leadT1ad

গত ১ বছরে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে যত আলোচনা

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নতুন কিছু নয়। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই নানা সময়, নানা কারণে তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। কূটনৈতিক মিশন থেকে ছবি সরানো এর সর্বশেষ সংযোজন।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১১: ৪৫
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১৭
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

নেই কোনো লিখিত নির্দেশনা। তবু বিদেশে বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানো হচ্ছে। শুধু মিশনই নয়, ছবি সরানোর তালিকায় রয়েছে কনস্যুলেট, কূটনীতিকদের অফিস ও বাসভবনও। গত কয়েক মাস ধরে ‘জিরো পোর্ট্রেট’ বা কোনো ছবি না রাখার নীতি অনুসরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদেশে অবস্থানরত এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, ‘আমি বলতে পারি, সদর দপ্তর থেকে লিখিত কোনো নির্দেশনা ছিল না। তবে ইঙ্গিতটা বোঝার দরকার আছে।’

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নতুন কিছু নয়। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই নানা সময়, নানা কারণে তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। কূটনৈতিক মিশন থেকে ছবি সরানো এর সর্বশেষ সংযোজন।

চলুন জেনে আসা যাক, গত এক বছরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন কখন এবং কোন বিষয়গুলোর জন্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন—

রাষ্ট্রপতির অপসারণ চেয়ে ফেসবুক পোস্ট হাসনাতের

গত বছরের ৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ (বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক)। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতকরণ, নতুন সংবিধান গঠন, আওয়ামী দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন, হাসিনার আমলে করা সকল অবৈধ চুক্তি বাতিল এবং চুপ্পুকে (মো. সাহাবুদ্দিন) অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারণ করতে হবে।’

এর কয়েক ঘণ্টা পর আন্দোলনের আরেক নেতা সারজিস আলমও (বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক) একই কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তবে তখনও রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে তেমন শোরগোল শুরু হয়নি। এটি জোরালো হয় হাসনাত পোস্ট দেওয়ার ঠিক ১৬ দিন পর—যখন একটি গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য ছাপা হয়।

‘শুনেছি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই’

গত বছরের ১৯ অক্টোবর মানবজমিন পত্রিকার সাময়িকী ‘জনতার চোখ’-এ মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য সংবলিত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ

মো. সাহাবুদ্দিনের বরাতে ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গভবনে ফোন এল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। বলা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসবেন মহামান্য প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এটা শুনেই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোন এল তিনি আসছেন না।’

কিন্তু ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। সে বক্তব্যে তিনি বলেন—আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতিবাদ

মো. সাহাবুদ্দিনের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে জাতীয় সরকারটাও গঠন করতে পারিনি। পারিনি বলেই চুপ্পুর মত এই মানুষ এখনো প্রেসিডেন্ট পদে বসে রয়েছে এবং তাঁর মত মানুষ আজকে বলছে, তিনি নাকি শেখ হাসিনার রিজাইন পেপার দেখেননি। কোন সাহসে তিনি এই কথাটি বলতে পারেন? শেখ হাসিনার রিজাইন পেপার যদি তিনি নিজে না চোখে দেখেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কী করা দরকার, কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এবং তাঁর জায়গা কোথায় হওয়া দরকার, সেটা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ নতুন করে নির্ধারণ করবে।’

একই দিনে নিজের ফেসবুকে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘হাসিনাকে উৎখাত করা হয়েছে; একটি অবৈধ সরকারকে জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করেছে। এখানে পদত্যাগপত্রের কোন ভূমিকা নেই।’

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ২২ অক্টোবর শহীদ মিনারে গণজমায়েত ডাকা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকে।

এ জমায়েত থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে তৃতীয় দাবি ছিল, রাষ্ট্রপতিকে ওই সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করতে হবে।

বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ

২২ অক্টোবর দুপুর থেকেই বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে তাঁর বাসভবন, বঙ্গভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তারা ‘এক দফা এক দাবি, চুপ্পু তুই কবে যাবি’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। সন্ধ্যার পর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে।

এ সময় বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধা দেয়। পরে তাদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ।

বিক্ষোভকারীরা দাবি করেন, মো. সাহাবুদ্দিন আওয়ামী লীগের দোসর। তাই তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।

রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন: আইন উপদেষ্টা

২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নাই, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ উনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন।’

পরে প্রেস উইং আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে সরকার একমত।

বিএনপির প্রতিক্রিয়া

২৩ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদটা একটা সাংবিধানিক পদ। এটা প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’ সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সংকটের সৃষ্টি হবে এবং রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত হয় বা বাধাগ্রস্ত হয় বা কণ্টকাকীর্ণ হয়, সেটা জাতির কাম্য হতে পারে না।’

২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে, তিনি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই গণ-অভ্যুত্থানের যে ফসল, সেই ফসলকে ঘরে তোলার জন্য এবং বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সুসংহত করতে হয়, তাহলে যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন, তা হলো জাতীয় ঐক্য এবং কোনো রকম হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে একটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সবগুলো কাজ করা।

গণ-অভ্যুত্থান ছিল আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে দেওয়া বাণীতে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল—দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ। এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাইয়ের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।’

রাষ্ট্রপতির দেওয়া এ বাণীকে অনেকেই ভিন্ন চোখে দেখছেন।

গত এক বছরে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। বিদেশে কূটনৈতিক মিশন থেকে তাঁর ছবি সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি মূলত চলমান এই বিতর্কের সর্বশেষ সংযোজন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত