leadT1ad

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ভিটেছাড়া গ্রামবাসী

অন্তঃসত্ত্বা নারী কুহিনূর বেগম বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলা থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে ঘরে থাকা সব নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ওষুধগুলোও নিয়ে গেছে। বারবার বলার পরেও তাঁরা আমার হাত-পা বেঁধে রেখে চলে যায়।’

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫৪
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৮: ২৫
দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ভিটেছাড়া সাধারণ গ্রামবাসী। স্ট্রিম ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে এখন এক ভুতুড়ে এলাকায়। চলছে অবাধে লুটপাট, আগুনে পুড়ছে ঘরবাড়ি। এলাকা ছেড়েছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকল বয়সের মানুষ। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে, আবার কারও ঠাঁই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে।

এই পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় গত শনিবার (৫ জুলাই) গোষ্ঠীগত ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল নেতা সোহরাব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সেদিন ‘মোল্লা গোষ্ঠী’ ও ‘উল্টা গোষ্ঠীর’ মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন চাতলপাড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব মিয়া (২৬)। এ ঘটনার পর থেকেই পুরো ইউনিয়নে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।

লুটপাটের সময় থেকে নিহতের স্বজনেরা টেঁটা-বল্লম ও দেশীয় নানান অস্ত্র নিয়ে চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। এখানে আমাদেরও কোন নিরাপত্তা নেই।’রফিকুল ইসলাম, তদন্ত কর্মকর্তা, চাতলপাড় পুলিশ ফাঁড়ি

এদিকে ছাত্রদল নেতা সোহরাবের মৃত্যুর চার দিন পর তাঁর ভাই মোজাহিদ মিয়া বাদী হয়ে মামলা হয় নাসিরনগর থানায়। মামলায় ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন, বিএনপির সহসভাপতি মো. আফসর মিয়া, ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি শরীফ মিয়া ও জাকারিয়া আহমেদ, কৃষক দলের সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলামসহ ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এরপর হামলার ভয় ও গ্রেপ্তার এড়াতে ওই ইউনিয়ন ছেড়েছে শতাধিক পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি (মোল্লা গোষ্ঠী) মোতাহার মিয়া ও যুবদলের সভাপতি (উল্টা গোষ্ঠী) মো. গিয়াস উদ্দিনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। শনিবার দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ছাত্রদল নেতা সোহরাব মিয়ার মৃত্যু হয়। পরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় মোল্লা গোষ্ঠীর বেশ কিছু বাড়িঘরে।

বাড়িতে হামলা: কী বলছেন ভুক্তভোগীরা

সোম ও মঙ্গলবার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাচ, পোড়া টিন আর লন্ডভন্ড আসবাবপত্র। কয়েকটি বাড়িতে তখনও ধোঁয়া উড়ছে। নারী শিশুদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে আবাদি জমিতে।

ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করি নাই। তারপরও আমার বাড়িতে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন হামলা করে সব ভাঙচুর করে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে জমিতে ঘুমাই। তিন দিন ধরে খাবারও নাই। বাড়িতে এসে যে পানি খাব, হামলাকারীরা ঘরের চুলা, এমনকি পানির টিউবওয়েলটিও তুলে নিয়ে গেছে।’

গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে আছে পোড়া টিন আর লন্ডভন্ড আসবাবপত্র। স্ট্রিম ছবি
গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে আছে পোড়া টিন আর লন্ডভন্ড আসবাবপত্র। স্ট্রিম ছবি

জমিতে আশ্রয় নেওয়া আরেক নারী সাফিয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। কিন্তু মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন আমার ঘরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমার একটা ছেলে। সমিতি (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়া এই ঘরটা তুলছিলাম। আজকে আমার সব শেষ।’

সুফিয়া নামের আরেক বৃদ্ধা বলেন, ‘সবকিছু চোখের সামনে পুড়তে দেখলাম। বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ছেলেরা ভয়ে পালিয়েছে। আমরা কই যাব, কী খাব, কিছুই জানি না।’ তাঁর কথায় ছিল কেবলই অসহায়ত্ব আর ভয়।

অন্তঃসত্ত্বা নারী কুহিনূর বেগম বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলা থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে ঘরে থাকা সব নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ওষুধগুলোও নিয়ে গেছে। বারবার বলার পরেও তাঁরা আমার হাত-পা বেঁধে রেখে চলে যায়।’

দোকানেও হামলা

শুধু ঘরবাড়িই নয়, হামলাকারীদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি চাতলপাড় বাজারের ছয়টি দোকানও। এর মধ্যে চালের আড়ত, মোবাইল ও বিকাশের দোকান, রড-সিমেন্টের দোকান এমনকি সিঙ্গার ফ্রিজের একটি শো-রুমও রয়েছে। এ ছাড়াও ১০টি গরু ও কৃষকের গোলা থেকে অনেক মণ ধানও লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

চাতলপাড় বাজারের ব্যবসায়ী হামজা জানান, তাঁর দোকানে থাকা নগদ ২৫ লাখ টাকা ও রড-সিমেন্টের দোকানের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।

মোল্লা গোষ্ঠীর গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের মোল্লা গোষ্ঠীর ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়েছে। এর মধ্যে জুলহাশ মিয়া, শিশু মিয়া, আলা উদ্দিনসহ অন্তত পাঁচজনের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে ৪০টির বেশি বাড়িতে।

স্কুলে নেই শিক্ষার্থী, পরীক্ষায়ও অনুপস্থিত

সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পর চাতলপাড় ইউনিয়নে অবস্থিত কাঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। স্কুলটিতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী স্কুলে আসে না। প্রাণভয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২১ শিক্ষার্থী। কেবল শিক্ষার্থীই নয়, কয়েকজন শিক্ষকও বিদ্যালয়ে আসেননি।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষকেরাও আতঙ্কে আছেন। আজ (৯ জুলাই) তিন শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলে আসেনি। মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অভিভাবকদের কাছে ফোন করেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। অভিভাবকেরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁরা স্কুলে আসেননি।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসহাক মিয়া বলেন, খুব দ্রুতই শিক্ষা কমিটির সাথে আলোচনা করে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের নিরাপদে স্কুলে আসার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চাতলপাড় ফাঁড়ি পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। আমাদের নেই যাতায়াতের কোনো সুবিধা। তাই আমাদের ওই এলাকায় যাওয়া অনেকটা কঠিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘লুটপাটের সময় থেকে নিহতের স্বজনেরা টেঁটা-বল্লম ও দেশীয় নানান অস্ত্র নিয়ে চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। এখানে আমাদেরও কোন নিরাপত্তা নেই।’

বিষয়:

আইনঅপরাধ
Ad 300x250

সম্পর্কিত