leadT1ad

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশের খসড়া

দ্বিধায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা, আপত্তি শিক্ষকদেরও

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে নিয়ে হচ্ছে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’

রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর এই খসড়া প্রকাশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত আহ্বান করা হয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের পরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা করছেন, কাগজে-কলমে প্রস্তাবটি আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে এটি উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারের সুযোগ সীমিত করতে পারে। বিশেষ করে মেয়েদের ভর্তির হার কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া এ উদ্যোগের ফলে কলেজগুলোর স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে যেতে পারে, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের পেশাগত ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমও বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও জোরালো হয়েছে। শিক্ষকদের দাবি, এই প্রস্তাবিত কাঠামো কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করবে, নারী শিক্ষা সংকুচিত করবে এবং শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক পদকে হুমকির মুখে ফেলবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত—কেউ বিশ্ববিদ্যালয় চান, কেউ আবার বর্তমান কাঠামো রক্ষার দাবি জানাচ্ছেন।

কাঠামো ও ক্যাম্পাস ব্যবহারের নিয়ম

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে যে, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ এবং কবি নজরুল কলেজ—মোট সাতটি কলেজ ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র সাতটি ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচালিত হবে। প্রতিটি ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের জন্য দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ব্যবহার করা হবে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই কলেজগুলোর বিদ্যমান কার্যক্রম যেমন উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ের পুরনো কোর্স ইত্যাদি চলমান থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অডিটোরিয়াম ইত্যাদি একটি স্বতন্ত্র স্থানে স্থাপন করা হবে। প্রতিটি ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে (দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা) ব্যবহার করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করা হবে।

প্রশাসনিক কাঠামো ও একাডেমিক ক্যাম্পাস

খসড়া অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে। রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারারকে সরকার নিয়োগ করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যেমন সিন্ডিকেট এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল গঠন করা হবে শিক্ষক, প্রশাসক এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে।

একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাতটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি পৃথক ক্যাম্পাসে বিভক্ত করা হবে, যেমন ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাস’। তবে প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেন্দ্র, অডিটোরিয়াম এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি স্বতন্ত্র স্থানে পরিচালিত হবে।

শিক্ষাদান পদ্ধতি: হাইব্রিড ও ইন্টারডিসিপ্লিনারি

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষাদান হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। এর আওতায় ৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে, বাকি ৬০ শতাংশ সরাসরি শ্রেণিকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। তবে সব পরীক্ষা সশরীরে দিতে হবে।

শিক্ষা কার্যক্রম ইন্টারডিসিপ্লিনারি কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম চারটি সেমিস্টারে ‘সাধারণ বিষয়’ অধ্যয়ন করতে হবে। পরবর্তী চারটি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা ডিসিপ্লিনভিত্তিক বিশেষায়িত কোর্স গ্রহণ করবে।

প্রথম চারটি সেমিস্টার শেষে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে শর্তপূরণ সাপেক্ষে তাদের নিজ ক্যাম্পাসে ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ পাবে।

স্কুল ও ডিসিপ্লিনভিত্তিক বিভাজন

খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে চারটি স্কুলে বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ এবং স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসের মাধ্যমে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালানো হবে।

ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস, ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস এবং বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে পরিচালিত হবে স্কুল অব সায়েন্স। ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে অ্যাপ্লাইড ম্যাথেমেটিক্স, জুলোজি, ডেটা সায়েন্স, বায়োকেমিস্ট্রি এবং বায়োটেকনোলজি ডিসিপ্লিন চালু করা হবে। ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে ফিজিক্স, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি, বোটানি এবং ফরেনসিক সায়েন্সের কোর্স থাকবেন। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে সাইকোলজি এবং এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্টের বিষয়গুলো পরিচালিত হবে।

স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ সরকারি বাঙলা কলেজ ক্যাম্পাসে পরিচালিত হবে, যেখানে জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্টাডিজ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ইকোনোমিকস, ফিল্ম স্টাডিজ এবং ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের ডিসিপ্লিন চালু করা হবে। স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ সরকারি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসে গঠিত হবে, এবং সেখানে অ্যাকাউন্টিং, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, হোটেল অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস, এবং ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ম্যানেজমেন্টের কোর্স পরিচালিত হবে।

স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস কবি নজরুল সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাসে পরিচালিত হবে। কবি নজরুল সরকারি কলেজে আইন ডিসিপ্লিন এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ক্রিমিনোলজি কোর্স চালু করা হবে।

শিক্ষকদের আপত্তি

অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের পর একযোগে মানববন্ধন করেছেন সাত কলেজের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, সাত কলেজকে হঠাৎ একত্র করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হলে উচ্চশিক্ষার সংকোচন ঘটবে এবং নারী শিক্ষার জন্য নিরাপদ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও তারা উল্লেখ করেছেন।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম এম আতিকুজ্জামান শিক্ষকদের আন্দোলনে বলেন, ‘এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পর এই সাত কলেজকে কেন টার্গেট করা হলো? আমি জানি এর পেছনে একটি স্বার্থান্বেষী মহল রয়েছে, যা এই সাত কলেজকে ভ্যানিশ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সুযোগ তৈরি করতে চায়।’

মানববন্ধন থেকে শিক্ষকরা ৮ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। দাবিগুলোতে কলেজের নাম, লোগো ও সম্পত্তি সংরক্ষণ, পরীক্ষা বা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয়া মডেল না চাপানো, বিদ্যমান বিষয়গুলো সংরক্ষণ, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা, নারীর শিক্ষা সংরক্ষণ এবং চাকরি বা সাংগঠনিক কাঠামোর অক্ষুণ্ণতা বজায় রাখার জোর দাবি করা হয়েছে। এছাড়া খসড়া অধ্যাদেশ কার্যকর করার আগে শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সুশীল সমাজ এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রিভিউ কমিটির মাধ্যমে পর্যালোচনা করতে হবে।

দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষার্থীরা

অধ্যাদেশের খসড়ার প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পেতে আগ্রহী, কিন্তু চলমান সেশনের শিক্ষার্থীরা বাদ পড়ায় তারা এটিকে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত মনে করছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত না করলে শিক্ষাগত অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে।

ঢাকা কলেজের স্নাতকের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী রাহাত স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। চলমান সেশন বাদ পড়া মানে আমাদের শিক্ষার মূল্য কমিয়ে দেওয়া। এটি আমাদের অধিকারহীন অবস্থায় ফেলে দেয়।’

ইডেন মহিলা কলেজের স্নাতকের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী জিনাত আরা নিতু। তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজ বহু বছর ধরে নারী শিক্ষার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবেশ হিসেবে পরিচিত। নতুন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে সেই নিরাপত্তা ও সুযোগ সংকুচিত হবে। এটি শুধু শিক্ষার সুযোগ কমাবে না, বরং আমাদের কলেজের ঐতিহ্য ও পরিচয়ও ক্ষতিগ্রস্ত করবে ‘

একই কলেজের অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্নাতক শিক্ষার্থীরা হয়তো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা পাবে, কিন্তু আমাদের মতো চলমান সেশনের শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়া হলে এটা স্পষ্টভাবে বৈষম্য। আমাদেরও সমানভাবে সুযোগ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। নতুন কাঠামোর পরিকল্পনা আমাদের ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’

শিক্ষার্থীদের অনুরোধ, প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো এমনভাবে গঠিত হোক যাতে চলমান শিক্ষার্থীর স্বার্থ রক্ষা হয়, নারীর শিক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ অক্ষুণ্ণ থাকে এবং সকল শিক্ষার্থী সমানভাবে সুযোগ পায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত