বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের বিদেশে প্রশিক্ষণ সফর আটকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার পরিবর্তন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পাবে। তখন গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণমন্ত্রীর সমান হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি কমবে। ফলে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিদেশে যেতে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ডেপুটি গভর্নরদের সফর আটকে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-২০২৫’-এর খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এরপর থেকেই মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো এই সংশোধনের বিষয়ে সভা না করায় বর্তমান সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসন পাবে কি না, তা অবশ্য নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় ডেপুটি গভর্নরসহ অন্য কর্মকর্তারা কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি। এতে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন, ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ প্রণয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করার ঘোষণা দেন। এরপর উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নিয়ে অর্ডারের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়। খসড়ায় গভর্নরের পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও নিয়োগপ্রক্রিয়া বদলানোর প্রস্তাব করা হয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান রয়েছেন। খসড়ায় এই সংখ্যা তিনি থেকে কমিয়ে একজন প্রস্তাব করা হয়েছে।
আটকে দেওয়া হচ্ছে বিদেশ সফর
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানায়, চলতি মাসে আইএমএফের উদ্যোগে ও খরচে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নেওয়ার জন্য আরেক ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমানকে মনোনীত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী অনুমোদন ও আদেশ জারির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, অনুমতি দেওয়া হবে না। এর পরিবর্তে একজন নির্বাহী পরিচালককে প্রশিক্ষণের জন্য দেশটিতে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে ডিজিটাল লেনদেন ও কার্ড ব্যবস্থা নিয়ে এক কর্মশালায় যোগদানের আমন্ত্রণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরীকে এই কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত করা হয়। এর খরচ বহন করবে কার্ড ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় একটি কোম্পানি। সরকারি অনুমোদন ও সরকারি আদেশ জারির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সরকার কোন জবাব দেয়নি, এর মধ্যে কর্মশালায় তারিখ পেরিয়ে যায়।
এর আগে গত জুলাইয়ে মরক্কোয় ইসলামি অর্থায়ন ব্যবস্থা নিয়ে ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আইএফএসবি) বার্ষিক সভা ও ৪৬তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সাল থেকে এর সদস্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। এ জন্য এই সভায় অংশ নিতে গভর্নর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানায় আয়োজক সংস্থা ব্যাংক আল মাগরিব। গভর্নর এই সময়ে ব্যস্ত থাকায় ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়ন দেন। এরপর সরকারি অনুমোদন ও সরকারি আদেশ জারি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, অনুমতি দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এর আগে কখনো ডেপুটি গভর্নরদের সফর আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। অর্ডার পরিবর্তন হলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে তারা নিয়ন্ত্রণ হারাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকেও আমলাদের প্রতিনিধি কমে আসবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন প্রস্তাবকে অর্থ মন্ত্রণালয় আর ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। ফলে সব কার্যক্রম বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ব্যাংক একীভূত ও নতুন ব্যাংক গঠন কার্যক্রমও একই কারণে বিলম্ব হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘স্বায়ত্তশাসন চাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের যে দন্দ্ব শুরু হয়েছে, এর ফলে ক্ষতি হবে দেশের অর্থনীতির। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা উচিত।’
মোস্তফা কে মুজেরি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে যেসব পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে, তা পাশ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর কোনো সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। পুরো জবাবদিহি সংসদের কাছে চলে যাবে। এই সরকার অর্ডারটা অনুমোদন করে দিলে দেশের জন্য ভালো হয়।’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে আমলাদের বিদেশ সফরে লাগাম টানছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েও একই নীতি অনুসরণ করে। গত জুলাইয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি অর্থায়নে সরকারি কর্মচারীদের সব ধরনের বৈদেশিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালায় অংশগ্রহণ বন্ধ থাকবে। তবে সরকারি অর্থায়নে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ কর্তৃক প্রদত্ত বৃত্তি ও ফেলোশিপের আওতায় বৈদেশিক অর্থায়নে মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে। এ ছাড়া সরকারি অর্থায়নে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বৈদেশিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা যাবে।