leadT1ad

যে কারণে শহীদুল আলম গ্লোবাল ফ্লোটিলায়, ফিলিস্তিনের সঙ্গে

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। এই নৌবহরে রয়েছে ৪০টির বেশি বেসামরিক নৌযান। এই বহরে প্রায় ৪৪টি দেশের ৫০০ মানুষের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক। সেখানে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সেখানে রয়েছে শহীদুল আলম।

মীর হুযাইফা আল মামদূহ
স্ট্রিম গ্রাফিক

দৃকের সঙ্গে কাজ করছি গত ডিসেম্বর থেকে। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবায় স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা’ শীর্ষক একটা গবেষণা দিয়ে কাজের শুরু। কাজের আগে আমার রেহনুমা আহমেদ কিংবা শহীদুল আলমের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় বা চেনাজানা ছিল না। আমি চিনতাম তাঁদের, কিন্তু তাঁরা আমাকে চিনতেন না। তারপর থেকে দৃকের কাজের সুবাদে তাঁদের সঙ্গে একটা পরিচয় হয়েছে।

ফিলিস্তিন বিষয়ে রেহনুমা আহমেদ আর শহীদুল আলম একইরকম করেই ভাবেন। শহীদুল আলমের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা কম। তাই রেহনুমা আহমেদের অভিজ্ঞতাগুলোই লিখছি।

রেহনুমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আপনি টের পাবেন, প্রতি মুহূর্তেই তিনি ফিলিস্তিনকে ইয়াদ করছেন। যেমন আপনার টেক্সটের রিপ্লাইয়ে তিনি ফিলিস্তিনের পতাকার ইমোটিকন ব্যবহার করবেন কিংবা ফিলিস্তিনের প্রতীক তরমুজ। আবার নিজে যখন তিনি মেসেজ করবেন, মেসেজের শেষে দেখা যাবে, ফিলিস্তিনের পতাকার ইমোটিকন, আর তরমুজের ইমোটিকন ব্যবহার করবেন, প্রায় প্রতিটাতেই। আর সামনাসামনি দেখলে তো দেখবেনই, সারাক্ষণই কান্ধে ঝুলছে কেফিয়া। একটু সময় কথা বললেই একবার ফিলিস্তিন নিয়ে আলাপ করবেন।

দৃকে ঢুকলেই এখন দেখবেন, ৭ অক্টোবরের পর থেকে যে কয়েকজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নাম। আল জাজিরার সাংবাদিক মুনতাসের মারাই যখন এসেছিলেন, থেমে গিয়েছিলেন দৃকের প্রবেশ পথে এবং প্রতিটি নামের পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, এর সঙ্গে অমুক দিন শেষ কথা হয়েছে, ওর সঙ্গে ওর শাহাদাতের এই কিছু দিন আগে কথা হয়েছে।

সুমুদ ফ্লোটিলায় শহীদুল আলম। ফেসবুক থেকে নেওয়া
সুমুদ ফ্লোটিলায় শহীদুল আলম। ফেসবুক থেকে নেওয়া

রেহনুমা আহমেদ বা শহীদুল আলমের ফিলিস্তিন নিয়ে এই অ্যাক্টিকভিজম অবশ্য আজকের না; বরং অনেক আগ থেকেই তাঁরা নানা অ্যাক্টিকভিজম করছেন। ফিলিস্তিনবিষয়ক একটি আয়োজনে রেহনুমা আহমেদ একটা ঘটনাও বলেছিলেন: ২০০২ সালে যখন রামাল্লায় ইয়াসির আরাফাতকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অবরোধ করে রাখে, রেহেনুমা তখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য রাস্তায় ঘুরে ঘুরে স্বাক্ষর সংগ্রহ করছিলেন। ওই সময় একজন মুচির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। প্রথমে রেহনুমা ভেবেছিলেন, এই লোকের স্বাক্ষর নেবেন না। তারপর আবার গিয়ে স্বাক্ষর নেওয়ার আগে যখন ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ তুললেন, মুচি বলেছিলেন, তিনি জানেন। ফলে ফিলিস্তিনের সঙ্গে দৃকের রেহেনুমা আহমেদ ও শহীদুল আলমের সখ্য অনেকদিন থেকেই।

ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে আমি মাঝেমধ্যেই বসি রেহনুমা আহমেদের সঙ্গে। আমাকে তিনি আস্তে আস্তে পুরো রাজনীতি বলেন। ফিলিস্তিন নিয়ে আমি কথা বলতে পারি না খুব বেশি, নিজেকে অনেক বেশি অক্ষম লাগে, অসহায় হয়ে থাকি, কান্না পায়, নিজেকে বুশনেলের মতো জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করে, তাতে যদি পরিত্রাণ মেলে। রেহনুমা প্রায়ই বলেন, যখন কোথাও কোনো জেনোসাইড ঘটে, আমাদের সবার তখন উচিত সবকিছু ফেলে রেখে সেই জেনোসাইডকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করা। যেমনটা হুতিরা করছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য আর মুসলমাদের মধ্যে কেবল হুতিরাই তাদের দায়টুকু পালন করছে। আর আমরা যদি নিজেদের সেই জেনোসাইডকে থামাতে না পারি, আমাদের কাজ হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে ফিলিস্তিনকে মনে করা, প্রতিমুহূর্তে বলতে থাকা ফিলিস্তিনের কথা, যখন, যেখানে, যেভাবে সম্ভব।

কয়দিন আগে রেহনুমা আহমেদের জন্মদিন গেল। শহীদুল ভাই গান গাইলেন রেহনুমার জন্য। বেশ রোমান্টিক একটা দৃশ্য। সেই সময়েই রেহনুমা শ্লোগান দিলেন, ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’, গলা ধরে এল দেখলাম তাঁর। সঙ্গে আমারও!

শহীদুল ভাই বেশ কয়েকবারই গাজায় যেতে চেয়েছিলেন মানুষ হিসেবে নিজের দায় মেটানোর জন্য। পারেননি। এইবার সেই সুযোগ হয়েছে। সুযোগ পেয়েই ছুটে গিয়েছেন এক ভয়ানক পথে। যেখানে পদে পদেই দুর্যোগ আর মৃত্যুর শঙ্কা, ফেরত না আসার আশঙ্কা।

সেপ্টেম্বরে দৃকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সিনেমা দেখছিলাম সবাই মিলে, ‘নো আদার ল্যান্ড’। মোসাফির ইয়াত্তা নামের এক গ্রাম কীভাবে অল্প অল্প করে কবজা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আর সেটেলাররা মিলে, সেই বিষয়ক ডকুমেন্টারি। সিনেমা দেখে আমার স্ত্রী যাহরা বলছিল, ওর মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমার চোখেও তখন পানি। আর পানি দেখেছি শহীদুল আলমের চোখে।

দৃক যেমন ফিলিস্তিন নিয়ে অ্যাক্টিভিজম করে, করছে; একই সঙ্গে দেশে ঘটতে থাকা সব জুলুমের বিরুদ্ধেই নানাভাবে কিছু না কিছু অ্যাক্টিভিজম করে। তনু ধর্ষণ, মুনিয়া হত্যাকাণ্ড, সড়ক আন্দোলন, আওয়ামী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধতা থেকে শুরু করে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন—সব নিয়েই দৃককে বিচলিত হতে দেখেছি, কথা বলতে দেখেছি, এগিয়ে যেতে দেখেছি। জুলাই আন্দোলনে দৃকের আগাগোড়া সবাই পুরোটা সময়ে রাস্তায় ছিলেন। আন্দোলন শেষে আহত ও শহীদদের পুনর্বাসনের নানা কাজ করেছে দৃক।

গত দুদিন ধরে দেখছি, শহীদুল ভাইয়ের ফ্লোটিলা গমন নিয়ে নানা সমালোচনা। সেই সমালোচনা দেখে আমি ফেসবুকে একটু লিখেছিলাম, সেটিই আমার এখানে উদ্ধৃত করি:

ফিলিস্তিন দখলের ইতিহাস তো আজকের না। এটা গত ৭৮ বছর ধরেই চলছে। দৃকের ফিলিস্তিন নিয়ে অ্যাক্টিভিজমও ৭ অক্টোবরের পর শুরু হয় নাই, অনেক আগ থেকেই চলছে। একই সঙ্গে দৃক ফিলিস্তিনবিষয়ক অ্যাক্টিভিজমে ফিলিস্তিন ও সেখানকার পলিটিক্সটা জেনে বুঝেই করে, করছে। আমি গত ডিসেম্বর থেকে দৃকের সঙ্গে কাজ করছি। এর মধ্যে তিনজন ফিলিস্তিনের বোদ্ধাজন এসে কথা বলে গেছেন এখানে।

ফিলিস্তিনের পলিটিক্সে কোথায় ধর্ম, কোথায় রাজনীতি, কোথায় এই দুটোকে ছাপিয়ে অন্য কোন অনুষঙ্গ বড় হয়ে উঠেছে, সেই ব্যাপারটা দৃকের বোঝাপড়ায় খুবই তীক্ষ্মভাবে আছে বলেই আমি দেখেছি এই কয়দিনে। কাজের সুবাদে মাসোহারা পাই বলে সাফাই গাইছি না, আদতেই আছে।

যেমনটা আছে পাহাড় নিয়ে তাদের কনসার্ন। পাহাড়ের রাজনীতির ধরন, পাহাড়বিষয়ক সাংবাদিকতার রকমফের বোঝাপড়া, পাহাড়ি মানুষদের ওপর ঘটতে থাকা অনাচারের বিরুদ্ধে বলা থেকে শুরু করে তাদের পক্ষ হয়ে আইনি লড়াই, সবটাই করে দৃক।

ফলে পাহাড় আর ফিলিস্তিন ইস্যুতে দৃককে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার রাজনীতি ফিডে দেখাটা একটু বিব্রতকরই।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় শহীদুল আলম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় শহীদুল আলম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

একটিভিজম করলে নানা সমালোচনা কান্ধে এসেই পড়ে। দৃকের কান্ধেও আসবে, আসছে স্বাভাবিক। তবে, যদি কখনো দেখি দৃক জুলুমের পক্ষে অবস্থা নিচ্ছে, আমার সমালোচনাই সবার আগে থাকবে। ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই।

শহীদুল ভাই বেশ কয়েকবারই গাজায় যেতে চেয়েছিলেন মানুষ হিসেবে নিজের দায় মেটানোর জন্য। পারেননি। এইবার সেই সুযোগ হয়েছে। সুযোগ পেয়েই ছুটে গিয়েছেন এক ভয়ানক পথে। যেখানে পদে পদেই দুর্যোগ আর মৃত্যুর শঙ্কা, ফেরত না আসার আশঙ্কা। তবুও তিনি গিয়েছেন, নিজের জানের তোয়াক্কা করেননি। আমরা জানি না, এই সুযোগ পেলে আমি রিস্ক নিতে পারতাম কি না, কিন্তু শহিদুল আলম নিয়েছেন।

একটা ছোট ঘটনা বলে শেষ করছি, গত শনিবার দৃকে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে দৃকের প্রায় সবাই ছিলেন। অনেকেই শংকা নিয়ে বসেছিলেন, কী হবে ভেবে। সায়দিয়া গুলরুখ কাঁদছিলেন। আর রেহনুমা আহমেদকে দেখেছিলাম স্থির, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চেহারা নিয়ে সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, এইবার হয়তো জেনোসাইডের বিপক্ষে নিজের দায়ের কিছুটা হলেও সারতে পেরেছেন।

শহীদুল আলমের ওপর আমি আমার দায়টুকুও চাপিয়ে দেব। আর আমরা বারবার ফিলিস্তিনের দিকেই নিজেদের অভিমুখ ঠিক করব, যদি না স্বাধীন হয়।

আর সব জুলুমই আমাদের ফিলিস্তিনকে মনে করিয়ে দেয়।

মীর হুযাইফা আল মামদূহ: লেখক ও গবেষক

Ad 300x250

সম্পর্কিত