leadT1ad

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস

১৭০ বছরেও কাটেনি সাঁওতালদের বঞ্চনা

সাঁওতাল অভ্যুত্থান আজও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ভীষণ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তবে এখনো নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। দিবসটি উপলক্ষে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পথসভা হয়।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১৮: ৪৮
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ১৮: ৫৫
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে দিবসটি উপলক্ষে তীর-ধনুক নিয়ে পদযাত্রায় অংশ নেন সাঁওতালরা। ছবিটি ৩০ জুন উপজেলার বাগদাফার্ম কাটামোড় এলাকায়।

চলতি বছরের ৩০ জুন ১৭০ বছর পার করল ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ১৮৫৫ সালের এই দিনে সিঁধু-কানুসহ চার ভাই এবং দুই বোনের নেতৃত্বে সেই সময়ে ব্রিটিশ দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন সাঁওতালরা। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দেশীয় সহচর জমিদার, সুদখোর ও পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। ব্রিটিশ-ভারতেবর্ষে প্রথম সশস্ত্র এই আন্দোলন ও সাঁওতালদের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীতে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকেই অনুপ্রাণিত করেছিল।

সাঁওতাল অভ্যুত্থান আজও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ভীষণ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তবে এখনো নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। দিবসটি উপলক্ষে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পথসভা হয়। এতে বক্তারা বলেন, ১৭০ বছর ধরে সাঁওতালদের কাছে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের গৌরবোজ্জ্বল এক স্মারক ‘হুল দিবস’ (সাঁওতালরা বিদ্রোহকে হুল বলে)। কিন্তু এখনো তাঁরা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। এখনো তাঁরা ভূমির অধিকার বা সমতলের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। তাঁরা এই স্বীকৃতি চান।

একইভাবে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সমাবেশ হয়েছে। এতে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সাঁওতালরা এখনো অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২০১৬ সালে গোবিন্দগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত তিনজন সাঁওতাল হত্যার বিচার এখনো হয়নি। সেই সময় সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে হওয়া হামলা-অগ্নিসংযোগ-লুটপাট হলেও তার বিচার পায়নি ভুক্তভোগীরা। বক্তারা সাঁওতালদের জীবনের নিরাপত্তাসহ বাগদা ফার্মের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ১৮৫৫ সালের এই দিনে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব মুরমুর নেতৃত্বে সাঁওতালেরা যে বিদ্রেহ শুরু করেছিল, তা কেবল সংগ্রাম নয়। এটা ছিল একটি জাতির মর্যাদা রক্ষার লড়াই। আজও সেই চেতনা মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাঁওতাল বিদ্রোহে সিধু মুরমু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব মুরমু—এই চার ভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন দুই বোন ফুলোমনি ও ঝালোমনি মুরমু। তবে ব্রিটিশদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও নির্যাতনে রক্তাক্ত সমাপ্তি ঘটে অভ্যুত্থানের। প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিলেন এই সশস্ত্র সংগ্রামে। নিহত হন অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া চার ভাইও।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পৌরসভার শহীদ মিনারে সাঁওতাল বিদ্রোহে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ। ছবিটি ৩০ জুন উপজেলার বাগদাফার্ম কাটামোড় এলাকায়।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পৌরসভার শহীদ মিনারে সাঁওতাল বিদ্রোহে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ। ছবিটি ৩০ জুন উপজেলার বাগদাফার্ম কাটামোড় এলাকায়।

অভ্যুত্থান শুরুর দিনটিকে এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর লোকজন। দিনটি অনেকের কাছে সিঁধু-কানু দিবস বা সাঁওতাল হুল দিবস বলেও পরিচিত।

প্রতিবছরের মতো দিবসটি আজ সোমবার গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে। এই দিনে আয়োজন করা হয় সিধু-কানুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

‘যেখানে অধিকার বঞ্চনা, সেখানেই হুল’ স্লোগানে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাটে পালিত হয়েছে সাঁওতাল হুল দিবস। আজ বেসরকারি সংস্থা সিসিবিভিও, রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটি ও স্থানীয় গ্রাম সংগঠনগুলো এর আয়োজন করে।

গোদাগাড়ীতে সকালে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে রক্ষাগোলা সংগঠন। শোভাযাত্রাটি পৌরসভার শহীদ মিনারে সাঁওতাল বিদ্রোহে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে একটি সংক্ষিপ্ত পথসভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন সিসিবিভিওর সমন্বয়কারী আরিফ ইথার। আরও বক্তব্য দেন রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটির নেতা সুমিতা হাঁসদা, মলিন মার্ডী, বাপ্পি মার্ডী, মুকুল সরেন ও রঞ্জিত রায়।

এ দিকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে পথযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে উপজেলার বাগদা ফার্ম কাটার মোড় এলাকায় এর আয়োজন করে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি।

শুরুতে কাটামোড় এলাকায় অস্থায়ী বেদীতে শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানান নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। পরে সেখান থেকে একটি পথযাত্রা দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে বাগদা ফার্ম এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জে ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, সাঁওতালদের রক্ত ভেজা জমিতে রংপুর ইপিজেড নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে। তাঁরা প্রয়োজনে রক্ত দেবেন, তবে ওই জমিতে ইপিজেড হবে না।

এ ছাড়া দিনটি উপলক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মাঝি ও পরগনা পরিষদের নেতারা আয়োজন করেন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কাঞ্চন কুমার দাস। আয়োজিত অনুষ্ঠানে উঠে আসে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, তাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই অঙ্গীকার করেন, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সবাই এক সঙ্গে কাজ করে যাবেন। তা ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ের একাধিক স্থানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত