। এসব অভিযোগের কারণে একাধিক সংগঠন তাঁর পদোন্নতির বিরোধিতা করে।

ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে তিনি প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করলে একদল ছাত্র তাঁকে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে শুরু করে। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করা।’

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কুশল বরণ চক্রবর্তীকে উপাচার্যের দপ্তরে আশ্রয় নিতে হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর উপাচার্যের গাড়িতে করে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান।

তবে কুশল বরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক খালেদা আক্তার বলেন, ‘কুশল স্যার নিজেই শিক্ষার্থীদের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে উত্তেজনা তৈরি করেছেন। পরে তাকে নিরাপত্তার জন্য উপাচার্যের দপ্তরে রাখা হয়।’

একপর্যায়ে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
একপর্যায়ে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সূত্র বলছে, এ ঘটনায় শিক্ষক সমাজ বিভক্ত। কেউ কেউ মনে করছেন, কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

কুশল বরণের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

গত বছর ২৬ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারীদের হামলার শিকার হন। ওই সময়ে তিনি কিরিচের কোপে মাথায় গুরুতর জখম হন এবং তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনায় তিনি গত ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রধান আসামি করে ১৬৪ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। এই মামলার ২০ নম্বর আসামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী এই অধ্যাপক।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কুশল বরণ বলেন, ‘ওই দিন আমি চট্টগ্রামেই ছিলাম না। ঢাকায় ছিলাম।’

এ ছাড়া গত বছর ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন কুশল বরণ চক্রবর্তী। ভারতের প্রেসক্রিপশনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে তাঁর গ্রেপ্তারেরও দাবি জানান তারা। তাঁকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সমর্থক ও র-এর এজেন্ট বলে অভিযোগ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আহমাদ ইফতেখার বলেন, ‘কুশল স্যার নিয়মিত ধর্মবিদ্বেষমূলক পোস্ট দেন। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছি, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আজ আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছি। আমরা চাই তাঁর পদোন্নতি স্থগিত করা হোক এবং তদন্ত করা হোক।’

এদিকে কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ হচ্ছে, তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুজিববর্ষ বিষয়ে যেসব প্রবন্ধ জমা দিয়েছেন, তা তার একাডেমিক ডিসিপ্লিন-সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও প্রশাসনিক সূত্র বলছে, নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতির জন্য প্রার্থীর গবেষণা, পাণ্ডিত্য এবং প্রকাশনার সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক মিল থাকা আবশ্যক। কিন্তু কুশল বরণ চক্রবর্তী সেই ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করেছেন কি না, তা বোর্ডে খতিয়ে দেখার আগেই ঘটনাবহুল প্রতিবাদের ভেতর তিনি যেন একপ্রকার ‘ভিকটিম’ হিসেবে সামনে চলে এসেছেন।

আপনাকে আমরা বসিয়েছি, নিজের যোগ্যতায় আসেননি: ভিডিও ভাইরাল

ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতিতে গত শুক্রবার বিকেল ৩টায় বোর্ড বসার কথা ছিল। এরপরই শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। পরে সাড়ে ৩টায় প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এ সময়ে তাঁদেরকে ‘বাহ! ভিসি চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার’; ‘একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জেলে ভর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।

ওই দিনই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তীকে ঘিরে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হট্টগোল করতে দেখা যায়। এ সময় উপাচার্য ইয়াহইয়া আখতারকে উদ্দেশ্যে করে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি, আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।’

কয়েকজন যুবকের পাশাপাশি ভিডিওটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কয়েকজন শিক্ষককেও দেখা গেছে।

পদোন্নতির বোর্ড বাতিল

এ হট্টগোলের পর পদোন্নতির বিল বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক শামিম উদ্দিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে এটি আমাদের জানা ছিল না। ছাত্রদের কাছ থেকে অভিযোগ আসার পরে তার নামটা বোর্ড থেকে উইথড্র করছি। পরবর্তীতে বোর্ড দেওয়া হবে।’

বিশ্লেষকদের মতে, একদল প্রতিবাদকারীর কারণে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে কুশলের প্রকৃত যোগ্যতা বা অযোগ্যতা যাচাইয়ের জায়গাটা চাপা পড়ে গেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত