leadT1ad

বাংলাদেশের সংবিধান যে অবস্থায় আছে, তা থাকা না থাকা এক সমান

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা এখন নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন। জুলাই সনদ ও আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সংকটের কারণ এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

মাহবুব উল্লাহ
মাহবুব উল্লাহ

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৩১
স্ট্রিম গ্রাফিক

স্ট্রিম: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি জুলাই সনদ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এমনটা কেন হলো?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: এটা ঠিক যে, অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তি ও দলের মধ্যে একটি ঐক্য ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে নতুন নতুন ইস্যু সামনে এসেছে। প্রথমে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা ছিল, যা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কোনো সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দেননি। অবশেষে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

নির্বাচনের প্রশ্ন আসতেই স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও সামনে চলে আসে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচন থেকে নিজ নিজ পক্ষে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কারণেই সেই ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে একটি চিড় ধরেছে।

স্ট্রিম: এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? দলগুলো কি আবার সাংঘর্ষিক পথের দিকে এগোচ্ছে?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: আমি মনে করি, দ্বন্দ্ব দুই প্রকার—একটি হলো ‘মীমাংসীয় দ্বন্দ্ব’ (resolvable conflict), যা সমাধান করা সম্ভব। অন্যটি হলো ‘অমীমাংসীয় দ্বন্দ্ব’ (unresolvable conflict)। '৭১ সালে স্বাধীনতার প্রশ্ন বা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার প্রশ্নটি ছিল একটি অমীমাংসীয় দ্বন্দ্ব, যার সমাধান হয়েছিল একটি যুদ্ধের মাধ্যমে এবং নতুন রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে।

এখনকার পরিস্থিতিকে অমীমাংসীয় বলা যাবে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে আমি বলব অধ্যাপক ইউনূসের ওপর বড় দায়িত্ব বর্তায়। তাকে এই দ্বন্দ্বগুলোকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হবে, যাতে তা মীমাংসার অতীত না হয়ে যায়। যদি দলগুলোকে একটি মীমাংসার পর্যায়ে আনা যায়, তবে দেশ এই রাজনৈতিক জট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি তাৎক্ষণিক সুবিধা আদায়ের জন্য নিজ নিজ অবস্থানে গোঁয়ার্তুমি করে বসে থাকে, তবে তারা বড় ভুল করবে। কারণ এর পরিণতিতে এমন কিছু ঘটতে পারে, যা কারোর জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। যেমন—বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে, অথবা নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে ভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা চলে আসতে পারে।

অনেকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। তৃতীয় কোনো শক্তির আগমন বা এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির গুঞ্জনও শোনা যায়। তবে আমার মনে হয় না, ২০০৭-৮ সালের সেই মডেলের পুনরাবৃত্তি এখন সম্ভব। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত নয়।

স্ট্রিম: তাহলে এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো দিক কি আপনি দেখছেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: আমি চূড়ান্তভাবে হতাশাবাদী নই। কারণ দলগুলোর মধ্যে এখনও কথাবার্তা চলছে, একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, সামাজিক সৌজন্যবোধ বজায় আছে। অধ্যাপক ইউনূস যখন তাঁর ‘জাতীয় ঐক্য কমিশনে’ সব দলকে আমন্ত্রণ জানান, তখন ছোট-বড় নির্বিশেষে প্রায় ২৭-২৮টি দলই আলোচনায় অংশ নেয়।

এ থেকে বোঝা যায়, সকলের মধ্যেই একটি সহমতে আসার প্রয়াস রয়েছে, যদিও তা নিজস্ব দলীয় স্বার্থকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে নয়। এখন দেখার বিষয় হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা দক্ষতার পরিচয় দেয়। মূল চ্যালেঞ্জ হলো, যে বিষয়গুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, সেখানে একটি ‘মিটিং গ্রাউন্ড’ বা আপোসের জায়গা খুঁজে বের করা। প্রত্যেককেই কিছু কিছু ছাড় দিয়ে একটি মীমাংসার বিন্দুতে পৌঁছাতে হবে।

এই মুহূর্তে জাতির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। এই ঐক্য না থাকলে বাংলাদেশবিরোধী, ফ্যাসিবাদী ও পতিত শক্তির জন্য পরিস্থিতি লাভজনক হবে, যা নিশ্চয়ই কারো কাম্য হওয়া উচিত নয়।

স্ট্রিম: দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? মূল সংকট কোথায়?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জুলাই সনদ’। এই সনদের নিষ্পত্তি না হওয়ায় কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা একটি বড় রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সময়মতো হবে কি না, তা নিয়েও জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশের স্বার্থে একমত হতে না পারে, তবে দেশ আরও বড় সংকটের মুখে পড়তে পারে।

অনেকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। তৃতীয় কোনো শক্তির আগমন বা এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির গুঞ্জনও শোনা যায়। তবে আমার মনে হয় না, ২০০৭-৮ সালের সেই মডেলের পুনরাবৃত্তি এখন সম্ভব। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত নয়।

এর ওপর "ডেমোক্লিসের তলোয়ারের" মতো ঝুলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চতম আদালতে বিচারাধীন একটি মামলা। আদালত যদি রায় দেওয়ার দিন থেকেই তা কার্যকর করার নির্দেশ দেন, তবে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন একটি সরকার গঠনের প্রশ্ন উঠবে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

সবশেষে, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ভারত এই সরকারের সাফল্য চায় না, কারণ তাদের লক্ষ্য শেখ হাসিনা ও তার দলকে পুনরায় ক্ষমতায় আনা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মতো সমর্থক ও এজেন্ট তাদের রয়েছে। ওদিকে শেখ হাসিনাও এখনো নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করছেন।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আকাশে একটি গুমোট ভাব বিরাজ করছে। এই অবস্থা যদি হালকা বৃষ্টিতে কেটে যায়, তবে ভালো। কিন্তু এটি যদি বড় কোনো ঝড় বা সাইক্লোনের জন্ম দেয়, তবে তা দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে।

গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি তৈরি করতে হবে। আর বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেই ভিত্তি তৈরির প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো এই অলিগার্কির ক্ষমতাকে চূর্ণ করে দেওয়া। এই মূল কাজটি না করে অন্য সব বিতর্কই অর্থহীন।

স্ট্রিম: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থি কয়েকটি দল জুলাই সনদকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে অপরিবর্তনযোগ্য রাখাসহ বেশ কিছু দাবিতে আন্দোলন করছে। এই বিতর্ককে আপনি কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বিষয়টি সংবিধানের উপরে বা নিচে রাখার নয়। জুলাই সনদ হলো গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জনগণের আকাঙ্ক্ষার একটি লিখিত রূপ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে এভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তার ভিত্তিতেই নতুন সংবিধান প্রণয়ন বা পুরোনো সংবিধান সংশোধন করা হয়।

আমার ব্যক্তিগত মত হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানটি থাকা না থাকা প্রায় সমান। এটিকে একটি পবিত্র দলিল মনে করার কোনো কারণ নেই। এটি এতবার কাটছাঁট করা হয়েছে এবং এতে এত অগণতান্ত্রিক ধারা যুক্ত করা হয়েছে যে, এটি একটি পারিবারিক দলিলে পরিণত হয়েছে। তাই জোড়াতালির কাজ না করে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংবিধান তৈরি করতে পারলে সেটাই দেশের জন্য ভালো হবে।

‘সংবিধানের ঊর্ধ্বে’—এই বিতর্কটি অর্থহীন। মূল কথা হলো, জুলাই সনদের নীতিগুলোকে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ (Basic Structure) হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি না। যদি তা করা হয়, তবে সেটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হতে কোনো বাধা নেই। এটি বইয়ের কোন পাতায় লেখা থাকল—পরিশিষ্টে নাকি মূল দলিলে—সেটা বড় কথা নয়। মূল বিষয় হলো নীতিগুলোর প্রতি অনুগত থাকা।

আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। অহেতুক বিতর্কের কারণে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান তৈরি করতে আট বছর লেগেছিল। ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বনাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’—এই বিতর্কে জড়িয়ে তারা মূল কাজ থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল। আমাদেরও সেই একই ভুল করা উচিত হবে না।

স্ট্রিম: এই সনদ ও সংবিধান বিতর্ককে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, এর মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: আমার মতে, এই সনদ বা সংবিধান বিতর্কগুলো হলো পার্শ্ববর্তী বা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক (Side Debates), যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সংকটের মূল জায়গায় হাত না দিচ্ছি। গণতন্ত্রের জন্য অবিশ্বাস ভালো, কিন্তু চূড়ান্ত অবিশ্বাস গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করে দেয়।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় আমরা যে নিখুঁত গণতন্ত্র চাই, তা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। মূল সংকট অন্যত্র। সবচেয়ে বড় সংস্কার হওয়া উচিত ছিল শেখ হাসিনার আমলে সৃষ্ট ‘অলিগার্কি’ বা গোষ্ঠীতন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া। সেই কাজটি করতে না পারলে শুধু একটি সনদ তৈরি করে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যাবে না। আমরা দেখছি, সেই গোষ্ঠীতন্ত্রের সদস্যরা এখনো কতটা শক্তিশালী। তারা দেশের বাইরে বসে দেশের ভেতরে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য কোটি কোটি টাকা পাঠাচ্ছে। শুধু চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই, রাঘববোয়ালদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

স্ট্রিম: এই সংকট থেকে উত্তরণের প্রকৃত পথ কী বলে মনে করেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বিগত সরকার রাষ্ট্রকেই দখল করে নিয়েছিল। বিচার বিভাগ, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানকে তারা হস্তগত করেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি হতে পারে না। তাই প্রথমত, এই ‘দখলকৃত রাষ্ট্রকে’ মুক্ত করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কেউ রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে না পারে।

দ্বিতীয়ত, সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্বলকে সবল করা এবং অতি শক্তিশালীদের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।

আমার শেষ কথা হলো, গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি তৈরি করতে হবে। আর বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেই ভিত্তি তৈরির প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো এই অলিগার্কির ক্ষমতাকে চূর্ণ করে দেওয়া। এই মূল কাজটি না করে অন্য সব বিতর্কই অর্থহীন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত